প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ রাষ্ট্র পরিচালনার গুরুত্বপূর্ণ কৌশল। বাংলাদেশে বিভাগভিত্তিক প্রশাসন ব্যবস্থা অত্যন্ত প্রাচীন হলেও সম্প্রতি নতুন একটি বিভাগ ঘোষণা নিয়ে জাতীয়ভাবে নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। কুমিল্লা নাকি নোয়াখালী? এই দ্বন্দ্বে আবদ্ধ হওয়ার আগে ভাবতে হবে, এই মুহূর্তে বিভাগ গঠন কতটা যৌক্তিক?
বাংলাদেশের এই মুহূর্তে বিভাগ ঘোষণা দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং দেশের সামগ্রিক নিরাপত্তার পক্ষে কতটুকু সহায়ক হবে বিশ্লেষণের দাবি রাখে।
বর্তমান বাংলাদেশের আয়তনে বৃহত্তম বিভাগ চট্টগ্রাম। ১১টি জেলা নিয়ে এই বিভাগ গঠিত। তিনটি ঐতিহাসিক অঞ্চল-বৃহত্তর চট্টগ্রাম, বৃহত্তর নোয়াখালী এবং বৃহত্তর কুমিল্লা নিয়ে গঠিত বিশাল প্রশাসনিক কার্যক্রম চালানো অত্যন্ত জটিল। কিন্তু দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতায় এই মুহূর্তে নতুন বিভাগ স্থাপনই কী এই জটিলতার সামাধান? নাকি অন্য কিছু?
নতুন বিভাগের ভৌগলিক সীমারেখা এবং নামকরণ নিয়ে নতুন করে মতবিরোধ দেখা দিয়েছে। কুমিল্লা ও নোয়াখালী দুই অঞ্চলের মানুষ স্ব স্ব অঞ্চল নিয়ে বিভাগ চায়। কুমিল্লা তার প্রাচীন ঐতিহ্য, ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্রস্থল হিসেবে অবস্থান, গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বিভাগীয় মর্যাদার দাবিদার। অন্যদিকে নোয়াখালী তার গৌরবময় ইতিহাস, স্বতন্ত্র ভাষা-সংস্কৃতি এবং দেশের জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার কারণে বিভাগীয় মর্যাদার দাবিকে জোরালো করছে।
রাজনৈতিকভ পর্যবেক্ষকদেরও দাবি, এই সময়ে নতুন বিভাগ ঘোষণা এই অঞ্চলের জনগণের মাঝে ফাটল সৃষ্টি করবে এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করবে। বিভাগীয় মর্যাদার দাবিতে দুই অঞ্চলের মানুষের মাঝে চরম অনৈক্য পরিলক্ষিত হচ্ছে। শুধু তাই নয়, রাজনৈতিক দলের নেতারা আঞ্চলিক স্বার্থ রক্ষায় বিভক্ত। বর্তমানে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন নিজ নিজ অঞ্চল নিয়ে বিভাগ ঘোষণার দাবিতে সরব রয়েছেন।
রাজনৈতিক দলের নেতারা বিভাগ ঘোষণার দাবিতে বিভিন্ন সভা-সমাবেশ আয়োজন করছে, যা দেশের সম্প্রীতি ও স্থিতিশীলতার জন্য হুমকিস্বরূপ। এহেন পরিস্থিতিতে দেশের অভ্যন্তরে অনৈক্য সৃষ্টি হলে সরকার বিরোধী বিভিন্ন দল ও প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী সরকারকে বেকায়দায় ফেলে ফায়দা লুটবে। আমরা ইতোপূর্বে দেখেছি, বিগত সরকার জনমতকে উপেক্ষা করে এবং বাস্তবতার বিপরীতে গিয়ে ‘মেঘনা’ নামে একটি বিভাগ ঘোষণা করেছিল, ফলে জনগণের মাঝে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। পরবর্তীতে যদিও তা আর আলোর মুখ দেখেনি।
একটি বিভাগ প্রতিষ্ঠা শুধু নামকরণের বিষয় নয়, বরং এর সাথে নানান বিষয় জড়িত। কোটি কোটি টাকা ব্যয়, নতুন অবকাঠামো নির্মাণ এবং জনবল নিয়োগের মতো নানান চ্যালেঞ্জ রয়েছে। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা, দেশীয় অর্থনীতির স্থবিরতা এবং বিগত সরকারের রেখে যাওয়া ঋণের ভারে সরকার বহুমাত্রিক চাপে রয়েছেন। দেশের অর্থনীতির এমন নাজুক পরিস্থিতিতে নতুন বিভাগ বাস্তবায়ন কতটা সহজতর হবে?
ভৌগোলিক-রাজনৈতিক দৃষ্টিতে গভীর পর্যবেক্ষণ করলে আরও ভিন্ন একটা সমস্যা সামনে এসে দাড়ায়। কৌশলগত অবস্থানে বাংলাদেশের ‘চিকেন নেক’ খ্যাত ফেনী জেলা দেশের নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন পাহাড়ি সশস্ত্র গোষ্ঠীর তৎপরতা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও সার্বিক নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ। তাছাড়া, ফেনী জেলার সাধারণ মানুষ নতুন বিভাগে যুক্ত হতে চায় না বলে মতামত জানাচ্ছেন। ফেনী জেলাকে চট্টগ্রাম বিভাগ থেকে আলাদা করা কী দেশের নিরাপত্তার ঝুঁকি তৈরি করবে না?
শুধুই এখনই কী নতুন বিভাগ বাস্তবায়নই কী সমাধান? সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় বলা যায়, শুধু নতুন বিভাগ স্থাপনই সমাধান নয়। প্রয়োজনে মাঠ প্রশাসনের দক্ষতা বৃদ্ধিতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ জনবল তৈরি করতে হবে।
প্রশাসনিক সংস্কার সময়ের দাবি। যেকোনো সংস্কার নতুনত্ব নিয়ে আসে। কিন্তু এই মুহূর্তে নতুন বিভাগ ঘোষণা কতটুকু সময়োপযোগী? যেকোনো সংস্কার হওয়া উচিত সুপরিকল্পিত। বিভাগীয় সংস্কারের আগে বিবেচনা করা উচিত আমাদের অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা, রাজনৈতিক বন্দোবস্ত, নিরাপত্তা ঝুঁকি এবং সামাজিক প্রভাব।
দেশের রাজনৈতিক ঐক্যমত্য ছাড়া নতুন প্রশাসনিক কাঠামো স্থাপন করা অর্বাচীন সিদ্ধান্ত হতে পারে। আর্থিক সামর্থ্যের প্রতি খেয়াল রেখে জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে নতুন বিভাগ বাস্তবায়নের পরিকল্পনা করতে হবে। সর্বোপরি, জাতীয় সংহতি, অর্থনৈতিক বাস্তবতা,দেশের নিরাপাত্তা ও স্থিতিশীলতার প্রতি দৃষ্টি রেখেই নতুন বিভাগ বাস্তবায়ন করা উচিত।
লেখক: প্রভাষক, জয়পুরা এস এ এম এস স্কুল এন্ড কলেজ, রামগঞ্জ, লক্ষীপুর।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন