অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের পথে থাকা একটি দেশের জন্য বারবারের অগ্নিকা- যেমন বিপজ্জনক, তেমনি তা একটি বৃহৎ শিল্প খাতের ভবিষ্যতের ওপর ছায়া ফেলতে শুরু করে। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে সাম্প্রতিক ভয়াবহ অগ্নিকা- এবং এর আগের দিনগুলোতে মিরপুর ও চট্টগ্রাম ইপিজেডে পোশাক কারখানায় লাগা আগুন এক চিত্রে স্পষ্ট করে যে শিল্প খাত বর্তমানে শুধু অর্থনৈতিক চাপ নয়, কাঠামোগত ও নিরাপত্তাগত দুর্বলতার মধ্যেও পড়ে আছে।
বুধবার রূপালী বাংলাদেশে প্রকাশিত ‘আগুনে দগ্ধ অর্থনীতি’ শিরোনামের বিশেষ প্রতিবেদনে উঠে আসে পরপর দেশে ভয়াবহ অগ্নিকা-ে দেশের দগ্ধ অর্থনীতির কথা। প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত ১৪ মাসে অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে অর্থনীতি কিছুটা ঘুরে দাঁড়ানোর লক্ষণ দেখালেও এই অগ্নিকা-গুলো তাৎক্ষণিকভাবে উৎপাদন, রপ্তানি ও বিনিয়োগ প্রবাহে বড় ধাক্কা দিয়েছে। কার্গো ভিলেজে পুড়েছে কয়েক হাজার কোটি টাকার পণ্য, যার মধ্যে ছিল জরুরি শিল্প কাঁচামাল, ওষুধ, খাদ্যপণ্য এবং ইলেকট্রনিকস সামগ্রী। সবচেয়ে বড় আঘাত এসেছে তৈরি পোশাক ও ওষুধশিল্পে, যাদের উৎপাদন এখন অন্তত দুই মাস পিছিয়ে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। শুধু সময় নয়, এই বিলম্বের কারণে প্রতিষ্ঠানগুলোকে মূল্য ছাড়, অতিরিক্ত পরিবহন ব্যয় এবং অর্ডার বাতিলের মতো ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে।
সবচেয়ে উদ্বেগজনক দিক হলো, এসব ঘটনা নিছক দুর্ঘটনা নাকি নাশকতা, তা এখনো নিশ্চিত নয়। অথচ দেশের প্রধান বিমানবন্দরের সবচেয়ে স্পর্শকাতর স্থাপনায় পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা না থাকা, দুর্বল নিরাপত্তা প্রোটোকল, এবং খোলা জায়গায় পণ্য সংরক্ষণ করার মতো উদাসীনতা একবিংশ শতাব্দীর বাংলাদেশে গ্রহণযোগ্য নয়। তৈরি পোশাক শিল্প, যা দেশের রপ্তানির ৮৪ শতাংশ জোগান দেয়, সেই খাতের উদ্যোক্তারা নিরাপত্তা নিয়ে যে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন তা অবহেলা করার সুযোগ নেই।
এখানে দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে মাথায় রাখতে হবে। প্রথমত, এই ঘটনার স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও দ্রুত তদন্ত অত্যন্ত জরুরি। যদি নাশকতা প্রমাণিত হয়, তবে তার যথাযথ বিচার নিশ্চিত করতে হবে, এটি কেবল ক্ষতিপূরণের প্রশ্ন নয়, বরং ভবিষ্যতের জন্য এক সতর্কবার্তা। দ্বিতীয়ত, দেশের প্রধান কার্গো হ্যান্ডলিং কেন্দ্রে আধুনিক অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা, ডিজিটাল নজরদারি, এবং ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা কাঠামো অবিলম্বে পুনর্গঠন করতে হবে।
শিল্প খাতকে রক্ষার জন্য তাৎক্ষণিক কিছু পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের বিমা দাবি দ্রুত নিষ্পত্তি, অক্ষত পণ্য দ্রুত ছাড়পত্র প্রদান এবং বিকল্প কার্গো হ্যান্ডলিং ব্যবস্থা চালু করার পাশাপাশি ক্ষতিপূরণ ও ঝুঁকি বণ্টনে একটি যৌথ নীতিমালা দরকার। এটি শুধু বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবিলা নয়, ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুতির অংশ হিসেবেও বিবেচিত হওয়া উচিত।
অর্থনীতির বর্তমান অবস্থা এমনিতেই অতি সংবেদনশীল। শিল্প খাতের ধারাবাহিকতা ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে না পারলে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার অনিশ্চয়তার দিকে চলে যেতে পারে। তৈরি পোশাক, ওষুধ ও অন্যান্য শিল্পের উৎপাদন-রপ্তানির নিরাপত্তা শুধু খাতভিত্তিক ইস্যু নয়, এটি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন, কর্মসংস্থান, এবং বৈশ্বিক বাজারে দেশের অবস্থান টিকিয়ে রাখার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সুতরাং এখনই সময় দায়িত্বশীল ও সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণের। সরকার, বেসরকারি খাত, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এবং আন্তর্জাতিক অংশীদারদের একত্রে কাজ করে শিল্প খাতের এই অস্থিরতা কাটাতে হবে। আমরা শিল্পনির্ভর একটি অর্থনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলছি, এখানে অবহেলার কোনো সুযোগ নেই। অর্থনৈতিক উত্তরণ নিশ্চিত করতে হলে, শিল্প খাতকে স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা দিতে হবে। এটাই এখন সবচেয়ে বড় প্রয়োজন।
আমাদের মনে রাখতে হবে, রপ্তানিমুখী শিল্প বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার প্রধান উৎস। এই খাতের নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা ও আস্থার ওপর নির্ভর করে দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ। তাই শিল্প খাতে চলমান অস্থিরতা দূর করা এবং কাঠামোগত দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠা এখন সময়ের দাবি। সরকার, বেসরকারি খাত ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে এখনই সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে, না হলে আমরা শুধু অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারেই নয়, আন্তর্জাতিক আস্থা অর্জনের পথেও পিছিয়ে পড়ব।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন