৭ নভেম্বর, জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস। ১৯৭৫ সালের এই দিনটি বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের আলোক রেখা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। দিনটি কেবল সামরিক বিপ্লব বা অভ্যুত্থান হিসেবে পরিচিত নয়, বরং এক নতুন রাজনৈতিক ধারার সূচনা, দেশের উন্নয়ন এবং নতুন দিশার জন্য জিয়াউর রহমানের ভূমিকা ও উদ্যোগকে স্মরণীয় করে রেখেছে। তার নেতৃত্বে দেশ পুনর্গঠনের পথে এক গুরুত্বপূর্ণ ধাপ অতিক্রম করেছিল। দেশ গঠনে জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক চেতনা এবং ঐতিহাসিক ভূমিকা দেশকে সংকটময় মুহূর্ত থেকে বের হয়ে এসে একটি নতুন পথের দিকে এগিয়ে নিয়েছিল।
তৎকালীন বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ছিল অত্যন্ত অস্থিতিশীল। দেশের শাসনব্যবস্থা এক ধরনের শূন্যতার মধ্যে পড়েছিল। মূলত দেশ পরিচালনায় জাতীয় ঐক্যের অভাব ও সকলের প্রতি সকলের অনাস্থা দেশকে খাদের কিনারে নিয়ে গিয়েছিল। রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে নিয়জিতরা দেশের মানুষকে নতুন দিশা দেখাতে ব্যর্থ হয়েছিল। এই সময় এগিয়ে এলেন জিয়াউর রহমান, যিনি মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন, একটি প্রাসঙ্গিক প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলেন: কীভাবে দেশের ভবিষ্যৎ গড়ে তোলা যায়?
মূলত ৭ নভেম্বরের ঘটনা ছিল এক ঐতিহাসিক পরিবর্তন, যেখানে সেনাবাহিনী, সুশীল সমাজ এবং জনগণের মধ্যে নতুন এক রাজনৈতিক চেতনা ও শ্রদ্ধা তৈরি হয়েছিল। এই ঐক্যের মধ্য দিয়ে সিপাহী-জনতার উদ্দোগে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণ করেন। তার নেতৃত্বে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এক নতুন বিপ্লব ঘটে। এই বিপ্লব কেবলমাত্র সামরিক দিক থেকে নয়, বরং একটি জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক চেতনাকেও উজ্জীবিত করেছিল, যা দেশের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা সৃষ্টি করেছিল।
জিয়াউর রহমানের প্রথম কাজ ছিল দেশের স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা। দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক অস্থিরতা, সেনাবাহিনীর অভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধের প্রভাব, এবং রাষ্ট্রীয় সংকটের কারণে দেশে এক ধরনের অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছিল। তিনি দ্রুত একটি শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন যা জনগণের মধ্যে আস্থার সৃষ্টি করেছিল। তার শাসনামলে সামরিক বাহিনীকে রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে একটি প্রাসঙ্গিক ভূমিকা দিতে গিয়ে তিনি দেশকে একটি নির্দিষ্ট পথে পরিচালনা করতে সক্ষম হন।
জিয়াউর রহমানের শাসনামলে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ নেওয়া হয়। তিনি ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) প্রতিষ্ঠা করেন এবং পরবর্তী সময়ে ১৯৭৯ সালের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচন বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটে নতুন আঙ্গিক নিয়ে আসে, যেখানে সরকারকে জনগণের কাছে দায়বদ্ধ হতে হয়। এই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া গ্রহণের ফলে বিভিন্ন দলের প্রতি সহনশীল মনোভাব প্রকাশ পায়।
তার নেতৃত্বে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা বেশ কিছু ক্ষেত্রে উন্নতি করে। বিশেষ করে তার শাসনামলে কৃষি খাতে এক বিপ্লব হয়। তিনি বিদেশি সাহায্যের বদলে দেশীয় উদ্যোগের উপর গুরুত্ব দেন। একদিকে, দেশের কৃষকদের জন্য কৃষি সংস্কার চালু করেন, অন্যদিকে দেশের শিল্প খাতে বিনিয়োগের সুযোগ বাড়ান। তার আমলে দেশটি আঞ্চলিকভাবে অর্থনৈতিকভাবে উন্নত হতে থাকে।
তিনি জাতিগত ঐক্য ও সামরিক শক্তির প্রতি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে, তিনি দেশীয় সামরিক বাহিনীর শক্তি বাড়ান এবং এক শক্তিশালী জাতীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা গঠন করেন। তিনি মন্ত্রিপরিষদে সামরিক এবং বেসামরিক প্রতিনিধিদের সমন্বয় ঘটান এবং একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক ভিত্তি তৈরি করেন, যা পরবর্তীতে তার শাসনকে স্থিতিশীল করার ক্ষেত্রে সহায়ক হয়।
জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক দর্শন ছিল এক জাতীয়তাবাদী এবং প্রগতিশীল ভাবধারা। তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং দেশপ্রেমের উপর ভিত্তি করে এক নতুন জাতীয়তার ধারণা প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে বাংলাদেশকে উন্নতির পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে সবার আগে একটি শক্তিশালী, অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীল সরকার প্রয়োজন। এই সরকারকে জনগণের মৌলিক অধিকার, স্বাধীনতা এবং সমতার নিশ্চয়তা দিতে হবে।
তিনি দেশের মানুষের মধ্যে একটি জাতীয় চেতনা সৃষ্টি করার জন্য মুক্তিযুদ্ধের তত্ত্ব এবং ভাবনার সঙ্গতি বজায় রাখার চেষ্টা করেছিলেন। তার শাসনে, পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের সংগ্রামের চেতনা ও মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধকে সম্মান করা হয়েছিল, যা একদিকে দেশের নাগরিকদের মধ্যে বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা সৃষ্টি করেছিল।
যদিও জিয়াউর রহমানের শাসনামলে বাংলাদেশের অনেক দিকেই উন্নয়ন ঘটে। তার শাসনামলে একটি ব্যাপক জাতীয় স্বার্থের মধ্যে উন্নতি এবং দেশ গঠনের জন্য নতুন দিশা খোঁজা হয়েছিল। তিনি শুধু নিজেকে একজন রাষ্ট্রপতি হিসেবে নয়, বরং দেশের ভবিষ্যতের একজন সৃষ্টিশীল এবং প্রগতিশীল নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
তাই ৭ নভেম্বর ১৯৭৫ বাংলাদেশের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। যেখানে জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে রাজনৈতিক পরিবর্তন এবং জাতীয়তাবাদী চেতনা নতুন রূপ পায়। তার শাসনামলে দেশে উন্নয়ন, স্থিতিশীলতা এবং এক নতুন জাতীয় চেতনা প্রতিষ্ঠিত হয়, যা আজও পর্যন্ত বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রভাব রেখে যাচ্ছে। জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক দর্শন এবং উদ্যোগগুলো এক নতুন বাংলাদেশ গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করে দিয়েছিল। যা তাকে বাংলাদেশের ইতিহাসে একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা হিসেবে চিরস্মরণীয় করে রেখেছে।


সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন