বাংলাদেশ একটি স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্র। এ দেশের প্রতিটি জেলা, প্রতিটি অঞ্চল সমানভাবে রাষ্ট্রের অংশ। পাহাড়ি অঞ্চল খাগড়াছড়িও তার ব্যতিক্রম নয়। অথচ সাম্প্রতিক সহিংসতায় আমরা দেখেছি যেন ভিন্ন চিত্র- যেখানে রাষ্ট্রের নিরাপত্তাবাহিনীর ওপর পর্যন্ত আঘাত হানা হয়েছে। একটি ধর্ষণের অভিযোগকে কেন্দ্র করে যে সহিংসতা হয়েছে, তা শুধু স্থানীয় অস্থিরতা নয়; বরং জাতীয় নিরাপত্তার জন্যও উদ্বেগজনক বার্তা বহন করছে।
ঘটনাটির সূত্রপাত সপ্তম শ্রেণির এক কিশোরীর ধর্ষণ অভিযোগকে ঘিরে। এমন একটি জঘন্য অপরাধ আমাদের সমাজে কখনোই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এর মধ্যে মেডিকেল রিপোর্ট এসেছে- মেয়েটি ধর্ষণের শিকার হয়নি।
ধর্ষণ একটি ভয়ানক অপরাধ এবং অপরাধীকে অবশ্যই আইনের আওতায় আনা দরকার। এর মধ্যে অভিযুক্ত শয়ন শীলকে আটক করা হয়েছে, যা প্রমাণ করে রাষ্ট্র ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ঘটনাটিকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো, আইনের প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার আগেই পাহাড়ি কিছু গোষ্ঠী সহিংস আন্দোলনের পথে নেমেছে। এই সহিংসতায় তিনজন নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন অনেকে। এমনকি সেনাবাহিনীর সদস্যদের ওপরও আক্রমণ হয়েছে, একজন মেজর গুরুতর আহত হয়েছেন। এ ধরনের পরিস্থিতি শুধু দুঃখজনক নয়, রাষ্ট্রের জন্য লজ্জাজনকও বটে।
প্রশ্ন জাগে- কেন এমন পরিস্থিতি তৈরি হলো? ধর্ষণের মতো অপরাধে আইন তার নিজস্ব পথে চলুক, নিজস্ব গতিতে চলুক- এমনটাই স্বাভাবিক দাবি হওয়ার কথা। কিন্তু তার পরিবর্তে অস্ত্রধারী গোষ্ঠীগুলো কেন সেনাবাহিনীকে পর্যন্ত আক্রমণ করল? এখানে দুটি দিক স্পষ্ট।
প্রথমত, পাহাড়ি অঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে কিছু গোষ্ঠী নিজেদের স্বার্থে সাধারণ মানুষকে ব্যবহার করছে। তারা প্রায়ই বিচ্ছিন্নতাবাদী মানসিকতা লালন করে।
দ্বিতীয়ত, প্রতিবেশী দেশের হস্তক্ষেপের অভিযোগ একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না। গত বছরের জুলাই আন্দোলন সফল হবার পর বহুবারই গোয়েন্দা তথ্য উঠে এসেছে যে, ভারতীয় সীমান্ত ঘেঁষা এলাকায় কিছু সংগঠন অস্ত্র ও অর্থের জোগান পাচ্ছে বাইরের সূত্র থেকে। এর উদ্দেশ্য একটাই- বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করা।
তর্কের খাতিরে যদি ধরে নিই, ধর্ষণের অভিযোগটি বাস্তব তাহলেও তো বলতে হবে- সহিংসতা দিয়ে সেই অপরাধের সমাধান করা যায় না। ধর্ষণের শিকার মেয়েটিকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা যাবে না, সহিংসতা দিয়ে কোনোভাবেই শান্তি কিংবা বিচার নিশ্চিত করা যাবে না। বরং বিচারের মাধ্যমে অপরাধীকে শাস্তি দেয়া এবং ভুক্তভোগীর পরিবারকে ন্যায়বিচার দেয়া-এটাই মূল পথ। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই। পাহাড়ি উপজাতিদের উচিত ছিল রাষ্ট্র ও আইনি প্রক্রিয়ার প্রতি আস্থা রাখা, ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করা। অপরাধীকে গ্রেপ্তারের পর তার বিচার প্রক্রিয়া শুরুর মধ্যেই প্রমাণ মেলে যে, আইন তার পথেই চলছে।
কিন্তু সশস্ত্র আন্দোলন ও সহিংসতার মাধ্যমে তারা আসলে নিজেদের দাবি দুর্বল করেছে। রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ড কখনোই কোনো জাতিগোষ্ঠীর ন্যায়সঙ্গত অধিকার প্রতিষ্ঠার পথ নয়। বরং এতে সাধারণ পাহাড়ি মানুষ আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাদের জীবনে অশান্তি নেমে আসে। তিনজনের মৃত্যু, অসংখ্য আহত মানুষের আর্তনাদ-এসবের দায় কে নেবে?
এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা জরুরি। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী শুধুমাত্র সীমান্ত পাহারা দেয় না, তারা দেশের ভেতরে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কার্যক্রমেও অংশ নেয়। পাহাড়ি অঞ্চলে সড়ক নির্মাণ থেকে শুরু করে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও ত্রাণ কার্যক্রমে সেনাবাহিনীর অবদান অপরিসীম। সেই সেনাবাহিনীর ওপর হামলা মানে শুধু একটি প্রতিষ্ঠানের ওপর নয়, পুরো রাষ্ট্রের ওপর হামলা। এটা কখনোই মেনে নেয়া যায় না।
এই ঘটনায় রাষ্ট্রের ভূমিকা হতে হবে দৃঢ় ও কার্যকর। একদিকে ধর্ষণ মামলার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের নিশ্চয়তা দিতে হবে, অন্যদিকে সহিংসতার নেপথ্যে যারা আছে তাদের কঠোরভাবে দমন করতে হবে। রাষ্ট্রকে স্পষ্ট বার্তা দিতে হবে- আইনের ঊর্ধ্বে কেউ নয়, আবার আইন হাতে তুলে নেয়ার সুযোগও নেই।
একইসঙ্গে আমাদের মনে রাখতে হবে, পার্বত্যাঞ্চলের মানুষও বাংলাদেশেরই নাগরিক। তাদের উন্নয়ন, নিরাপত্তা, অধিকার- সবকিছুই রাষ্ট্রের দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত। তাই একদিকে যেমন বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলোকে দমন করতে হবে, অন্যদিকে পাহাড়ি সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জন করতেও হবে। উন্নয়ন, শিক্ষা, কর্মসংস্থান-এসবের মাধ্যমে রাষ্ট্রকে পার্বত্যাঞ্চলে বসবাসকারী জাতিগোষ্ঠীগুলোকে বোঝাতে হবে যে, পাহাড়ি জনগণ আলাদা নয়, বরং বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এখানে নিশ্চিতভাবে বলা যায়- সরকার সেভাবেই কাজ করছে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, সাম্প্রতিক ঘটনার নেপথ্যে যদি কোনো আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র থেকে থাকে, তবে তা উন্মোচন করতে হবে। প্রতিবেশী দেশ যদি বাংলাদেশের ভেতরে অস্থিতিশীলতা তৈরির চেষ্টা করে, তবে তা কূটনৈতিকভাবে মোকাবিলা করতে হবে। একটি স্বাধীন দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বাইরের হস্তক্ষেপ কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়, হতে পারে না।
সর্বোপরি, খাগড়াছড়ির এই ঘটনার শিক্ষা আমাদের স্পষ্ট করে দেয়- অপরাধের বিচার আদালতে হবে, রাস্তায় নয়। সহিংসতা সমাধান নয়, বরং সমস্যা আরও বাড়ায়। পাহাড়ি হোক বা সমতলের মানুষ, আইন সবার জন্য সমান। রাষ্ট্রের প্রতি আস্থা রেখেই চলতে হবে। আইনের শাসনের প্রতি সবাইকে শ্রদ্ধাশীল হতে হবে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন সহজ হয়নি। অসংখ্য প্রাণের বিনিময়ে আমরা এই দেশ পেয়েছি। তাই কোনো গোষ্ঠী বা কোনো বাহ্যিক শক্তি যেন এই দেশের শান্তিকে অশান্তিতে পরিণত করতে না পারে- সে বিষয়ে সবাইকে সজাগ থাকতে হবে। খাগড়াছড়ির রক্তাক্ত ঘটনাই আমাদের নতুন করে মনে করিয়ে দেয়, এই দেশকে শান্তিপূর্ণ রাখতে হলে আইনের শাসনকে সর্বোচ্চ জায়গায় রাখতে হবে, আবেগ নয়, যুক্তি দিয়েই পথ চলতে হবে।
উপজাতি জনগোষ্ঠীকে মনে রাখতে হবে- তারা বিচ্ছিন্ন কোনো ভূখণ্ডের অধিবাসী নয়, তারা এই দেশেরই জনগণের অংশ, এই ভূখণ্ডের মানুষ। তারা কোনোভাবেই সেনাবাহিনী বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর হামলা করতে পারে না, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তারা অস্ত্র ধরতে পারে না। প্রতিবেশী দেশকেও মনে রাখতে হবে- তার প্রতিবেশীর সঙ্গে সুন্দর ব্যবহারের আলাদা গুরুত্ব আছে। আপনার ব্যবহার প্রতিবেশীর আচরণে প্রভাব ফেলে। আপনি যদি খারাপ আচরণ করেন, তবে প্রতিবেশীও তেমন আচরণ করবেন, এর ব্যত্যয় ঘটবে না।
লেখক- সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন