ঢাকা রবিবার, ০৯ নভেম্বর, ২০২৫

প্রাথমিক থেকে শারীরিক শিক্ষা বাদ দেওয়া কতটা যৌক্তিক

মো. রায়হান হোসাইন
প্রকাশিত: নভেম্বর ৮, ২০২৫, ১১:৪১ পিএম

শিশুদের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার জন্য শারীরিক শিক্ষার বিভিন্ন কর্মসূচির কোনো বিকল্প নাই। বর্তমানে আধুনিক ডিভাইস সমৃদ্ধ যুগে এসে শিশু-কিশোরদের সুস্থতা নিশ্চিতে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নেয়। গত ২৮ আগস্ট ২০২৫ দেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জন্য শারীরিক শিক্ষা ও সংগীত পদ সৃষ্টি করে প্রজ্ঞাপন প্রকাশ করে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। এতে করে শারীরিক শিক্ষা জগতে একটি যুগান্তকারী যুগের যাত্রা শুরুর পথ সুগম হয়। সরকার থেকে ঘোষণা করা হয় শুরুতে শারীরিক শিক্ষা ও সংগীতে ক্লাস্টার অনুযায়ী একজন করে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হবে। অর্থাৎ নতুন করে দুটি বিষয়ে প্রায় ৫ হাজার শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। কিন্তু এরইমধ্যে দেশের ইসলামী সংগঠনগুলো তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় সংগীতের মতো বিষয়কে প্রাথমিকে বিষয় হিসেবে যুক্ত করাই তীব্র প্রতিবাদ জানায়।

ইসলামে সংগীত হারাম বলে ইসলামী দলগুলো আন্দোলন করতে থাকে। যার পরিপ্রেক্ষিতে ইসলামী দলগুলো ধারাবাহিকভাবে প্রতিবাদ জানাতে থাকে। এই প্রতিবাদের প্রেক্ষিতেই গত ২ নভেম্বর ২০২৫ প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রলয়ের সংশোধিত প্রজ্ঞাপনে শারীরিক শিক্ষা ও সংগীতকে বাদ দেওয়া হয়। অথচ ইসলামী দলগুলো কিংবা কোনো মহল থেকেই শারীরিক শিক্ষাকে বাদ দেওয়ার কোনো প্রকার অভিযোগ করা হয়নি। ফলে প্রাথমিক থেকেই মোবাইল আসক্তি কিংবা স্ক্রিন টাইম কমানোর যে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল তা ক্ষিণ হয়ে গেল। একটি সুস্থ ও শক্তিশালী জাতি গঠনে শারীরিক শিক্ষা যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে সে স্থান থেকে জাতি আরও একধাপ পিছিয়ে গেল।

অথচ ইসলামে শারীরিক শিক্ষা কিংবা এর গুরুত্বপূর্ণ অংশ খেলাধুলা নিয়ে কোনো প্রকার বাধা-বিপত্তি নেই। আছে খেলাধুলার অসংখ্য নিদর্শন। আমাদের প্রিয়নবী (সা.) নিজেও তার সহধর্মীদের সঙ্গে রাতে দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতেন। এছাড়া শারীরিক সুস্থতার জন্য দৌড়, সাঁতার, তীরন্দাজ কিংবা ঘোড়দৌড় ইত্যাদি ক্রীড়া প্রতিযোগিতাকে বরং ইসলামে গুরুত্বের সঙ্গে উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে।

শারীরিক শিক্ষার বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে প্রতিদিন একটি ক্লাসেই ছোট ছোট সোনামনিদের বিভিন্ন ক্রীড়া কিংবা মাইনর গেমসের মাধ্যমে শারীরিক কসরত বা ছোট ছোট কার্যক্রম শিশুদের মানসিক সুস্থতা নিশ্চিত করে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলো বিশেষ করে প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক পর্যায়ে শারীরিক শিক্ষাকে গুরুত্বে নিয়ে থাকে। এতে করে শিশুদের শারীরিক সুস্থতা যেমন নিশ্চিত হয় ঠিক তেমনি বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় এগিয়ে যাচ্ছে উন্নত দেশগুলো। অথচ আমাদের দেশে শারীরিক শিক্ষার মতো মাল্টি ডাইমেনশনাল পাঠ্যবিষয়কে চরম অবহেলা করা হচ্ছে।

এতে করে শহর কিংবা গ্রামে মোবাইল আসক্তি কিংবা মোবাইল জুয়ার সঙ্গে এই প্রজন্মের যে ভয়াবহ সম্পৃক্ততা তা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে নিয়ে যাচ্ছে ভয়ংকর পরিণতির দিকে। শারীরিক-মানসিক সুস্থতা ব্যতীত কোনো জাতি এগিয়ে যেতে পারে না। শারীরিক কিংবা মানসিক সুস্থতা ব্যতীত বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চাও সম্ভব নয়। ফলে প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শারীরিক শিক্ষাকে বাদ দেওয়া জাতির জন্য কোনো ভালো ফল বয়ে নিয়ে আসবে না। বরং শারীরিক শিক্ষার পাশাপাশি ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগের মাধ্যমে সুস্থ এবং নৈতিক দিক দিয়ে শক্তিশালী জাতি গঠন করা আমাদের প্রত্যাশা।

বর্তমানে দেশে চারটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে শারীরিক শিক্ষা ও ক্রীড়া বিজ্ঞান বিষয়ে অনার্স মাস্টার্স চলছে স্বগৌরবে। এছাড়া ছয়টি সরকারি শারীরিক শিক্ষা কলেজসহ ২০টি বেসরকারি শারীরিক শিক্ষা কলেজ আছে। যারা এক বছরের বিপিএড ডিগ্রি প্রদান করে। এই ডিগ্রি শেষ করে সব শিক্ষার্থী মূলত শারীরিক শিক্ষার শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। যেসব শিক্ষকবৃন্দ এ পেশায় আসেন তারা শিক্ষার্থীদের শারীরিক, মানসিক, সামাজিক এবং বৌদ্ধিক বিকাশের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ফলে শারীরিক শিক্ষার মতো বিষয়কে অবহলো করা কোনো সুস্থ জাতি গঠনের ক্ষেত্রে ভালো পদক্ষেপ নয়। বরং শারীরিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা এখন সময়ের দাবি।

মো. রায়হান হোসাইন
শিক্ষক, লেখক, কলামিস্ট