মঙ্গলবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


মো. গালিব হোসেন

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২৩, ২০২৫, ০৮:৩৭ পিএম

শিক্ষার সংকোচন নয়, উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার সুযোগ বৃদ্ধি জরুরি

মো. গালিব হোসেন

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২৩, ২০২৫, ০৮:৩৭ পিএম

ছবি- রূপালী বাংলাদেশ গ্রাফিক্স

ছবি- রূপালী বাংলাদেশ গ্রাফিক্স

বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থায় বর্তমানে গবেষণা ঘাটতি, শিক্ষক প্রশিক্ষণের অভাব এবং কলেজ শিক্ষার মানগত সীমাবদ্ধতা অনস্বীকার্য। দেশের উচ্চ শিক্ষায় সরকারি কলেজগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও এগুলোর মানোন্নয়নে কার্যকর ভূমিকা চোখে পড়েনি।সরকারি কলেজগুলোর মধ্যে রাজধানী ঢাকায় অবস্থিত সাতটি কলেজে দেড় লক্ষাধিক শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছে। অবস্থানগত কারণে ভর্তিচ্ছুদের কাছে এই সাতটি সরকারি কলেজের অবস্থান বিগত দুই দশকে প্রতিষ্ঠিত নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চেয়ে সামনের সারিতেই থাকে।

২০১৭ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর একক সিদ্ধান্তে কলেজগুলোকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভূক্ত করা হলেও এই কলেজগুলোর মানোন্নয়নে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কার্যকর দায়িত্বপালনে অনেকটাই ব্যর্থ হয়েছে।

জুলাই অভ্যুত্থান পরবর্তী নতুন বাংলাদেশে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কলেজগুলোর অধিভূক্তি বাতিলের সিদ্ধান্ত নিলে নতুন একটি এফিলিয়েটিং বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা অত্যাবশ্যকীয় হয়ে পড়ে, যদিও সরকারি তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরা তাদের জন্য বরাবরই একটি স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি করে আসছে।

এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য প্রয়োজন একটি নতুন মডেলের বিশ্ববিদ্যালয়, যা একদিকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শিক্ষায় মানোন্নয়ন ঘটাবে, অন্যদিকে গবেষণা ও শিক্ষক প্রশিক্ষণে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে। এ প্রেক্ষাপটে প্রস্তাবিত ঢাকা সেন্ট্রাল বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে উঠতে পারে উচ্চশিক্ষা সম্প্রসারণের নতুন দুয়ার।

সম্প্রতি সংবাদপত্র ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা সংক্রান্ত যেসকল তথ্য ভেসে আসছে তাতে শিক্ষক, বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থী, কলেজগুলোর উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের মধ্যে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা বৃদ্ধি করছে।

ঐতিহ্যবাহী দুটি নারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সাতটি কলেজের গৌরবপূর্ণ ইতিহাস ধারণ না করে কতিপয় সুবিধালোভী ব্যক্তির প্ররোচনায় অত্যন্ত গোপনীয়তার সাথে অধ্যাদেশ তৈরির যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে তা কোনোক্রমেই এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের অংশীজনদের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। সরকারি সাত কলেজ পরিচালনার জন্য প্রস্তাবিত ঢাকা সেন্ট্রাল বিশ্ববিদ্যালয় যেভাবে উচ্চ শিক্ষা ও গবেষণার কেন্দ্রে পরিণত করা যায় তার একটি রূপরেখা পাঠকদের জন্য উপস্থাপন করা হলো।

কাঠামো ও প্রশাসন

প্রস্তাবিত ঢাকা সেন্ট্রাল বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি নিজস্ব ক্যাম্পাস থাকবে এবং সাতটি সরকারি কলেজ তথা ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, সরকারি তিতুমীর কলেজ, সরকারি বাংলা কলেজ, বেগম বদরুন্নেছা সরকারি মহিলা কলেজ, কবি নজরুল সরকারি কলেজ এবং শহীদ সোহরাওয়ার্দী সরকারি কলেজ অধিভুক্ত থাকবে। সরকারি-বেসরকারি বৈষম্য দূর করতে ঢাকা শহরের আরও তিনটি বড় স্নাতক পাঠদানকারী বেসরকারি কলেজকেও অধিভূক্তির জন্য বিবেচনা করা যেতে পারে।

মূল ক্যাম্পাসে উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, রেজিস্ট্রার, ট্রেজারার, প্রক্টর ও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় থাকবে। বিভিন্ন বিষয়ের শিক্ষকবৃন্দ যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব জনশক্তি হিসেবে বিবেচিত হবেন তারাও মূল ক্যাম্পাসের অংশীজন হবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষক পিএইচডি ডিগ্রিধারী হবেন এবং তারা সরাসরি সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করবেন।

নতুন বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে প্রভাষক নিয়োগ প্রক্রিয়া আমাদের দেশে ভালো উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারেনি বলেই এই প্রস্তাবনা। এতে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন পিএইচডি ডিগ্রিধারী শিক্ষক ও গবেষকগণ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় আগ্রহী হবেন।

কলেজগুলোর প্রতিটি বিভাগে অধ্যক্ষের নিয়ন্ত্রণে কমপক্ষে ১৬ জন শিক্ষক পদায়ন নিশ্চিত করতে হবে, যাতে শিক্ষার মান সুনিশ্চিত হয়। বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার থেকে অপেক্ষাকৃত যোগ্য এবং উচ্চতর ডিগ্রিধারীগণকে এসব কলেজে পদায়নে অগ্রাধিকার দেওয়া যেতে পারে।

বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের কর্মচারীগণ বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব কর্মচারী এবং কলেজ ক্যাম্পাসসমূহের কর্মচারীগণ মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের আওতাভুক্ত কলেজের কর্মচারী হিসেবে বিবেচিত হবেন।

অ্যাকাডেমিক কাঠামো

প্রস্তাবিত ঢাকা সেন্ট্রাল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক সম্মান, স্নাতকোত্তর, এমফিল ও পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনের সুযোগ থাকবে।

স্নাতক (Undergraduate) পর্যায়:

কলেজ পর্যায়ে স্নাতক সম্মান (আন্ডারগ্রেড) শিক্ষা পরিচালিত হবে। বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারভুক্ত কলেজ শিক্ষকগণ এই কোর্সগুলো পরিচালনা করবেন। কলেজগুলোতে পূর্বের ন্যায় উচ্চমাধ্যমিক পাঠদানও অব্যাহত থাকবে।

স্নাতকোত্তর (Postgraduate) পর্যায়:

স্নাতকোত্তর পর্যায়ে পাঠদানের জন্য শিক্ষার্থীদের সামনে দুটি অপশন থাকবে:

১. কোর্স-বেজ মাস্টার্স (Course-based Masters): অধিকাংশ শিক্ষার্থী কলেজেই কোর্সভিত্তিক মাস্টার্স কোর্স সম্পন্ন করবে। বিশেষ করে যারা সরকারি বা প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে দাপ্তরিক কাজে ক্যারিয়ার গড়তে আগ্রহী তারা কলেজেই একবছর মেয়াদী মাস্টার্স কোর্স সম্পন্ন করবে।

২. রিসার্চ-বেজ মাস্টার্স (Research based Masters): যেসব শিক্ষার্থী স্নাতকে অধিকতর ভালো ফল অর্জন করবে এবং গবেষণা ও শিক্ষকতায় পেশা গড়তে আগ্রহী তাদের মধ্য হতে যোগ্যতা ও আগ্রহের ভিত্তিতে মূল ক্যাম্পাসে গবেষণাভিত্তিক মাস্টার্স কোর্স করার সুযোগ থাকবে।

এখানে থাকবে মাল্টি-ডিসিপ্লিনারি মাস্টার্স প্রোগ্রাম যেমন: পাবলিক হেলথ, ডেটা সায়েন্স, সাইবার সিকিউরিটি, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স, বিজনেজ এনালিটিক্স, উন্নয়ন অর্থনীতি ইত্যাদি। প্রতিটি পর্যায়ে গবেষণার জন্য পর্যাপ্ত ফেলোশিপ নিশ্চিত করতে হবে, যাতে মেধাবী শিক্ষার্থীরা আর্থিক সচ্ছলতায় পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারে।

এমফিল ও পিএইচডি প্রোগ্রাম:

মূল ক্যাম্পাসে এমফিল ও পিএইচডি প্রোগ্রাম পরিচালিত হবে। মূল ক্যাম্পাসের শিক্ষকগণ গবেষণা পরিচালনা করবেন এবং এমফিল ও পিএইচডি শিক্ষার্থীদের সুপারভিশন করবেন। প্রত্যেক গবেষকের জন্য ফেলোশিপ প্রদান নিশ্চিত করতে হবে।

শিক্ষক প্রশিক্ষণ ও উন্নয়ন:

বাংলাদেশে কলেজ পর্যায়ে উচ্চশিক্ষার বড় অন্তরায় শিক্ষকদের জন্য বিষয়ভিত্তিক পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ ও নলেজ শেয়ারিংয়ের ব্যবস্থা না করা। প্রস্তাবিত ঢাকা সেন্ট্রাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ শুধু মাস্টার্স ও পিএইচডি কোর্স পরিচালনা করবেন না, বরং কলেজ শিক্ষকদের জন্য নিয়মিত বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ কর্মশালা আয়োজন করবেন। কলেজ শিক্ষকদের গবেষণা দক্ষতা বৃদ্ধিতেও পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে, ফলে কলেজ শিক্ষার মান শুধু ঢাকায় নয়, সারা দেশে উন্নত করা সম্ভব হবে।

প্রত্যাশিত সুফল

  • গবেষণাভিত্তিক স্নাতকোত্তর শিক্ষাযোগ্য শিক্ষার্থীরা গবেষণায় এগিয়ে যাবে।
  • মাল্টি-ডিসিপ্লিনারি মাস্টার্স প্রোগ্রাম বিশ্ব বাজারের চাহিদা মোতাবেক নতুন ধরনের দক্ষতা তৈরি হবে।
  • ফেলোশিপ আর্থিক নিশ্চয়তা দিয়ে শিক্ষার্থীদের মেধা বিকাশ নিশ্চিত হবে।
  • কলেজ শিক্ষকদের দক্ষতা বৃদ্ধি অধিভুক্ত কলেজগুলোর শিক্ষকগণের জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও গবেষণা সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় এবং তাদের চাকরি বদলিযোগ্য হওয়ায় দেশব্যাপী কলেজ শিক্ষার মান উন্নত হবে।
  • শিক্ষক নিয়োগে স্বচ্ছতা তৈরি হলে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক নিয়োগের সুযোগ না থাকায় কেবল যোগ্যতমরাই সরাসরি সহকারী অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপক পদে নিয়োগ পাবেন। কলেজ পর্যায়ে বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ হবে বিধায় দুর্নীতির সুযোগ বন্ধ হবে।
  • রাজনীতিমুক্ত উচ্চ শিক্ষা ব্যবস্থা মূল ক্যাম্পাসের শিক্ষকগণের ফোকাস হবে গবেষণা তাই তাদের রাজনৈতিক কার্যক্রমে যুক্ত থাকার সুযোগ হবে না। অপরদিকে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে কলেজ শিক্ষকদের রাজনৈতিক কার্যক্রম আইনগতভাবেই নিষিদ্ধ।

প্রস্তাবিত ঢাকা সেন্ট্রাল বিশ্ববিদ্যালয় মডেল বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে পারে। এটি স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শিক্ষায় গুণগত মানোন্নয়ন ঘটাবে, গবেষণা ও উদ্ভাবনকে ত্বরান্বিত করবে, এবং কলেজ শিক্ষকদের দক্ষ করে দেশের সর্বত্র মানসম্পন্ন উচ্চশিক্ষার পরিবেশ তৈরি করবে। তবে খেয়াল রাখতে হবে, ঢাকা সেন্ট্রাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে যেন কতিপয় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও রাজনৈতিক শক্তির আত্মীয়স্বজনকে পুনর্বাসনের কেন্দ্র না হয়ে ওঠে।

সম্প্রতি ঢাকার সরকারি সাত কলেজকে নিয়ে বাস্তবায়নাধীন ঢাকা সেন্ট্রাল বিশ্ববিদ্যালয়ের যে হাইব্রিড মডেল ইউজিসি মিডিয়ায় প্রকাশ করেছে তা শিক্ষাক্ষেত্রে সুযোগ বৃদ্ধির পরিবর্তে শিক্ষার সংকোচন হচ্ছে এবং রাজধানী ঢাকা শহরে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তানদের উচ্চ শিক্ষার সুযোগ বন্ধ হতে যাচ্ছে।

উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার সুযোগ সরকারি প্রতিষ্ঠানে সংকোচনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ঠেলে দেওয়ার পাঁয়তারা চলছে। স্কুল ভিত্তিক মডেলে স্বল্প সংখ্যক শিক্ষার্থী স্নাতক পর্যায়ে ভর্তির মাধ্যমে নাম সর্বস্ব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষা বাণিজ্যের প্রসার বিস্তারে কোনো মহল কাজ করছে কি না তা পর্যালোচনা করা জরুরি।

সাত কলেজের জন্য একটি উপযুক্ত মডেল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনই পারে উদ্ভূত সমস্যা থেকে এ দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় স্বস্তি ফিরিয়ে দিতে।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, পরিসংখ্যান বিভাগ, সরকারি তিতুমীর কলেজ, ঢাকা

Link copied!