দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতি প্রাচীনকাল থেকে বহুপাক্ষিক, জটিল এবং স্বার্থের মিশ্রণে পরিচালিত হয়ে আসছে। বিশেষ করে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সীমান্ত এলাকা, যা প্রাচীনকাল থেকে সামরিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিক অস্থিরতার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে বিবেচিত, সাম্প্রতিক সংঘাতের মাধ্যমে আবারও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য গুরুতর হুমকির প্রতীক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। সীমান্তের এই অস্থিরতা কেবল দুই দেশের মধ্যে সামরিক উত্তেজনার সীমাবদ্ধ নয়; এটি দক্ষিণ এশিয়ার কূটনীতি, আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা, মানবিক পরিস্থিতি এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করছে।
২০২৫ সালের ৯ অক্টোবর, কাবুলের আবদুল হাক্ক স্কয়ারে দুটি বিস্ফোরণ ঘটে, যা পুরো শহরকে আতঙ্কের ছায়ায় আচ্ছন্ন করে। বিস্ফোরণগুলোকে পাকিস্তান সরকার তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তির (টিটিপি) প্রধান নূর ওয়ালি মেহসুদকে লক্ষ্য করে চালানো হয়েছে বলে দাবি করে। যদিও মেহসুদ নিজে একটি অডিও বার্তায় বেঁচে থাকার ঘোষণা দেন, এই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় ১১ অক্টোবর রাতে আফগান বাহিনী পাকিস্তানি সীমান্ত চৌকিগুলোতে হামলা চালায়। এই আক্রমণে পাকিস্তান ২৩ সেনা সদস্যকে হারায়, তবে পাল্টা হানায় তারা দাবি করে, ২০০ তালেবান এবং তাদের সহযোগী সন্ত্রাসী নিহত হয়েছে। আফগান বাহিনী ঘোষণা করে, তারা সীমান্তে ২৫টি পাকিস্তানি চৌকি দখল করেছে। এর পরপরই তোরখাম, চামান এবং অন্যান্য প্রধান সীমান্ত চৌকিগুলো বন্ধ হয়ে যায়, যার ফলে বাণিজ্য, পরিবহন এবং সাধারণ জনগণের দৈনন্দিন জীবন মারাত্মকভাবে প্রভাবিত হয়।
সীমান্ত সংঘাতের পেছনে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক জটিলতা রয়েছে। পাকিস্তান দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ করে আসছে যে, আফগান তালেবান তাদের ভূখ-ে টিটিপি সদস্যদের নিরাপদ আশ্রয় দিচ্ছে। আফগান প্রশাসন এই অভিযোগ অস্বীকার করলেও, পাকিস্তানের অভ্যন্তরে টিটিপির হামলার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। এই পরিস্থিতি দুই দেশের সম্পর্ককে ক্রমশ উত্তেজনাপূর্ণ করে তুলেছে। ২০২১ সালে তালেবান ক্ষমতায় ফেরার পর, আফগান ভূখ-ে টিটিপির কার্যক্রম বৃদ্ধি পায়। ইসলামাবাদ এই কার্যক্রমকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসাবে বিবেচনা করছে। আফগান তালেবান রাজনৈতিক ও সামাজিক কারণে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হচ্ছে, যা সীমান্ত অস্থিরতাকে আরও তীব্র করছে।
সীমান্ত সংঘাতের সামরিক দিকও অত্যন্ত জটিল। সংঘাত প্রায়শই গেরিলা যুদ্ধের কৌশলে পরিচালিত হয়। তালেবান বাহিনী হঠাৎ এবং অপ্রত্যাশিত আক্রমণ, দ্রুতগতি, স্থানীয় সমর্থন এবং ট্যাকটিক্যাল অপ্রচলিত কৌশল ব্যবহার করে পাকিস্তানি সীমান্ত প্রহরীদের তুলনায় অধিক কার্যকর। পাকিস্তান বাহিনী প্রচলিত যুদ্ধের আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করেÑ যেমন ট্যাঙ্ক, আধুনিক বিমান, পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা এবং অস্ত্রশস্ত্রÑ তবুও গেরিলা কৌশলের কারণে সীমান্ত চৌকিগুলো হারাতে পারে। তালেবান বাহিনী স্বল্পসংখ্যক হলেও দ্রুতগতি ও চমকপ্রদ কৌশল ব্যবহার করে কার্যকর আক্রমণ চালায়।
টিটিপি, তালেবান এবং ইসলামিক স্টেট ইন খোরাসান প্রভিন্স (ওঝকচ)-এর কর্মকা- সীমান্ত সংঘাতকে আরও জটিল করে। টিটিপি পাকিস্তান অভ্যন্তরে সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালায়, যার মধ্যে আত্মঘাতী বোমা হামলা এবং অন্যান্য সহিংস কর্মকা- অন্তর্ভুক্ত। আফগান ভূখ-ে তারা নিরাপদ আশ্রয় পায়। আফগান তালেবান এই সংগঠনের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায়, কিন্তু অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং সামাজিক প্রতিরোধের কারণে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া কঠিন। ওঝকচ সীমান্ত অস্থিরতাকে আরও তীব্র করতে পারে।
মানবিক প্রভাবও মারাত্মক। সীমান্ত চৌকিগুলো বন্ধ থাকায় ব্যবসা-বাণিজ্য এবং পরিবহন ব্যাহত হয়েছে। সীমান্তবর্তী সাধারণ জনগণ মানবিক সংকটের মুখোমুখি হয়েছে। খাদ্য ও স্বাস্থ্যসেবার সীমিত প্রাপ্যতা, আফগান শরণার্থীদের নিরাপদ আশ্রয় না পাওয়া, এবং অর্থনৈতিক দুর্ভোগ মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করছে। সীমান্ত অস্থিরতার কারণে স্থানীয় অর্থনীতি বিপর্যস্ত। আন্তর্জাতিক সংস্থা ও মানবিক সহায়তার মাধ্যমে এই সংকট প্রশমিত করা প্রয়োজন।
আঞ্চলিক প্রেক্ষাপটও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভারতের সঙ্গে আফগানিস্তানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক পাকিস্তানকে সন্দেহের চোখে দেখতে বাধ্য করছে। ভারতের কূটনৈতিক নীতির প্রভাব, পাকিস্তানের নিরাপত্তা চিন্তা, এবং আফগানিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবিÑ সবকিছু মিলিত হয়ে সংকটকে আরও জটিল করেছে। চীন, রাশিয়া, সৌদি আরব, কাতার এবং ইরান পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে এবং উভয় পক্ষকে সংযম বজায় রাখার আহ্বান জানিয়েছে।
ঐতিহাসিক দিক থেকেও সীমান্তের সমস্যা দীর্ঘমেয়াদি। প্রাচীনকাল থেকে এই অঞ্চল কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ। মুজাহদিন যুদ্ধে, তালেবানের প্রথম শাসনামলে এবং আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের দখলদারিত্বের সময়ে সীমান্ত অঞ্চল সবসময় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। ১৯৯৬-২০০১ সালের মধ্যে পাকিস্তান তালেবানকে স্বীকৃতি দিয়েছিল এবং সেই সময়ও সীমান্তে রাজনৈতিক ও সামরিক উত্তেজনা বিদ্যমান ছিল। ২০২১ সালে তালেবান ক্ষমতায় ফেরার পর, পাকিস্তানের অভ্যন্তরে টিটিপির হামলা বৃদ্ধি পায়, যা সীমান্ত সংঘাতকে তীব্র করেছে।
সীমান্ত সংঘাতের অর্থনৈতিক প্রভাবও গুরুতর। সীমান্ত বন্ধ থাকায় বাণিজ্য স্থবির, বাজারে খাদ্য ও অন্যান্য জিনিসের দাম বৃদ্ধি, স্থানীয় ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত। সীমান্তবর্তী মানুষের জীবনযাত্রা বিপর্যস্ত। শরণার্থী সমস্যা তীব্র হয়েছে। পাকিস্তান থেকে বিতাড়িত আফগান শরণার্থীরা নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে পায় না। আন্তর্জাতিক সংস্থা ও মানবিক সহায়তা এই সংকট প্রশমিত করতে পারে।
সীমান্ত অঞ্চলের সামরিক বিশ্লেষণ দেখালে, পাকিস্তান বাহিনী তুলনামূলকভাবে বড়, আধুনিক ও স্থায়ী। তাদের কাছে প্রচলিত যুদ্ধের প্রযুক্তি রয়েছেÑ যেমন, ট্যাঙ্ক, বিমান, পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা এবং আধুনিক অস্ত্র। কিন্তু গেরিলা যুদ্ধের কারণে তারা সীমান্ত চৌকি হারাতে পারে। অন্যদিকে, তালেবান বাহিনী স্বল্পসংখ্যক, কিন্তু দ্রুত গতিতে হামলা চালাতে সক্ষম, যা প্রচলিত ও অপ্রচলিত যুদ্ধের মিশ্রণ তৈরি করে।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া গুরুত্বপূর্ণ। সৌদি আরব, কাতার, ইরান, চীন এবং রাশিয়া উভয়পক্ষকে সংযম বজায় রাখার আহ্বান জানিয়েছে। আফগান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভারতের সফরে শান্তিপূর্ণ সমাধানের ওপর জোর দিয়েছেন। পাকিস্তানও সীমান্তে উত্তেজনা প্রশমনের জন্য কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যেন দ্বিপক্ষীয় সমঝোতার মাধ্যমে উত্তেজনা প্রশমিত করতে পারে, তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সীমান্তে উত্তেজনা অব্যাহত থাকলে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক আরও খারাপ হতে পারে। তবে উভয়পক্ষই বড় ধরনের সংঘাতে জড়াতে চায় না, কারণ তারা ইতোমধ্যেই অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ও নিরাপত্তাগত সমস্যায় জর্জরিত। পাকিস্তান টিটিপির হামলার মোকাবিলায় লড়ছে, এবং আফগানিস্তানও তাদের ভূখ-ে তালেবান বাহিনীর কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায়। কূটনৈতিক প্রচেষ্টা এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যস্থতা ছাড়া এই সংকট সমাধান সম্ভব নয়।
পাকিস্তান-আফগান সীমান্ত সংঘাত কেবল সামরিক উত্তেজনার বিষয় নয়। এটি আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা, আন্তর্জাতিক কূটনীতি এবং মানবিক নিরাপত্তার জন্য বহুমাত্রিক সংকট। কূটনৈতিক প্রচেষ্টা, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং উভয় দেশের আন্তরিকতা ছাড়া এই সংকট সমাধান সম্ভব নয়। দক্ষিণ এশিয়ার শান্তি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে, উভয় দেশকে পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়নের দিকে মনোযোগী হতে হবে।
এসএম হাসানুজ্জামান, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও কলামিস্ট
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন