সরকারি টাকায় নির্মিত ‘মুজিববর্ষের’ আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর বিক্রি হচ্ছে লাখ টাকায়। বিগত সরকারের সময়ে লালমোহন উপজেলায় আশ্রয়হীন পরিবারের জন্য ১৫০০ ঘর নির্মাণ হলেও অনেক ঘরেই থাকছেন না ঘরের মালিকরা।
ভোলার লালমোহনে ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারের জন্য নির্মিত হয় অন্তত ১ হাজার ৫০০ আধা-পাকা বসতঘর। কয়েকটি ধাপে পৌরসভাসহ উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে নির্মিত হয় এসব ঘর। নিজস্ব ভূমি ও গৃহ থাকার পরেও রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার করে এসব ঘর করে হাতিয়ে নেন বিত্তবানরা। এ কারণে ঘর বরাদ্দ পাওয়ার পরেও সেখানে থাকছেন না মালিকরা। আবার কেউ কেউ এসব ঘরে আত্মীয়-স্বজনদের থাকতে দিয়েছেন, অনেকে ঘর বিক্রি করে চলে গেছেন অন্যত্র। নতুন করে ঘর বিক্রির জন্য ঘরের সামনে বিজ্ঞপ্তিও ঝোলানো হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, উপজেলার পশ্চিম চরউমেদ ইউনিয়নের পাঙাশিয়া এলাকায় পাশাপাশি ‘মুজিববর্ষের’ দুটি আশ্রয়ণ প্রকল্পে ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। এর মধ্যে একটি প্রকল্পে ৬৮টি ঘর থাকলেও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দেওয়া হয়েছে ৪০টি পরিবারকে। বাকি ২৮টি ঘরের কাগজপত্র এখনো কাউকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়নি। যেসব ঘর বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে তার মধ্যে বেশ কিছু ঘরে ঠিকমতো বসবাস করা হয় না। মূলত ঘর নির্মাণের সময় যেসব ক্যাটাগরি বিবেচনা করে ঘর বরাদ্দ দেওয়ার কথা ছিল, তা মানা হয়নি। যার কারণে নিজস্ব ভূমি ও গৃহ থাকার পরেও অনেকে এসব ঘর হাতিয়ে নিয়েছেন।
উপজেলার পাঙাশিয়া এলাকার আরেকটি আশ্রয়ণের ৭ নম্বর ঘরের দরজার সামনে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে লেখা রয়েছে ‘ঘর বিক্রি করা হবে’ এবং একটি মোবাইল নম্বর দেওয়া আছে। ওই মোবাইল নম্বরে কল দিলে তিনি রিসিভ করে নিজের নাম হাসিব বলে পরিচয় দেন। তার বাবার নাম ছিদ্দিক। তিনি ওই এলাকার মুনসুর আলী মাতাব্বর বাড়ির বাসিন্দা। যে ঘর বিক্রির বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে, সেটি মূলত তার মা রুমা বেগমের নামে বরাদ্দ পাওয়া। ওই ঘর বিক্রি করবেন কি না জানতে চাইলে হাসিব জানান, এক দিন আগেই এক লাখ টাকায় একজনের সঙ্গে ঘরটি বিক্রির বিষয় চূড়ান্ত হয়ে গেছে। এই আশ্রয়ণে মোট ৪১টি ঘর রয়েছে। এখানেও অনেকগুলো ঘর তালাবদ্ধ। অনেকে আবার আত্মীয় পরিচয় দিয়ে আশ্রয়ণের ঘরগুলোতে বাস করছেন।
বদরপুর ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডে কয়েক ধাপে তৈরি করা হয়েছে আশ্রয়ণের ঘর। সেখানেও দেখা দিয়েছে অনিয়ম, প্রায় ৪০ ঘরে ঝুলছে তালা, অনেকেই থাকেন ভাড়া, আবার অনেকেই ক্ষমতার দাপটে তালা ভেঙে দিয়ে অন্যকে ভাড়া দিয়েছেন। অথচ তার নামে কোনো ঘরের বরাদ্দ নেই।
পাঙ্গাশিয়ায় পঞ্চম পর্যায়ের আশ্রয়ণ প্রকল্পে গিয়ে দেখা যায়, বেশ কয়েকটি ঘর তালাবদ্ধ রয়েছে। ঘর পাওয়া রাজমিস্ত্রি লিটন জানান, বন্ধ থাকা ঘর যারা পেয়েছেন তারা দুই-তিন মাস পর একবার এসে ঘরগুলো দেখে যান। তারা কোথায় আছেন? জানতে চাইলে বলেন, আগের জায়গায় আছে।
ওই আবাসনে বসবাস করা ইকবাল নামে একজনের নামেও ঘর বরাদ্দ দেখা যায়। তিনি পার্শ্ববর্তী শিমুলতলী এলাকায় তার নিজের বাড়িতে আছেন বলে জানান প্রতিবেশীরা। অন্যদিকে এর পূর্বপাশে ৪র্থ পর্যায়ে নির্মিত আরেকটি আশ্রয়ণ প্রকল্পে গিয়ে পাওয়া যায় চাঞ্চল্যকর অভিযোগ। দুই বছর আগে নির্মিত এই আবাসনে একটি ঘর এক লাখ টাকা দিয়ে কিনে নিয়েছে বর্তমানে যিনি বসবাস করছেন তার পরিবার। জিজ্ঞাসাবাদে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুতক তিনি জানান, ঘরটি একটি নওমুসলিম পরিবারের নামে বরাদ্দ ছিল। তারা ঢাকা চলে গেছে বিক্রি করে। তাদের ঘর নেই, প্রয়োজন হওয়ায় ঘরটি কিনে বসবাস করেন।
শুধু ওইসব এলাকায় নয়, সরকারি আশ্রয়ণের ঘর বরাদ্দে এমন অনিয়ম দেখা গেছে উপজেলায় মুজিববর্ষে নির্মিত প্রায় সব আশ্রয়ণ প্রকল্পে। সরকারি ঘর নিয়ে এমন কর্মকা-ে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে স্থানীয় সচেতন মহলের মধ্যে। তারা বলছেন, যাদের প্রকৃত ঘর পাওয়ার কথা ছিল তারা ঘর পাননি। কিন্তু যাদের জমি এবং নিজের বাড়ি আছে, তাদের ঘর দেওয়া হয়েছে। মূলত তৎকালীন সময়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও ক্ষমতাসীনরা মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে প্রকৃত ভূমিহীন ও গৃহহীনদের বঞ্চিত করে এসব ঘর বরাদ্দ নেন। এতে করে জনগণের টাকার অপচয় হয়েছে। তাই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যেন পুনরায় এসব ঘর বরাদ্দ পাওয়া ব্যক্তিদের বিষয়ে তদন্ত করেন।
এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শাহ আজিজ জানান, অনেক আশ্রয়ণে এখনো বিদ্যুৎ সংযোগ পৌঁছেনি, যার কারণে অনেকে সেখানে থাকছেন না। কেউ আবার এলাকার বাইরে কর্মস্থলে থাকেন। তবে যাদের নামে ঘর বরাদ্দ হয়েছে তারা যদি বিক্রি করেন, এমন সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে তদন্ত সাপেক্ষে তাদের ঘর বরাদ্দ বাতিল করা হবে।

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন