বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার উথলী হাটে অনুষ্ঠিত হলো তিন শতকের ঐতিহ্যবাহী উথলী নবান্ন মাছের মেলা। অগ্রহায়ণের প্রথম দিনে নবান্ন উৎসবকে ঘিরে আয়োজিত এই মেলায় ভোর থেকেই ভিড় জমতে থাকে ক্রেতা-দর্শনার্থীদের। হাসি, আনন্দ এবং কেনাবেচার কোলাহলে পুরো এলাকা একসময় পরিণত হয় উৎসবমুখর জনসমুদ্রে। স্থানীয়দের মতে, এই মেলা এখন শুধু কেনাবেচার জায়গা নয়—এটি লোকজ সংস্কৃতি ও গ্রামীণ ঐতিহ্যের এক অনন্য মিলনমেলা।
এ বছরের মেলায় ছিল চমকে দেওয়ার মতো বিশাল আকৃতির মাছের সমারোহ। ৫ থেকে ২৫ কেজি ওজনের রুই, কাতলা, বোয়াল, গ্লাসকাপ, বাঘাইড়, আইড়সহ নানা প্রজাতির মাছ চোখে পড়ে দর্শনার্থীদের। এসব মাছ ৩০০ টাকা থেকে ১ হাজার টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। সকাল থেকেই বড় মাছ নিয়ে যেন শুরু হয় অনানুষ্ঠানিক প্রতিযোগিতা।
গাইবান্ধা থেকে প্রথমবারের মতো মেলায় আগত ক্রেতা মো. ফরিদুল বলেন, ‘শুনেছি উথলীর মেলায় খুব বড় মাছ পাওয়া যায়। তাই প্রথমবার এসেছি। সত্যি অবাক হয়েছি—এ যেন বড় মাছের উৎসব!’
নবান্ন উপলক্ষে এ মেলায় জামাইদের আগমন এখন শ্বশুরবাড়ির এক বিশেষ রীতি হয়ে উঠেছে। শ্বশুরবাড়ির আমন্ত্রণে জামাইরা মাছ কিনে নিয়ে যান নবান্নের সৌরভ।
সিরাজগঞ্জ থেকে আগত জামাই প্রনব কুমার বলেন, ‘শ্বশুরবাড়ির লোকজন আগেই বলে দিয়েছে—উথলীর মেলায় গিয়া ভালো একটা বড় মাছ নিতে হবে। জামাই বলে কথা—মাছটাও ভালো না নিলে মান-সম্মান থাকে না।’
শুধু শিবগঞ্জ নয়, বগুড়ার বাইরে বিভিন্ন জেলা থেকেও মানুষ আসে বড় মাছ দেখতে ও কিনতে। মেলাপ্রাঙ্গণে দাঁড়ানো ক্রেতা রাজিকুল ইসলাম রনি বলেন, ‘এই মেলার নাম সারা দেশে। ৩০০ বছরের পুরোনো এই মেলায় আলাদা একটা ইতিহাস আর আলাদা আমেজ আছে।’
মাছ বিক্রেতা সুজন সরকার জানান, ‘এই মেলার ক্রেতারা অন্যরকম। দাম বুঝে-শুনেই মাছ কেনেন। আর জামাইরা তো দাম কমানই না—শ্বশুরবাড়ির মান রাখতে বড় মাছই নেন। এবার মাছের আমদানি বেশি, তাই দামও তুলনামূলক কম।’ তিনি আরও জানান, ছোট-বড় প্রায় ১০০টি মাছের দোকান বসেছে এ মেলায়। এবারের নবান্ন মেলায় মাছ বিক্রি হবে কোটি টাকার বেশি।
শীতকালীন সবজি ও লোকজ পণ্যের সমারোহ মাছ ছাড়াও মেলায় পাওয়া গেছে নতুন আলু, মুলা, শিম, বাঁধাকপি, লাউসহ নানা শীতকালীন সবজি। ছিল পানিফল, খেজুরের রস, চুইঝাল, মুড়ি-মুড়কি এবং নানা ধরনের মাটির তৈজসপত্র। স্থানীয়দের বিশ্বাস—নবান্নের সময় উথলীর মেলার নতুন সবজি ছাড়া এলাকার বউঝিরা চুলায় আগুনই দেন না।
স্থানীয় প্রবীন ব্যক্তি আব্দুল মান্নান বলেন, ‘আগে মানুষ মাথায় মাছ নিয়ে আসত। রাতে লণ্ঠন জ্বেলে হাট বসত। এখন যুগ বদলেছে, কিন্তু উথলীর মেলার আবেগ কমেনি। নবান্নে হাটে মাছ বিক্রি না করলে নাকি বছরের মাছ ধরায় বরকত থাকে না—এটাই ছিল আমাদের সময়ের বিশ্বাস।’
তিন শতকের ঐতিহ্য ধরে রাখতে এবারের মেলার সার্বিক ব্যবস্থাপনা ছিল অত্যন্ত সুসংগঠিত। মানুষের নিরাপত্তা, যানবাহন নিয়ন্ত্রণ, বাজার নজরদারি—সবকিছুতে প্রশাসন ও আয়োজক কমিটি সমন্বিতভাবে কাজ করেছে। এজন্য মেলাজুড়ে ছিল শান্তিপূর্ণ পরিবেশ।
স্থানীয় সমাজসেবক মো. মশিউর রহমান রাজন বলেন, তিন শতকের ঐতিহ্য বহনকারী উথলী নবান্ন মাছের মেলা শুধু একটি হাট নয়—এটি গ্রামীণ জীবন, লোকসংস্কৃতি, কৃষি ও জলজ সম্পদের এক মহামিলন উৎসব। বড় মাছের প্রদর্শনী, শীতের সবজির সমারোহ, জামাই আগমনের রীতি, আর হাজার মানুষের আনন্দঘন উপস্থিতিতে এবারের আয়োজনও হয়ে উঠেছে সবার মনে এক অনন্য স্মৃতি।

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন