বাংলাদেশ এমন একটি সময় পার করছে যেখানে রাজনৈতিক উত্তেজনা ও জাতীয় নিরাপত্তা—দুটোই সংবেদনশীল মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়, রাজনৈতিক নেতৃত্বের পালাবদল এবং প্রতিবেশী দেশের নানামুখী চাপ ও তৎপরতা—সব মিলিয়ে দেশকে এখন নতুন বাস্তবতার সামনে দাঁড় করিয়েছে। আর এই নতুন বাস্তবতায় সবচেয়ে বেশি আলোচনায় এসেছে যে প্রতিষ্ঠানটি সেটি হলো বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।
কারণ রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় শক্তি, সবচেয়ে বড় নিরাপত্তা-ঢাল এবং সবচেয়ে বড় আস্থার কেন্দ্র এই সেনাবাহিনী। কিন্তু দুঃখজনকভাবে দেশের ভেতরে কিছু গোষ্ঠী, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত শক্তি এবং বিদেশি এজেন্ডায় পরিচালিত অনলাইন চক্র-সেনাবাহিনীকে নিয়ে সুপরিকল্পিত অপপ্রচার চালানোর কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এই অপপ্রচার যে কেবল বাহিনীর সম্মান ক্ষুণ্ন করে তা-ই নয়, বরং দেশের সার্বভৌমত্বকে হুমকির মুখে ঠেলে দেয়। কারণ সেনাবাহিনীকে দুর্বল করা মানে হচ্ছে রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষার শেষ স্তম্ভটিকে আঘাত করা।
জাতীয় নিরাপত্তার ভিত্তি—কেন সেনাবাহিনী অপরিহার্য?
একটি রাষ্ট্র তিনটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে— জনগণ, ভূখণ্ড এবং প্রতিরক্ষা-সক্ষমতা। জনগণকে সুশৃঙ্খল রাখা যায় জনমত দিয়ে, ভূখণ্ডকে রক্ষা করা যায় প্রশাসন ও কূটনীতি দিয়ে, কিন্তু কোনো রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা সক্ষমতা—তা দাঁড়িয়ে থাকে তার সেনাবাহিনীর ওপর। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সেটা আরও বেশি সত্য। কারণ ভৌগোলিক অবস্থান, সীমান্ত-সংকট, রাজনৈতিক বাস্তবতা এবং আঞ্চলিক শক্তির ব্যবহৃত চাপ মোকাবিলায় সেনাবাহিনীর প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করার সুযোগ নেই।
তাই সেনাবাহিনীকে নিয়ে অপ্রয়োজনীয় বিতর্ক, গুজব বা অপপ্রচার রাষ্ট্রকে দুর্বল করে—এটা অত্যন্ত সরল সত্য।
ভারতের চাপ, সীমান্ত উত্তেজনা ও কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সেনাবাহিনীই বড় ভরসা
সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন বিভিন্নভাবে দৃশ্যমান।
যেমন—
- সীমান্তে অযাচিত উত্তেজনা
- রাজনৈতিক মন্তব্য
- আঞ্চলিক উন্নয়ন প্রকল্পে চাপ
- নিরাপত্তা- ইস্যুতে অনাকাঙ্ক্ষিত ভূমিকা
এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীই সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিরোধ-বার্তা দেয়। যে দেশ তার সেনাবাহিনীকে নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত থাকে, তার ওপর আন্তর্জাতিক চাপ সহজেই দেওয়া যায়। যে দেশ তার সেনাবাহিনীকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধ থাকে, তাকে চাপ দেয়া কঠিন। এটাই বাস্তবতা এবং এটা ইতিহাসের শিক্ষাও। তাই সেনাবাহিনীকে বিতর্কিত করা মানে, কূটনৈতিক দরকষাকষিতেও দেশের অবস্থান দুর্বল করে ফেলা।
পার্বত্যাঞ্চলে অস্থিতিশীলতা ও বিভাজন ঠেকাতে সেনাবাহিনীর বিকল্প নেই
পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের সবচেয়ে সংবেদনশীল এলাকাগুলোর একটি। এখানে—সশস্ত্র গ্রুপের অবশিষ্ট অবকাঠামো, বিদেশি অর্থায়ন ও প্ররোচণার চেষ্টা, জাতিগত উত্তেজনা সৃষ্টি এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ইস্যুকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করার প্রবণতা সবসময়ই উপস্থিত থাকে।
এখানে সেনাবাহিনী শুধু নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করে না বরং তারা উন্নয়ন প্রকল্পে কাজ করে, সড়ক ও অবকাঠামো নির্মাণ করে, পাহাড়ি শিক্ষার্থীদের সহায়তা করে এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সঙ্গে আস্থা তৈরি করে। ফলে এই অঞ্চলে সেনাবাহিনীকে দুর্বল দেখানোর যেকোনো প্রচেষ্টা-বাংলাদেশের ভূখণ্ডগত অখণ্ডতার বিরুদ্ধে কাজ করা শক্তির হাতে লাভ তুলে দেয়। তাই সেনাবাহিনীকে বিতর্কিত করা আসলে পাহাড়ে অস্থিরতা বাড়ানোর সরাসরি প্রভাব সৃষ্টি করে।
নির্বাচনের আগে সেনাবাহিনীর মনোবল ভাঙা মানে রাষ্ট্রকে ঝুঁকির মুখে ফেলা
নির্বাচন বাংলাদেশের সবচেয়ে উত্তপ্ত সময়গুলোর একটি। অভিজ্ঞতা বলে, নির্বাচনকে শান্তিপূর্ণ রাখার সবচেয়ে বড় সক্ষমতা রয়েছে সেনাবাহিনীর হাতে। তারা নিরপেক্ষ, তারা দায়িত্বশীল, তারা জনগণের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম। কিন্তু বর্তমানে কিছু চক্র সেনাবাহিনীকে রাজনৈতিক রঙে রাঙানোর চেষ্টা করছে।
এমন ইঙ্গিত দিচ্ছে যেন তারা রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত হবে বা কোনো পক্ষকে সুবিধা দেবে। এগুলো সম্পূর্ণ বানোয়াট, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং অপপ্রচার।
এ ধরনের প্রচারণা যদি বেশি ছড়ায় তাহলে—
- আইনশৃঙ্খলা দুর্বল হবে
- নির্বাচনি পরিবেশ সহিংস হতে পারে
- জনগণের আস্থা হারাবে
- এবং রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা হুমকিতে পড়বে
তাই নির্বাচনের আগে সেনাবাহিনীকে নিয়ে অপপ্রচার করা সবচেয়ে দায়িত্বহীন কাজ।
সেনাবাহিনীর মনোবল ভাংলে কী ক্ষতি হতে পারে?
১. সৈনিকদের মধ্যে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়:
যারা সীমান্তে, পাহাড়ে, দুর্গম অঞ্চলে দায়িত্ব পালন করছেন তাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার সরাসরি মানসিক চাপ সৃষ্টি করে।
২. বাহিনীর অভ্যন্তরীণ ঐক্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়:
বাহিনীর শক্তি তার ঐক্য। এটি ভাংলে প্রতিষ্ঠান দুর্বল হয়ে পড়ে, যা দেশের জন্য মারাত্মক হুমকি ও ক্ষতির কারণ।
৩. আন্তর্জাতিক মহলে দুর্বল রাষ্ট্রের ইমেজ তৈরি হয়:
যেখানে সেনাবাহিনী নিয়ে বিতর্ক বেশি, সেই দেশকে বড় শক্তিগুলো সহজেই চাপ দেয়। সেনাবাহিনী নিয়ে বিতর্ক থাকার কারণে বাহিনী নৈতিক মনোবলে চাঙ্গা থাকে না, ফলে শত্রুদেশ সহজেই আগ্রাসন চালানোর সাহস করে। বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী থেকে শুরু করে বহিরাগত শক্তি—সবার জন্যই এটি সুযোগ তৈরি করে।
৪. জাতীয় নিরাপত্তার সর্বোচ্চ ঝুঁকি তৈরি হয়:
সেনাবাহিনী দুর্বল হলে পুরো রাষ্ট্র যেকোনো আঞ্চলিক অস্থিরতায় দ্রুত বিপদে পড়তে পারে। অন্যদিকে, সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী রাখা মানে দেশের আগামী ২০ বছরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
বিশ্বের প্রতিটি উন্নত দেশ তার সেনাবাহিনীকে সর্বোচ্চ সম্মান ও গুরুত্ব দেয়।
এর কারণ একটাই—সেনাবাহিনী শক্তিশালী থাকলে রাষ্ট্র নিরাপদ থাকে, অর্থনীতি স্থিতিশীল থাকে, কূটনীতি সফল হয় এবং জনগণ নিশ্চিন্তে জীবনযাপন করতে পারে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়।
সেনাবাহিনীকে বিতর্কিত করে লাভ নেই, শুধুই ক্ষতি
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী শুধু একটি প্রতিষ্ঠান নয়, এটি দেশের নিরাপত্তার কেন্দ্রবিন্দু, রাষ্ট্রের মর্যাদার প্রতীক এবং জনগণের আস্থার শেষ আশ্রয়স্থল। যারা সেনাবাহিনীকে নিয়ে অপপ্রচার চালায় তারা আসলে দেশের সার্বভৌমত্ব ও স্থিতিশীলতাকে আঘাত করে। তাই যেকোনো অপপ্রচার বা বিদ্বেষমূলক কথাবার্তা বাদ দিয়ে এ মুহূর্তে প্রয়োজন-
- সেনাবাহিনীর প্রতি জনগণের আস্থা আরও জোরদার করা
- অপপ্রচারের বিরুদ্ধে তথ্যভিত্তিক প্রতিরোধ
- বাহিনীর মনোবল অটুট রাখা
- জাতীয় ঐক্য বজায় রাখা
এর কারণ হলো, শক্তিশালী সেনাবাহিনী মানেই নিরাপদ বাংলাদেশ। দুর্বল সেনাবাহিনী মানে বিপদের মুখে রাষ্ট্র। এই সত্য যত দ্রুত আমরা বুঝব, ততই রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নিরাপদ হবে।
লেখক সিনিয়র সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক





সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন