মঙ্গলবার, ০৪ নভেম্বর, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


জুবায়ের দুখু

প্রকাশিত: নভেম্বর ৪, ২০২৫, ১০:০৯ এএম

বিশ্লেষণ

সুদানে নেই সুখের সন্ধান

জুবায়ের দুখু

প্রকাশিত: নভেম্বর ৪, ২০২৫, ১০:০৯ এএম

জুবায়ের দুখু। ছবি-রূপালী বাংলাদেশ

জুবায়ের দুখু। ছবি-রূপালী বাংলাদেশ

দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে পূর্ব আফ্রিকার দেশ সুদানে যে নৃশংস গৃহযুদ্ধ চলছে, তা সম্প্রতি এক অন্ধকার ও শঙ্কাজনক মোড় নিয়েছে। আধাসামরিক গোষ্ঠী র‍্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (আরএসএফ) উত্তর দারফুরের রাজধানী এল-ফাশারের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেছে- যে শহরটি এতদিন ছিল সেনাবাহিনীর (এসএএফ) হাতে থাকা দারফুরের শেষ প্রধান দুর্গ। এই দখল শুধু সামরিক বিজয় নয়, বরং সুদানের রাজনৈতিক মানচিত্রে এক গভীর ভূমিকম্পের ইঙ্গিত- একটি সম্ভাব্য জাতীয় বিভেদের সূচনা।

সুদান ডক্টরস নেটওয়ার্কের তথ্য অনুযায়ী, এল-ফাশারে গত সপ্তাহে অন্তত ১ হাজার ৫০০ বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন- তাদের অনেকেই শহর থেকে পালানোর সময় নির্মমভাবে খুন হন। সংগঠনটি বলেছে, এই সহিংসতার মাত্রা ও প্রকৃতি ‘একটি প্রকৃত জাতিগত গণহত্যার প্রতিচ্ছবি’, যা আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক উদাসীনতার পরিণতি।

আরএসএফ বাহিনী ৫০০ দিনেরও বেশি সময় ধরে শহরটি অবরোধ করে রেখেছিল। এনপিআর জানিয়েছে, ভিডিও, স্যাটেলাইট চিত্র এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্য ইঙ্গিত দেয়- আধাসামরিক বাহিনী ‘পোড়া মাটির নীতি’ অনুসরণ করছে।

আলজাজিরা এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, সহায়তা সংস্থাগুলো ‘বাড়ি বাড়ি অভিযান, পালিয়ে যাওয়া বেসামরিকদের ওপর হামলা ও সার-সংক্ষেপে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর’-এর প্রমাণ পেয়েছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, শহরের একমাত্র কার্যকর হাসপাতাল- এল-ফাশারের সৌদি প্রসূতি হাসপাতালে- ৪৬০ জন রোগী ও তাদের স্বজনকে হত্যা করা হয়েছে এবং ছয়জন স্বাস্থ্যকর্মীকে অপহরণ করা হয়েছে।

আন্তর্জাতিক ক্ষোভের মুখে আরএসএফ প্রধান জেনারেল মোহাম্মদ হামদান দাগালো (হেমেদতি) স্বীকার করেছেন যে, তার বাহিনী ‘অত্যাচার করেছে’ এবং তদন্তের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু অতীতের মতো এবারও পর্যবেক্ষকরা সন্দিহান, কারণ হেমেদতি এর আগেও এমন প্রতিশ্রুতি দিয়ে তা বাস্তবায়ন করেননি।

এল-ফাশারের পতন শুধু রক্তক্ষয়ী নয়, এটি সুদানের দীর্ঘমেয়াদি অখণ্ডতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। এই শহরটি দারফুরে সেনাবাহিনীর শেষ দুর্গ ছিল; তার পতনে আরএসএফ কার্যত পশ্চিমাঞ্চলে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে। ফলে দেশটি এখন দুই সামরিক শক্তির নেতৃত্বাধীন দুটি বাস্তব অংশে বিভক্ত- পূর্বে সেনাবাহিনী, পশ্চিমে আরএসএফ।

ফাউন্ডেশন ফর ডিফেন্স অব ডেমোক্রেসিজের মতে, আরএসএফ বর্তমানে দারফুরের পাঁচটি রাজ্যের রাজধানী নিয়ন্ত্রণ করছে- ফলে সুদান কার্যত দুটি ভাগে বিভক্ত হয়েছে। সিএনএন একে বলেছে, ‘আরএসএফের সবচেয়ে বড় বিজয়, যা দেশের বাস্তব বিভাজনকে ত্বরান্বিত করতে পারে।’

এএফপি জানিয়েছে, সেনাবাহিনী এখন নীলনদের তীরবর্তী উত্তর, পূর্ব ও কেন্দ্র অঞ্চলে সীমাবদ্ধ, আর আরএসএফ পশ্চিম সমভূমিতে আধিপত্য বিস্তার করছে। ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের অ্যালান বসওয়েলের ভাষায়, ‘সুদান এখন কার্যত বিভক্ত- যুদ্ধ যত দীর্ঘ হবে, এই বিভাজন তত গভীর ও অপরিবর্তনীয় হয়ে উঠবে।’

এল-ফাশারের পতনে দারফুরের ওপর আরএসএফের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে- যে অঞ্চলটি সোনা, সীমান্ত করিডর ও অস্ত্র সরবরাহের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। এর ফলে আরএসএফ এখন অর্থনৈতিক ও সামরিকভাবে আরও শক্তিশালী অবস্থানে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, এই বিজয় আরএসএফকে যুদ্ধক্ষেত্র প্রসারিত করতে উৎসাহিত করবে। সুদানের বিশ্লেষক দালিয়া আবদেলমোনিয়েম বলেন, ‘এখন তাদের হাতে গতি আছে- এবং এল-ফাশার থেকে তারা উত্তরাঞ্চলীয় রাজ্য ও কর্দোফান অঞ্চলে সরাসরি অগ্রসর হতে পারবে।’

আরএসএফের নেতৃত্বে থাকা হেমেদতি মূলত ২০০৩ সালের দারফুর গণহত্যার সময় কুখ্যাত জানজাউইদ মিলিশিয়ার অংশ ছিলেন। সেই মিলিশিয়া পরবর্তীতে র‍্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস নামে পুনর্গঠিত হয়। অতএব, বর্তমান নৃশংসতাগুলোর ধারাবাহিকতা সুদানের ইতিহাসের পুরোনো দায়মুক্তি ও সহিংস রাজনীতির ধারাকে স্পষ্ট করে।

এল-ফাশারের পতন দেখিয়ে দিল যে, যুদ্ধ থামাতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রচেষ্টা কতটা ব্যর্থ হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মিশরের সমন্বয়ে গঠিত ‘কোয়াড’ সেপ্টেম্বরে তিন ধাপের একটি শান্তি পরিকল্পনা প্রস্তাব করেছিল- মানবিক যুদ্ধবিরতি, স্থায়ী যুদ্ধবিরতি এবং বেসামরিক শাসনে রূপান্তর। কিন্তু বাস্তবে তা ধসে পড়েছে।

বিশেষত সংযুক্ত আরব আমিরাতের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। জাতিসংঘ ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোর অভিযোগ, আবুধাবি আরএসএফকে সামরিক ও আর্থিকভাবে সহায়তা করছে- তাদের বিনিয়োগকৃত সোনার খনি রক্ষা ও আঞ্চলিক প্রভাব বজায় রাখার লক্ষ্যে।

অন্যদিকে, মিশর সেনাবাহিনীর পক্ষে কূটনৈতিক সমর্থন অব্যাহত রেখেছে, কারণ তারা নীলনদ উপত্যকার স্থিতিশীলতাকে সাফ-এর অস্তিত্বের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত মনে করে। ফলে কোয়াডের অভ্যন্তরীণ লক্ষ্যভেদ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা যুদ্ধবিরতি প্রক্রিয়াকে অচল করে তুলেছে।

কিংস কলেজ লন্ডনের বিশ্লেষক আন্দ্রেয়াস ক্রিগের ভাষায়, ‘এল-ফাশার এখন এমন এক যুদ্ধ অর্থনীতির কেন্দ্র, যার বৈধতা আবুধাবির নেটওয়ার্কগুলোর মাধ্যমে টিকে আছে। এটি শুধু একটি সামরিক বিজয় নয়, বরং ‘বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অক্ষ’-এর বাস্তব প্রতিফলন।’

আরএসএফ এখন আলোচনার প্রয়োজন অনুভব করছে না- তাদের বিশ্বাস গতি এখন তাদের পক্ষে। অন্যদিকে, সেনাপ্রধান আবদেল ফাত্তাহ আল-বুরহান ঘোষণা করেছেন, তার বাহিনী ‘এল-ফাশারে আমাদের জনগণের হত্যার প্রতিশোধ নিতে’ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এবং ‘আরএসএফকে দেশ থেকে উৎখাত না করা পর্যন্ত লড়াই করবে।’

অর্থাৎ, কোনো পক্ষই এখন শান্তি আলোচনায় আগ্রহী নয়। এরই মধ্যে দেশজুড়ে অনাহার, বাস্তুচ্যুতি ও গণহত্যার হুমকি ক্রমশ বাড়ছে। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, ২০২৩ সালের এপ্রিলে যুদ্ধ শুরুর পর থেকে অন্তত ১ কোটি ১০ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে এবং প্রায় দেড় লাখ বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছে।

বিশ্লেষক ক্যামেরন হাডসনের মতে, ‘দারফুরে আরএসএফের নিয়ন্ত্রণ তাদের নিষ্ঠুর ভাড়াটে বাহিনীর কাছে অঞ্চলটিকে উন্মুক্ত করে দেবে। প্রশাসন পরিচালনার সক্ষমতা তাদের নেই এবং শিগগিরই এটি বেদনাদায়কভাবে স্পষ্ট হয়ে উঠবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘যদি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এখন বাস্তব পদক্ষেপ না নেয়, তাহলে এল-ফাশারের পতনকে ইতিহাস স্মরণ করবে সেই মুহূর্ত হিসেবে, যখন সুদান কার্যত বিভক্ত হয়ে পড়েছিল।’

Link copied!