বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের প্রাণরেখা তিস্তা নদী। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই নদী ঘিরে গড়ে উঠেছে কৃষি, সংস্কৃতি ও জনজীবনের এক অখ- ইতিহাস। কিন্তু গত কয়েক দশকে তিস্তা তার প্রবাহ হারিয়েছে, শুকিয়ে গেছে, ভাঙনে গিলে খেয়েছে বসতি ও কৃষিজমি। উত্তরবঙ্গের কোটি মানুষের জীবিকা আজ এই নদীর অনিশ্চয়তার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
‘তিস্তা মহাপরিকল্পনা’ বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের সামাজিক-অর্থনৈতিক মুক্তির স্বপ্ন, টেকসই উন্নয়নের প্রতীক এবং ভবিষ্যতের জলনিরাপত্তার পরিকল্পনা। তবে এ প্রকল্পের সফলতা নির্ভর করছে কূটনীতি, নীতি-নির্ধারণ ও আঞ্চলিক সহযোগিতার ভারসাম্যের উপরও।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (ইডউই) তথ্যমতে, বাংলাদেশ অংশে তিস্তার দৈর্ঘ্য ১১৫ কিলোমিটার। প্রতি বছর বর্ষাকালে নদী ভরপুর পানিতে ফুলে ওঠে, কিন্তু ডিসেম্বর থেকে মে পর্যন্ত শুষ্ক মৌসুমে প্রবাহ মাত্র ৫০০ কিউসেকেরও নিচে নেমে আসে। অথচ কৃষি ও জনজীবনের জন্য প্রয়োজন প্রায় ১০,০০০ কিউসেক পানি।
১৯৯৭ সালে জাতিসংঘের পানি প্রবাহ কনভেনশন অনুযায়ী অভিন্ন নদীর পানি এমনভাবে ব্যবহার করা যাবে যেন ভাটির দেশ ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। অথচ তিস্তায় গজলডোবা বাঁধ, একাধিক কাল ও জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণ করে দীর্ঘ সময় ধরে পানি প্রত্যাহার করছে ভারত। যার দরুন, শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশ পানি না পেয়ে শুকিয়ে মরুভূমির রুপ ধারণ করে। আবার বর্ষা মৌসুমে কোনো পূর্বাবাস ছাড়াই শিকার হয় ভয়াবহ বন্যার, যা আন্তর্জাতিক নীতির পরিপন্থি। এই চরম বৈষম্যই তিস্তা অঞ্চলের কৃষকদের অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে।
রংপুর, লালমনিরহাট, নীলফামারী ও কুড়িগ্রাম অঞ্চলে প্রায় দুই কোটি মানুষের জীবন এই নদীর ওপর নির্ভরশীল। শুষ্ক মৌসুমে পানি না থাকায় এক সময়ের উর্বর জমি অন্য সময়ে অনাবাদি পড়ে থাকে, কৃষকেরা বাধ্য হয়ে কর্মসংস্থানের জন্য শহরমুখী হয়। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাওয়ায় পানীয় জলের সংকটও দেখা দেয়। অন্যদিকে বর্ষাকালে অতিপ্রবাহে নদীভাঙন ও বন্যা নতুন দুর্ভোগ সৃষ্টি করে।
এই সংকটের স্থায়ী সমাধান হিসেবে সরকার তিস্তা মহাপরিকল্পনা হাতে নেয়। প্রকল্পটির ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছিল আট হাজার ২০০ কোটি টাকা। এতে নদী খনন, নতুন বাঁধ নির্মাণ, পুরোনো বাঁধ সংস্কার, পানি সংরক্ষণের জন্য জলাধার, আধুনিক সেচব্যবস্থা এবং নদীর দু’পাড়ে বাঁধ সড়ক নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। পাশাপাশি নদীভিত্তিক পর্যটন ও শিল্পায়নের সম্ভাবনাও বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে।
চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান চড়বিৎ ঈড়হংঃৎঁপঃরড়হ ঈড়ৎঢ়ড়ৎধঃরড়হ ড়ভ ঈযরহধ (চড়বিৎঈযরহধ) প্রকল্পের একটি সম্ভাব্যতা সমীক্ষা সম্পন্ন করে। তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে নদীর প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করা যাবে, ৭ লাখ হেক্টর জমিতে সেচ সুবিধা দেওয়া সম্ভব হবে এবং নদীভাঙন নিয়ন্ত্রণ হবে ৯০ শতাংশ পর্যন্ত। এ ছাড়া প্রকল্প এলাকায় প্রায় ৫০ হাজার কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে, যা উত্তরবঙ্গের অর্থনৈতিক চিত্র পাল্টে দিতে পারে।
তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের কৃষি খাতে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটতে পারে। বর্তমানে এই অঞ্চলের কৃষকেরা মূলত বৃষ্টিনির্ভর চাষাবাদে অভ্যস্ত। কিন্তু প্রকল্প সম্পন্ন হলে আধুনিক সেচব্যবস্থার মাধ্যমে একাধিক ফসল উৎপাদন সম্ভব হবে। ধান, গম, ভুট্টা, পেঁয়াজ, রসুন, মরিচ, মিষ্টি কুমড়া, ও সবজি চাষের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে। এতে খাদ্যনিরাপত্তা যেমন নিশ্চিত হবে, তেমনি দেশের কৃষি অর্থনীতিও আরও শক্তিশালী হবে।
এ ছাড়া নদীভাঙন নিয়ন্ত্রণের ফলে বসতভিটা ও ফসলি জমি রক্ষা পাবে, ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যাও কমবে। নদীপাড়ে পরিকল্পিত বাঁধ ও গাছপালা লাগানোর মাধ্যমে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে সহায়ক হবে। এতে পুরো উত্তরাঞ্চলকে একটি ‘ইকো ফ্রেন্ডলি জোন’ রূপান্তর করা সম্ভব হবে।
ভারতের তিস্তার ন্যায্য হিস্যা আদায়ের চুক্তি করতে ব্যর্থ হয়ে বিগত সরকার চীন সরকারকে শুকনো মৌসুমে পানি সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে দেশের অভ্যন্তরে তিস্তা নদীতে একটি প্রকল্প গ্রহণের অনুরোধ করে। সে অনুসারে চীন তিস্তা মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করে, যার আওতায় তিস্তার বর্তমান প্রশস্ততা ৫ কিলোমিটার থেকে কমিয়ে ১ কিলোমিটারেরও কম এবং খননের মাধ্যমে নদীর গভীরতা ৫ মিটার থেকে বাড়িয়ে ১০ মিটার করা হবে।
তবে প্রস্তাব অনুযায়ী সংকুচিত হলে নদীর দুইপাড়ে প্রায় ১৭০ বর্গকিলোমিটার জমি উদ্ধার হবে, যেখানে বিভিন্ন ধরনের শিল্পকারখানা স্থাপন করা হবে। কিন্তু সংকুচিত এই প্রকল্পের ফলে সরু নদীতে বর্ষাকালে স্রোতের তীব্রতা অনেক বেড়ে যাবে এবং নদীভাঙন ও বন্যার মাত্রা বৃদ্ধি পাবে। ব্যাপক পলি ভরণের ফলে নদীটির নাব্যও হ্রাস পেতে পারে।
দেশের উত্তরাঞ্চলকে বাঁচাতে হলে প্রয়োজন টেকসই ও পরিবেশবান্ধব পদক্ষেপ। আন্তর্জাতিক নদী আইন ও আন্তঃসীমান্ত নদীর পানি বণ্টন আইনের পরিপ্রেক্ষিতে ভারত-বাংলাদেশ পানি বণ্টন ও প্রাণ-প্রকৃতি ধ্বংসে ভারত একতরফাভাবে দায়ী। এমনকি পানি প্রবাহ অস্বাভাবিকভাবে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ভারত, বাংলাদেশে কৃত্রিম মরুকরণ ও ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি করে চলেছে। যেহেতু ভারত উজানের দেশ এবং যথেচ্ছা পানি প্রবাহ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ভাটির দেশ বাংলাদেশের ন্যায্যতা অস্বীকার করে এবং প্রাণ-প্রকৃতিকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে তাই বাংলাদেশ সরকারের উচিত আন্তর্জাতিক আইনে ভারতের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া এবং সুসংগঠিত কূটনীতি পরিচালনার মাধ্যমে ভারতকে চাপে রেখে দেশের স্বার্থ হাসিল করা। বাংলাদেশ-নেপাল-পাকিস্তান-ভারত-চীন-মিয়ানমার-ভুটান, এ ৭ দেশ মিলে একটি নতুন নদী কমিশন গঠন করা যেন একতরফা পানি প্রবাহ নিয়ন্ত্রিত না হয়।
হুমায়ুন আহমেদ নাইম
সমাজবিজ্ঞান বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন