সোমবার, ১০ নভেম্বর, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


এম.আব্দুল্লাহ আল মামুন খান

প্রকাশিত: নভেম্বর ১০, ২০২৫, ০৮:৩৩ পিএম

মতামত

ঢাকা দখলের কথার হুংকার, রাজনৈতিক দেউলিয়াপনা 

এম.আব্দুল্লাহ আল মামুন খান

প্রকাশিত: নভেম্বর ১০, ২০২৫, ০৮:৩৩ পিএম

রাজনীতি। ছবি- সংগৃহীত

রাজনীতি। ছবি- সংগৃহীত

বাংলাদেশের রাজনৈতিক পথ স্বাভাবিক নয় মোটেও। গত পাঁচ দশকে গণতান্ত্রিক যাত্রা হোঁচট খেয়েছে বহুবার। ক্ষমতার পালাবদল দেখেছে দেশের মানুষ। একাধিকবার দুর্বল হয়েছে গণতন্ত্রের শেকড়। গত বছরে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও সুদৃঢ় এক জাতীয় ঐক্যের সূচনা হয়েছিল। এরই মধ্যে জাগ্রত হয় গণতান্ত্রিক চর্চার গুণগত মান উন্নয়নের অফুরান সম্ভাবনাও। আক্ষরিক অর্থেই গণতান্ত্রিক রূপান্তরের অগ্রযাত্রা এখন রেষারেষিতে চিড়েচ্যাপ্টা। একে অপরের বিপরীতমুখী অবস্থান, তীব্র মতপার্থক্য। বড় ভাঙন রক্তের আখরে লেখা ঐক্যে। 

আলোচনার টেবিল ছেড়ে রাজপথমুখী প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো। উদ্ভুত পরিস্থিতি ক্রমশ জটিল আকার নিচ্ছে। রাজনৈতিক নেতাদের চলমান বক্তব্যে এখন আর রাখঢাকের কোনো বালাই নেই। দোষারোপ আর ঘায়েল করার পুরোনো ধারার রাজনীতি চাঙ্গা। এই সুযোগে মরণকামড় বসাতে চায় গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ। কার্যক্রম নিষিদ্ধ এই দলটি লকডাউন কর্মসূচি দিয়েছে ঢাকায়। ডেডলাইন ১৩ নভেম্বর। আসন্ন দিনটিতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায় ঘোষণা হবে। হুমকি দিচ্ছে ঢাকা দখলের। কেবলই কথার হুংকার। ভাষাভঙ্গিতে এখনো নেই গণতন্ত্রের লেশমাত্র। 

প্রতিবেশী দেশের সংবাদপত্র ও সামাজিক মাধ্যমে অবশ্য দিনটিতে ব্যাপক লোকসমাগমের বিষয়টির প্রচার করা হচ্ছে। সহিংস আচরণের মাধ্যমে বিচারপ্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করে দেশে পরিকল্পিতভাবে বিশৃঙ্খলা তৈরিই মূল উদ্দেশ্য। ‘জ্বালাও-পোড়াও ও মারো’ নীতির প্রধান লক্ষ্য আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চূড়ান্ত অবনতি ঘটানো। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় হামলা এবং গাড়িতে আগুন দিয়ে জনমনে আতঙ্ক তৈরি করাসহ নানা অপতৎপরতার এসব আগাম তথ্য ছড়িয়ে পড়ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। গেল দিন ধরে বিভিন্ন ফেসবুক পেজে গণঅভ্যুত্থানে পালিয়ে যাওয়া আওয়ামী ফ্যাসিবাদে শীর্ষ পর্যায়ের কয়েক নেতা রাজধানীতে বিশৃঙ্খলা ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে নিজ দলের কর্মীদের প্রকাশ্য নির্দেশনা দিচ্ছেন। গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তথ্যমতে, ১৩ নভেম্বরকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক অস্থিরতা বা সংঘাতের আশঙ্কা রয়েছে। এজন্য মাঠ প্রশাসনকে যেকোনো উসকানিমূলক তৎপরতা প্রতিরোধের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

অতিবিজ্ঞ রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের চোখে এমন হুমকি বা হুংকার আদতে সমন্বিত রাষ্ট্রব্যবস্থাকে হুমকির মুখে ফেলে কর্তৃত্ববাদী শক্তির পুনরুত্থান ঘটানোর খোয়াব। নানা ধরনের গুজব ও অপপ্রচার এ ক্ষেত্রে তাদের প্রধান হাতিয়ার। ক্ষমতাচ্যুতদের এই হুমকিকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে সরকার। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোকে সর্বোচ্চ সতর্কতার নির্দেশ দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, আগামী ১৩ নভেম্বর ঢাকা লকডাউন নিয়ে কোনো ধরনের শঙ্কা নেই, আওয়ামী লীগের কার্যক্রম এখন নিষিদ্ধ। 

দিনটিতে ব্যাপক নাশকতার আশঙ্কা উদ্বেগের সঙ্গে বাড়াচ্ছে উত্তেজনাও। তুঙ্গে নানা জল্পনাকল্পনা। রাজনীতি নিয়ে চর্চা করেন এমন বিশ্লেষকরা পতিত শক্তির দখলের হুমকির অপরাজনীতির কঠোর সমালোচনা করছেন। তাদের ভাষ্য হচ্ছে, মানুষের মনে উদ্বেগ, অজানা আশঙ্কা ও ভয়ের পরিস্থিতি তৈরি করা মোটেও গণতান্ত্রিক কোনো সিদ্ধান্ত হতে পারে না। কর্তৃত্ববাদী শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নিজেদের করুণ পরিণতির পরও আওয়ামী লীগের মধ্যে কোনো অনুশোচনা নেই। দলটির নেতাদের কথাবার্তা বা চিন্তা-চেতনায়ও কোনো পরিবর্তন আসেনি। এখন ঢাকা দখলের হুমকির মাধ্যমে নিজেদের দেউলিয়াপনাকে আরও প্রকট করে তুলেছে। 

দেশ ও জনগণের চেয়ে ক্ষমতাই মূল্যবান নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের কাছে, এমন মন্তব্য এসেছে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকের মুখ থেকে। চায়ের আড্ডায় তাঁর কথার সঙ্গে নির্জনতার কবি জীবনানন্দ দাশের ‘অদ্ভুত আঁধার’ কবিতাটি বেশ প্রাসঙ্গিকও মনে হয়েছে। ক্ষমতার পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে সবসময় গণতন্ত্রের সংজ্ঞা পাল্টে দিতে করিৎকর্মা দেশ থেকে বিতাড়িত এই দলটি। সব কার্যক্রম নিষিদ্ধ হলেও ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়নি। স্বৈরতন্ত্র কায়েমের মাধ্যমে দীর্ঘ সময় ভয় ও দমনের রাজনীতি জারি রেখেছিল। ক্ষমতা হারিয়ে দেশত্যাগে বাধ্য হয়ে এখন গণসমাবেশ ঘটিয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি, লকডাউন ঘোষণার গুজব, গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় হামলার আশঙ্কা এবং যানবাহনে অগ্নিসংযোগের প্রচারণা—সবই গণতান্ত্রিক চেতনার পরিপন্থী। আসন্ন সংসদ নির্বাচনকে বানচাল করতে মরিয়া ফ্যাসিবাদী শক্তির রাষ্ট্রবিরোধী সব অপকৌশল সম্মিলিতভাবেই মোকাবিলা করতে হবে। 

দেখা গেছে, এর আগেও পতনের তিন মাস পর আওয়ামী লীগ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘোষণা দিয়ে গত বছরের ১০ নভেম্বর শহীদ নূর হোসেন দিবসে ঢাকার গুলিস্তানের জিরো পয়েন্টসহ দেশব্যাপী বিক্ষোভ মিছিলের কর্মসূচি নিয়েছিল। আওয়ামী লীগবিরোধী বিভিন্ন দল ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতিরোধ এবং সরকারের কঠোর অবস্থানের কারণে সেটি সফল হয়নি। এরপর বিভিন্ন সময়ে চোরাগোপ্তা ঝটিকা মিছিল করতে দেখা গেছে দলটিকে। গত ৩১ অক্টোবর ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে জানানো হয়, গত প্রায় ১০ মাসে ঢাকায় নিষিদ্ধ দলটির তিন হাজার নেতাকর্মী ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) হাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন। এ ছাড়া ঘোষিত লকডাউন কর্মসূচি বাস্তবায়নের প্রস্তুতিকে কেন্দ্র করে গত বৃহস্পতিবার ঢাকা জেলা পুলিশ জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে ৩১ জনকে গ্রেপ্তার করে। 

ক্ষমতাচ্যুত শক্তিসহ মহলবিশেষ আশায় ছিল, মাঠে থাকা সেনাবাহিনীর ৫০ শতাংশ সদস্যকে ফিরিয়ে নেওয়ার ঘোষণাকে বিশেষ সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করতে। কিন্তু স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী ইতোমধ্যেই জানিয়ে দিয়েছেন, মোতায়েনকৃত সেনাবাহিনীর ৫০ শতাংশ সদস্যকে তুলে নেওয়া হচ্ছে না। এ সংক্রান্ত যা ছড়িয়েছিল সেটা গুজব, এ রকম কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। সেনাবাহিনী আগের মতোই মাঠে থাকবে। মাঠ থেকে সেনাবাহিনীর সদস্যদের প্রত্যাহার করা হবে না। 

অভিজ্ঞ রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, সরকারের এই সিদ্ধান্ত একটি মাস্টার স্ট্রোক। সম্ভবত দেশবিরোধী সম্ভাব্য অপতৎপরতা ঠেকাতেই সময়োপযোগী এই সিদ্ধান্তটি গ্রহণ করেছে সরকার। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে এই সামরিক বাহিনী ছাত্র-জনতার অংশ রয়েছে। দেশকে ঘুরে দাঁড় করাতে সরকারকে সর্বাত্মক সহযোগিতা দিয়ে আসছে। জনতার সঙ্গে শক্ত সেতুবন্ধ তৈরির মাধ্যমে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিরোধী সব ষড়যন্ত্র নসাৎ করে দিয়েছে। তারা ছিল বলেই সম্ভাব্য অনেক বিপদ থেকে রক্ষা পেয়েছে দেশ। জননিরাপত্তা, অনাকাঙ্ক্ষিত অরাজকতা প্রতিরোধ ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্টের কারসাজি রুখে দিয়েছে। মিল-কারখানা সচল রেখেছে। রাষ্ট্রের কেপিআই এবং গুরুত্বপূর্ণ সরকারি ও বেসরকারি স্থাপনাগুলো রক্ষা, সড়ক-মহাসড়ক বাধামুক্ত রাখা, অবৈধ অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার, বিদেশি কূটনীতিক ও দূতাবাসগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিতের কাজ সমানতালে সামলেছে। কাজেই মাঠে তাদের সক্রিয় উপস্থিতি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে সমুন্নত রাখতে প্রভাবকের ভূমিকা পালন করবে। 

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘনিয়ে এসেছে। বছরের পর বছর ভোটদানের সুযোগ বঞ্চিত নাগরিকরা উন্মুখ হয়ে আছেন নিজেদের ভোটাধিকার প্রয়োগের জন্য। কিন্তু জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে নিয়ে ঘরে-বাইরে ষড়যন্ত্র থেমে নেই। সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘নির্বাচন বানচালের জন্য ভেতর থেকে, বাইরে থেকে অনেক শক্তি কাজ করবে। ছোটখাট না, বড় শক্তি নিয়ে বানচালের চেষ্টা করবে। হঠাৎ করে আক্রমণ চলে আসতে পারে। এই নির্বাচন চ্যালেঞ্জিং হবে। যত ঝড়ঝঞ্ঝাই আসুক আমাদের সেটা অতিক্রম করতে হবে।’ প্রধান উপদেষ্টার এই বার্তা সবিশেষ গুরুত্ব বহন করে। নিজেদের মধ্যে সমঝোতায় পৌঁছতে হবে। রাজপথের ময়দান কোনো অবস্থাতেই পতিত অরাজনৈতিক শক্তির হাতে ছেড়ে দেওয়া যাবে না। সংঘাতপূর্ণ রাজনীতিকে হিমঘরে পাঠিয়ে শান্তি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে হবে। দৃঢ় ঐকমত্যে পৌঁছার মধ্যে দিয়ে ফ্যাসিবাদী শক্তিকে পরাজিত করতে হবে। ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানের চেতনা ও লক্ষ্য সুসংহত করাই হোক এই মুহূর্তের প্রধান অগ্রাধিকার।  

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও গণমাধ্যমকর্মী

Link copied!