জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) প্রাথমিক স্তরের বিনা মূল্যের পাঠ্যবই ছাপায় বিপুল পরিমাণ নিম্নমানের কাগজ ব্যবহার ও বাজে ছাপার কারণে বইয়ের ফর্মা বাতিলের ঘটনা ঘটেছে। এতে এনসিটিবির প্রত্যাশিত সময়ে উপজেলা পর্যায়ে যে পরিমাণ বই সরবরাহের কথা, বাস্তবে হয়েছে তার অর্ধেকেরও কম। তবে এনসিটিবি ও তাদের নিয়োগ করা পিডিআই (প্রি-ডেলিভারি ইন্সপেকশন) এজেন্ট এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কঠোর নজরদারির কারণে প্রেসগুলোর পক্ষে নিম্নমানের বই দেওয়া কঠিন হয়ে উঠেছে। এনসিটিবি ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
জানা গেছে, বিনা মূল্যের প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক স্তরের সাড়ে ৮ কোটির বেশি বই ছাপাসহ উপজেলা পর্যায়ে বিতরণে কাজ করছে ৬৭টি প্রেস। এনসিটিবির সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী মোট ৭০ দিনের মধ্যে প্রেসগুলো এসব বই ছেপে উপজেলায় সরবরাহের কথা। এনসিটিবির সঙ্গে যেদিন প্রেসের চুক্তি হবে, সেদিন থেকে পরবর্তী ৭০ দিন ধরা হয়। চুক্তি অনুযায়ী মোট ৭০ দিনের মধ্যে প্রথম ৪০ দিনে ৫০ শতাংশ বইয়ের কাজ শেষ করতে হবে। বাকি ৫০ শতাংশ বইয়ের কাজ শেষ করতে হবে ৩০ দিনে। এই হিসাবে প্রথম ৪০ দিনে ৪ কোটির বেশি বই উপজেলায় সরবরাহের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। ছাপার কাজ পাওয়া অধিকাংশ প্রেসের প্রথম ৪০ দিনের সময় শেষ হয়েছে গত ১০-১২ অক্টোবর। কিন্তু গত শনিবার পর্যন্ত উপজেলা পর্যায়ে বই সরবরাহ হয়েছে প্রায় ২ কোটি ৪৭ লাখ। যা মোট বইয়ের ২৩ দশমিক ৮২ শতাংশ।
অর্থাৎ প্রত্যাশা অনুযায়ী প্রথম ৪০ দিনে বই সরবরাহ কম হয়েছে প্রায় ২৬ শতাংশ। নির্ধারিত সময়ে প্রেসগুলোর নির্দিষ্ট পরিমাণ বই সরবরাহে ব্যর্থতার বিষয়ে জানা গেছে, পিডিআই শুরুর প্রথম দিন থেকে এখন পর্যন্ত নিম্নমানের কাগজে খারাপ ছাপার কারণে প্রায় ২২০০ মেট্রিক টন কাগজ বাতিল করা হয়েছে। এই পরিমাণ কাগজ দিয়ে প্রায় ১ কোটি বই তৈরি করা যেত। আর বইয়ের জন্য ছাপা হওয়া প্রায় ৫০ লাখ ফর্মা বাজে ছাপার কারণে কেটে বাতিল করা হয়েছে। ফলে নি¤œমানের কারণে বিপুলসংখ্যক কাগজ ও বইয়ের ফর্মা বাতিল হওয়ায় বই সরবরাহ করা সম্ভব হয়নি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিকের কাজ শুরু হয়েছে গত ৬ সেপ্টেম্বর থেকে। গত শনিবার পর্যন্ত বইয়ের পিডিআই হয়েছে ২ কোটি ৩৪ লাখ ৭৬ হাজার ৭৩৫ কপি বই। এর মধ্যে উপজেলা পর্যায়ে সরবরাহ করা হয়েছে ২ কোটি ৪৭ লাখ ৬৯০ কপি বই। যা মোট বইয়ের ২৩ দশমিক ৮২ শতাংশ।
কাজ শুরুর পর নিম্নমানের কাগজ ধরা পড়ায় প্রায় ২০০৯ মেট্রিক টন কাগজ বাতিল করা হয়। এই পরিমাণ কাগজে প্রায় এক কোটি বই প্রস্তুত করা যেত বলে জানিয়েছে সূত্র। ফলে এনসিটিবির স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী কাগজে বই তৈরির জন্য নতুন করে কাজ করছে প্রেসগুলো। এনসিটিবির কাজ পাওয়া ৬৭টি প্রেসের মধ্যে ছোট-বড় সব প্রেসের বইয়েই কম-বেশি ত্রুটি পাওয়া গেছে। এসব ত্রুটির কারণে ইতিমধ্যে সরকার প্রেস, নাহার প্রেস, মহানগর অফসেট প্রেস, দশদিশা প্রিন্টার্স ও রেজা প্রিন্টার্সসহ আরো কয়েকটি প্রেসকে কারণ দর্শানো নোটিশ দিয়েছে এনসিটিবি। এদের মধ্যে অনেককে একাধিকবারও নোটিশ দেওয়া হয়েছে।
মাঠপর্যায়ের বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, গত বুধবার পিডিআই এজেন্টের পরিদর্শনের সময় অক্সফোর্ড প্রেস এন্ড পাবলিকেশনের ১ম-৩য় শ্রেণির মোট ১৩০০ কপি বই ও এম/এস নাহার প্রিন্টার্সের ২য় শ্রেণির আমার বাংলা বই ৩০ হাজার ফর্মা ও একই শ্রেণির ইংরেজি ও গণিতের ৪০০ কপি বই কাটিং মেশিনে কেটে বিনষ্ট করা হয়েছে। একই দিন ১ম-৩য় শ্রেণির ৯টি বইয়ের ছাপা, বাইন্ডিং, ডাবল ফর্মা ও ফর্মা মিসিং থাকার কারণে আমিন আর্ট প্রেসের ২ লাখ ৩৬ হাজার ২৬৭ কপি বই পুনরায় বাছাই করে পিডিআইয়ের জন্য আবেদনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এদিকে একটি গোয়েন্দা সংস্থা সম্প্রতি এনসিটিবিকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছে, চট্টগ্রামের পাহাড়ি আবাসিক এলাকায় সাগরিকা প্রিন্টার্সের প্রাথমিক স্তরের ১৫টি বিষয়ের মুদ্রিত ও উপজেলায় সরবরাহের জন্য প্রস্তুত করা পাঠ্যবইয়ের কাগজের মান ভালো হলেও নিম্নমানের প্রিন্টিং, ফর্মা মিসিং (মাঝে মাঝে পৃষ্ঠা নেই) ও ডাবল ফর্মা (একই পাতা বারবার), কাটিং ও বাইন্ডিং সমস্যাযুক্ত ব্যাপকসংখ্যক পাঠ্যবই দেখা যায়। তাৎক্ষণিকভাবে উপজেলায় প্রেরণের জন্য প্রস্তুত করা ৪ লাখ ৮৮ হাজার ৯৯৭ কপি বই ইন্সপেকশন এজেন্ট কর্তৃক ডেলিভারির অনুমোদন না দিয়ে বইগুলো বাছাই করার নির্দেশনা দেওয়া হয়।
এ বিষয়ে সাগরিকা প্রিন্টার্সের স্বত্বাধিকারী মো. গিয়াসউদ্দিন রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, আমাদের কাগজ ভালো ছিল, তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে মিসটেকের কারণে ফর্মা মিসিং ও ডাবল ফর্মা যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে। আমার নির্দেশনা অনুযায়ী বিষয়গুলো ঠিক করে উপজেলায় প্রেরণের জন্য প্রস্তুত করছি।
সূত্র জানায়, প্রতিবছরের মতো এবারো বইয়ের প্রকৃত সংখ্যা গোপন করে বেশি দেখানো ও এনসিটিবির স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী কাগজ ব্যবহারের ক্ষেত্রে নানা কৌশল ব্যবহারের অভিযোগ পাওয়া গেছে প্রেসগুলোর বিরুদ্ধে। বইয়ের প্রকৃত সংখ্যার ক্ষেত্রে যেমন- ৫০ কপির বান্ডিলে বই দেয় ৪৮-৪৯টি। আর ১০০ কপির বান্ডিলে বই দেয় ৯৮-৯৯টি। তাহলে ৫০ কপির বান্ডিল দিয়ে ৫০০ বান্ডিল করা হলে বই কম হয় ৫০০ থেকে ১০০০। আর ১০০০ বান্ডিল হলে বইয়ের প্রকৃত সংখ্যার থেকে কম হয় ১০০০ থেকে ২০০০। আবার বইয়ের স্টেকে (স্তূপ করে রাখা) যেভাবে কারসাজি করা হয়-যেমন চারদিক থেকে বই দেয়ালের মতো উঠিয়ে মাঝের অংশ গর্তের মতো করে রাখা। যেন বেশি দেখিয়ে পিডিআই করে বইয়ের প্রকৃত সংখ্যা গোপন করা যায়। তৃতীয়ত ও সবচেয়ে ভয়ংকর বিষয় হচ্ছে এনসিটিবির স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী কাগজ কিনে ক্রয়ের ম্যানুফেকচার সার্টিফিকেটে কাগজের পরিমাণ বেশি দেখানো।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, একটি প্রেস এনসিটিবির স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী কাগজ মিল থেকে ২০ মেট্রিক টন কাগজ কিনেছে। ওই মিল প্রেসটিকে ২০ মেট্রিক টন কাগজ ক্রয়ের ম্যানুফেকচার সার্টিফিকেট দিবে। এরপর ওই প্রেসটি ম্যানুফেকচার সার্টিফিকেটে এডিট করে কাগজের পরিমাণ বাড়িয়ে লিখে ইন্সপেকশন এজেন্ট থেকে পাস করিয়ে নেয়। অর্থাৎ ওই প্রেসটির এনসিটিবির স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী ২০ টন কাগজ মানসম্পন্ন হলেও বাড়িয়ে লেখা সংখ্যার নিম্নমানের কাগজ ব্যবহারের সুযোগ পেয়ে যায়।
সম্প্রতি এনসিটিবি ও পিডিআইয়ের নজরদারিতে এমন একটি বিষয় ধরা পড়ছে বলে জানা গেছে। এ ছাড়া কিছু প্রেস বই ছাপার সময় ‘ইনার চেঞ্জ’ নামে একটি অনৈতিক পদ্ধতি অবলম্বন করত। এতে অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের মানহীন বইয়ের ওপরের মলাটে বা পরিচিতি স্থানে শুধু নিজেদের নাম ছাপিয়ে নতুন বই হিসেবে সরবরাহ করত। কিন্তু ২০২৬ শিক্ষাবর্ষ থেকে প্রথমবারের মতো ছাপানো বইয়ের প্রতিটি ফর্মায় বাধ্যতামূলকভাবে প্রেসের নাম লেখার শর্ত আরোপ করা হয়েছে।
এতে বই বিতরণের পর কোনো সমস্যা ধরা পড়লে দায়ী প্রতিষ্ঠান সহজে শনাক্ত করা যাবে। তাই আগের বছরগুলোর মতো এই পন্থায় প্রেসগুলো আর নিম্নমানের বই দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছে না বলে দাবি করেছে এনসিটিবি সূত্র।
জানা গেছে, গত ১৩ অক্টোবর পিডিআইয়ের সময় এ্যারিস্টোক্রেটস সিকিউরিটি প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং লিমিটেডের ১৩ মেট্রিক টন কাগজ নি¤œমানের অভিযোগে বাতিল করা হয়। কাগজ বাতিল হওয়ায় প্রেসটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্ষিপ্ত হয়ে পিডিআই এজেন্টকে প্রাণনাশের হুমকি দেন। পিডিআই এজেন্ট এ বিষয়ে এনসিটিবিকে লিখিত অভিযোগ দেয়। পরবর্তী সময়ে এনসিটিবি ওই ব্যবস্থাপনা পরিচালককে ডেকে সতর্ক করে।
সার্বিক বিষয়ে এনসিটিবির সদস্য (পাঠ্যপুস্তক) প্রফেসর রিয়াদ চৌধুরী রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘কঠোরভাবে সব কিছু মনিটর করা হচ্ছে। এর ফলে মাঠপর্যায়ে কিছু ত্রুটি-অনিয়ম ধরা পড়লেও তাৎক্ষণিকভাবে তা সমাধান করা হচ্ছে। আমাদের পরিকল্পনা হচ্ছে, যেকোনো মূল্যে নভেম্বরের মাঝামাঝি প্রাথমিক স্তরের বইয়ের কাজ শেষ করা। যাতে মাধ্যমিক স্তরের বইয়ের কাজে কোনো ধরনের বিঘ্ন না হয়।’ পিডিআই এজেন্টকে প্রাণনাশের হুমকির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা ওই প্রেসকে ডেকে সতর্ক করে দিয়েছি। পিডিআই এজেন্টও বিষয়টি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে মেনে নিয়েছে।’
গত বছরের তুলনায় ২০২৬ শিক্ষাবর্ষে প্রায় ১০ কোটি বই কম ছাপা হচ্ছে। এতে দশম শ্রেণির পাঁচ কোটি এবং অতিরিক্ত বিষয়ের জন্য আরও পাঁচ কোটি বই রয়েছে। পাঠ্যবইয়ের মান নিশ্চিত করতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে এনসিটিবি। এর মধ্যে প্রতি ফর্মায় প্রেসের নাম লেখা, দ্বৈত ল্যাবে কাগজ পরীক্ষা, প্রতিটি প্রেসে সিসিটিভি ক্যামেরা বসিয়ে ছাপা প্রক্রিয়া সরাসরি পর্যবেক্ষণ। একই সঙ্গে কাগজ ও ছাপার মান বাড়াতেও আনা হয়েছে নানা পরিবর্তন।
আগে পাঠ্যবই ছাপায় ব্যবহৃত কাগজের ওজন ছিল ৮২ জিএসএম (গ্রাম পার স্কয়ার মিটার), এবার তা বাড়িয়ে ৮৫ জিএসএম করা হয়েছে।
একইভাবে কাগজের উজ্জ্বলতা সূচক বা ব্রাইটনেস বাড়ানো হয়েছে। এবার কাগজের বাস্টিং ফ্যাক্টর ১৬ থেকে ২০ করা হয়েছে। এ ছাড়া কাগজে আগে ব্যবহৃত হতো কৃত্রিম উজ্জ্বলকরণ বা অপটিক্যাল ব্রাইটনার। এবার ব্যবহার করতে বলা হয়েছে ১০০ শতাংশ প্রাকৃতিক পাল্প। একই সঙ্গে ইন্সপেকশন এজেন্টের ওপরও কড়া শর্ত আরোপ করা হয়েছে। এনসিটিবিতে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের জন্য পৃথক দুটি ল্যাব স্থাপন করা হয়েছে। মনিটরিং কর্মকর্তারা প্রেস থেকে কাগজ নিয়ে আসবেন। এরপর ওই ল্যাবে পরীক্ষা করে দেখা হবে কাগজের মান ঠিক রয়েছে কি না।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন