বৃহস্পতিবার, ০৯ অক্টোবর, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


মোস্তফা কামাল

প্রকাশিত: অক্টোবর ৯, ২০২৫, ১২:০৫ এএম

বেখবরে কেন সীমান্তের অতন্দ্র প্রহরীদের খবর?

মোস্তফা কামাল

প্রকাশিত: অক্টোবর ৯, ২০২৫, ১২:০৫ এএম

ছবি- রূপালী বাংলাদেশ

ছবি- রূপালী বাংলাদেশ

গত বছরের ৫ জুন থেকে নিখোঁজ ছিলেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলার বেগপুর গ্রামের আমীর আলীর ছেলে জাকির হোসেন। জীবিত না মৃত কিছুই জানা ছিল না স্বজনদের। ১৫ মাস পর গেল সপ্তাহে খোঁজ মিলেছে তার। চাঁপাইনবাবগঞ্জের সীমান্ত দিয়ে বিজিবির হাতে জাকিরকে ফেরত দিয়েছে বিএসএফ। গণমাধ্যম তেমন পিক করেনি সংবাদটিকে। তালাশ করেনি কিভাবে বিজিবি সাধন করলো কাজটি?

বিজিবি চাইলো আর তাকে দিয়ে দিল ভারত? অথবা বিজিবি ভারতে গিয়ে তাকে নিয়ে এসেছে? ঘটনা মোটেই তেমন নয়। যুবক জাকির একজন প্রতিবন্ধি। পারিবারিক কলহে মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েন তিনি। পরে অসুস্থ অবস্থায় গত বছরের ৫ জুন কাউকে না জানিয়ে ভারতে চলে যান। এরপর থেকে তিনি নিখোঁজ। বিজিবি নিজস্ব সোর্সে ঘটনা জেনে যোগাযোগ করে বৈষ্ণবপুর পুলিশ ও বিএসএফের সঙ্গে। একটি পতাকা বৈঠকও করে। এর সুবাদে পরে বিএসএফ ও বৈষ্ণবপুর পুলিশ এবং বাংলাদেশের বিজিবি ও শিবগঞ্জ থানা পুলিশের কাছে তাকে হস্তান্তর করা হয় জাকিরকে। বিজিবির কাজের এটি একটি উদাহরণ মাত্র। তাদের কাজের ধরন এমনই। যার বেশিরভাগই পড়ে থাকে বেখবরে। এতে অনেকটা অভ্যস্তও হয়ে গেছে সীমান্তের এই অতন্দ্র প্রহরীরা।

তারা আসলে কেবলই সীমান্তের বাহিনী নয়। কাজের পরিধি বিস্তর। বাহিনীটি পথচলায় শুধু ইতিহাস নয়, গর্বের প্রতীকও। সীমান্ত নিরাপত্তা ও জাতীয় আস্থার প্রতীক হিসেবে ৩৩৬৫ দিনের প্রতিটি দিন, ঘণ্টাই তাদের কাজ করতে হয়। রোদ-বৃষ্টি-ঝড়েও দুর্গম সীমান্ত এলাকায় দিনরাত টহল দেওয়া, অবৈধ বালু-পাথর উত্তোলন বন্ধ করা, এবং বন্যা বা অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে ত্রাণ ও চিকিৎসা সহায়তা দিয়ে অভ্যস্ত তারা। সাম্প্রতিক সময়ে বাহিনীটির কিছু কর্মযজ্ঞ তাদের নিজস্ব খাতাপত্রেই পড়ে আছে। গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, সংবাদ বা খবরের তালিকায় আসেনি।  বৃহত্তর সিলেটের কয়েকটি স্পটে পাথরকাণ্ডের খবর মাসখানেক আগে টক অব দ্য কান্ট্রি হলেও জৈন্তাপুর ও লালাখাল এলাকায় জাতীয় সম্পদ বালু ও পাথরের অবাধ লুটপাট বন্ধে বিজিবির  কঠোর অবস্থানের খবর বলতে গেলে বেখবরেই পড়ে থাকছে।

তাদের নিয়মিত টহল ও বিশেষ অভিযানের কারণেই ওই এলাকায় অবৈধ বালি-পাথর উত্তোলনকারীচক্র সুবিধা করতে পারছে না। বিজিবির উপস্থিতির ফলে সীমান্তঘেঁষা এসব প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত স্পট এখনও পর্যটকদের জন্য সুরক্ষিত রয়েছে। ভোলাগঞ্জ সাদাপাথর, জাফলং, বিছানাকান্দি ও জৈন্তাপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় শূন্যরেখা থেকে আনুমানিক ৩০০ গজ পর্যন্ত এখনও বিপুল পরিমাণ পাথর অক্ষত আছে বিজিবির নজরদারির সুবাদে।  লালাখাল এলাকায় বিজিবির জোর টহল থাকায় আসন্ন শীত মৌসুমেও পর্যটকদের নিশ্চিন্তে সেখানে ভ্রমণের উপযুক্ততা বিদ্যমান। স্থানীয় বিভিন্ন সূত্র জানায়, গত চার-পাঁচ মাসেই বিজিবি প্রায় ছয়শ অবৈধ বালু-পাথরবাহী নৌকা আটক করেছে। শুধু লালাখাল নয়, ভোলাগঞ্জ সাদাপাথর অঞ্চল থেকেও অসংখ্য নৌকা জব্দ করা হয়েছে। এসব অভিযানে গভীর রাতে কাজ করতে গিয়ে বিজিবির কয়েক সদস্য আহতও হয়েছে।

মাদক ও অস্ত্র চোরাচালান, মানবপাচার, অবৈধ পণ্য প্রবাহ এবং পুশ-ইন প্রতিরোধে বিজিবি কাজ করছে ঘটা করে নয়, নিয়মিত কাজের মতো করে। ১০ সেপ্টেম্বর উখিয়ায় ২ লাখ ৮০ হাজার ইয়াবা উদ্ধারের ঘটনা বেশ ইন্টারেস্টিং। রাত প্রায় সাড়ে ৯টার দিকে মিয়ানমার দিক থেকে ১০-১২ জন সন্দেহভাজন ব্যক্তি বাংলাদেশের ভেতরে প্রবেশ করলে বিজিবি সদস্যরা তাদের চ্যালেঞ্জ করে। টহল দলের মাত্র চার সদস্য সাহসিকতার সঙ্গে চোরাকারবারিদের প্রতিহত করার চেষ্টা করেন। এ সময় ৬-৭ জন চিহ্নিত চোরাকারবারি দেশীয় অস্ত্র ও লাঠিসোঁটা নিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঢোকার চেষ্টা করলে বিজিবি সদস্যদের সঙ্গে ধস্তাধস্তি হয়। পরে বিজিবির উপস্থিতি টের পেয়ে চোরাকারবারিরা খালে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাঁতরে মিয়ানমারের দিকে পালিয়ে যায়। কক্সবাজার রিজিয়নের রামু সেক্টরের অধীনস্থ উখিয়া ব্যাটালিয়ন (৬৪ বিজিবি) প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই সীমান্ত সুরক্ষা, মাদক দমন ও অবৈধ চোরাচালান প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে।

কক্সবাজার ও বান্দরবান সীমান্তে বিজিবির কাজের পরিধি অনেকের ধারনার বাইরে। বাংলাদেশের ২৭১ কিলোমিটার  সীমান্ত দিয়ে মিয়ানমার থেকে ইয়াবা, আইসের (ক্রিস্টাল মেথ) মতো মাদক পাচার বন্ধ করা বড় কঠিন কাজ। এর মাঝেও গত এক বছরে সীমান্ত এলাকায় বিজিবি ১ হাজার ৩২১ কোটি টাকার মাদক জব্দ করেছে। ধ্বংস করা মাদকের মধ্যে রয়েছে কোটি কোটি পিস ইয়াবা, আইস, বিয়ার ক্যান,  বিদেশি মদ, হেরোইন, ফেনসিডিল, কমান্ডো এনার্জি ড্রিংক, কোকেন,  হুইস্কি, আফিম ইত্যাদি।

কক্সবাজার রিজিয়নের দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্ত অত্যন্ত স্পর্শকাতর এলাকা। সেখানকার বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে মাদক অনুপ্রবেশ প্রতিরোধে জীবনবাজি রেখে কাজ করতে হয় সীমান্তের এই অতন্দ্র প্রহরীদের। কেবল সীমান্ত পাহারায় নয়, গত ১৪ জুলাই হতে ৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কক্সবাজার রিজিয়নে মাদক ও চোরাচালান প্রতিরোধের চিত্রের দিকে চোখ ফেললে সহজেই বোধগম্য বাহিনীটির কাজের ভলিউম। মাকবিরোধী কার্যক্রমের অংশ হিসেবে নিয়মিত কার্যক্রমের পাশাপাশি এ সময়ে অন্তত ১৪ টি বিশেষ অভিযান পরিচালনা করেছে।

অভিযানের অংশ হিসেবে ওই এলাকায় সিজার মূল্যে প্রায় ৭০ কোটি টাকার ইয়াবা, ক্রিস্টাল মেথ আইস, বিয়ার,  গাঁজাসহ বিভিন্ন মাদক উদ্ধার করেছে বিজিবি। ১৭০ জন আসামি ধরেছে। এ ছাড়া অভিযানগুলোতে দেশি-বিদেশি অস্ত্র গুলি, গোলাবারুদ জব্দের সংখ্যাও অনেক। সেইসাথে চালাতে হয় জনমত তৈরি ও জনসচেতনতার ক্যাম্পেইন। সীমান্তবর্তী এলাকার জনসাধারণকে মাদক ও চোরাচালানের কুফলের ওপর প্রেষণামূলক ১৭৪টি সভা করেছে।

দেশের কোনো সীমানা বা প্রান্তরকেই অরক্ষিত রাখছে না বিজিবি। শেরপুরের শ্রীবরদী উপজেলার সীমান্তবর্তী কর্ণঝোড়া রাবার বাগান এলাকাও তাদের নজরের বাইরে নয়। গেল ৪ সেপ্টেম্বর রাতে বিজিবি সেখানে অভিযানে গেলে কারো কারো ধন্দ লাগে, এখানে আবার কী? সেখান থেকে ভারতীয়  জিলেট ব্লেডের বিশাল এক চালান ধরে ফেলে বিজিবি সদস্যরা। গেল সপ্তায় উত্তরের কুড়িগ্রাম সীমান্তে ৭ দিনের অভিযানে জব্দ করেছে ২ কোটি ১১ লাখ টাকার মাদকসহ অবৈধ মালামাল। পহেলা সেপ্টেম্বর থেকে ৭ সেপ্টম্বর পর্যন্ত চলা অভিযানটিতে কয়েকজন মাদক কারবারীকেও ধরা হয়েছে।

জব্দকৃত পণ্যের মধ্যে রয়েছে ভারতীয় ১২৫টি গরু- মহিষ, ৬৩৫ বোতল মদ ছাড়াও ১৪৫ কেজি গাঁজা, ৭৭২ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট, ইত্যাদি। ভারত থেকে কেবল অবৈধপথে পণ্য দেশে আনা হয় না। ভারতেও পাচার হয়। এ কাজে খাগড়াছড়ির পানছড়ি উপজেলায় সীমান্ত ঘেঁষা দুর্গম পাহাড়ি এলাকা অনেক দিন থেকে আলোচিত। ৭ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যার দিকে গিলাতলী বিওপি সীমান্তবর্তী আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথে চালায় এক অভিযান। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে ওই অভিযানে জব্দ করা হয় সিস্টেম প্লাস বোতল ও জারিজেন, হক শাহাজাদি জর্দা, স্প্রে মেশিন, রসুন, জামা-কাপড়, জুতা, চেপা শুটকি, প্রাণ লাচ্চি, কৃষি ও পশুচিকিৎসা সামগ্রীসহ আরও বিভিন্ন পণ্য। শেরপুরের শ্রীবরদী ও ঝিনাইগাতী উপজেলা উপজেলাধীন গারো পাহাড়ি সীমান্ত এলাকায় অভিযানে জব্দ করা হয়েছে নানা মালামাল। ময়মনসিংহ ব্যাটালিয়ন ৩৯ বিজিবির দায়িত্বপূর্ণ সীমান্তবর্তী এলাকা দিয়ে চোরাকারবারিরা অভিনব পন্থায় ভারতীয় শাড়ি, জিলেট ব্লেড, জনসন বেবি শ্যাম্পু ও মাদকদ্রব্য পাচারের চেষ্টা করে। বিজিবির বিশেষ অভিযানে ওই সীমান্ত এলাকা হতে ১০০ পিস ভারতীয় শাড়ি, ১ লাখ ২ হাজার পিস জিলেট ব্লেড, ২৫৮ পিস জনসন বেবি শ্যাম্পু এবং ৩৫ বোতল ভারতীয় মদ জব্দ করেছে।

বিজিবির সাম্প্রতিক ছোট-বড় অভিযানগুলোতে ব্যাপক সাফল্যের অনেক খবরই গণমাধ্যমে আসছে না। গেল  আগস্ট মাসে পরিচালিত বিভিন্ন অভিযানে মোট ১৭৭ কোটি ২১ লাখ টাকার চোরাচালান পণ্য ও মাদকদ্রব্য জব্দ করেছে বাহিনীটি। এ বাহিনীর সদস্যদের মাঝেও খবরের খবরের প্রকাশ বা জানান দেয়ার তেমন অপেক্ষা থাকে না। নিয়মিত রুটিন কাজ হিসেবেই তারা রত থাকছে অতন্দ্র প্রহরী হয়ে। কাজের পরিধি বিবেচনায় দূর সীমান্তে থাকায় তাদের কর্মতৎপরতা থেকে যায় আড়ালে, গণমাধ্যমের শিরোনামের বাইরে। অথচ কেবল সীমান্ত সুরক্ষা নয়, অবৈধ অনুপ্রবেশ, মাদক, চোরাচালান রোখার বাইরেও তাদের কাজের  ভলিউম বেশ মোটা। অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন বন্ধ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা, জাতীয় সম্পদ রক্ষা, সীমান্তের দুর্গম এলাকার পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর পাশে দাঁড়িয়ে চিকিৎসা সেবা, ত্রাণ বিতরণসহ জনকল্যাণমূলক অনেক কার্যক্রম তাদের নিয়মিত কাজ। মাঝেমধ্যে সীমান্তে কিছু চোরাই মাল উদ্ধার, জব্দ, পুড়িয়ে ফেলার মাঝেই থাকছে তাদের খবরগুলো। দু’শ বছরেরও বেশি সমৃদ্ধ ইতিহাস ও গৌরবান্বিত ঐতিহ্যবাহী বাহিনীটির যাত্রা শুরু ১৭৯৫ সালের ২৯ জুন 'রামগড় লোকাল ব্যাটালিয়ন' নামে। প্রতিষ্ঠার পর সুদীর্ঘ পথ পরিক্রমায় ফ্রন্টিয়ার গার্ডস, বেঙ্গল মিলিটারি পুলিশ, ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রাইফেলস, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস-ইপিআর,, বাংলাদেশ রাইফেলস -বিডিআর এবং সর্বশেষ বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-বিজিবি নামে চলছে বাহিনীটির  দায়িত্ব-কর্তব্য। দায়িত্ব প্রশ্নে ব্যাপকতা ও কর্মকুশলতার বহুমাত্রিকতায় এই উপমহাদেশের ইতিহাসে একটি গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ে বাহিনীটি।

লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন   

Link copied!