যেকোনো মানদণ্ডে এখন বাংলাদেশের উন্নয়নের প্রতীক ‘পদ্মা সেতু’। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলকে রাজধানী ঢাকার সঙ্গে যুক্ত করে এই সেতু নতুন এক সম্ভাবনার সেতুবন্ধন তৈরি করেছে। এই ঐতিহাসিক প্রকল্পের অন্যতম অংশীদার ছিল চীন, যারা নির্মাণ প্রযুক্তি ও সহযোগিতার মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে সহায়তা করেছে। এই সেতু শুধু সংযোগই নয়, বাংলাদেশের অর্থনীতি, বাণিজ্য ও উন্নয়নের নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে। উন্নয়নের এমন বন্ধন শুধু একটি অবকাঠামোতে নয়, পদ্মা রেল সেতুর থেকে শুরু করে পায়রা বন্দর, কর্ণফুলী টানেল, রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পের আশপাশের উন্নয়ন, কিংবা ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প সবখানেই রয়েছে চীনা কোম্পানি। চীনা বিনিয়োগ ও প্রযুক্তি বাংলাদেশকে শুধু অবকাঠামো নির্মাণে সাহায্য করছে না, বরং শিল্প উৎপাদন, রপ্তানি ও বৈদেশিক বাণিজ্যেও নতুন গতি আনছে। একই সঙ্গে বাংলাদেশের প্রযুক্তিনির্ভর অর্থনীতিকে নতুন মাত্রা দিয়েছে চীন।
জানা যায়, বর্তমানে প্রায় ৪০টির বেশি প্রকল্পে চীনের অর্থায়ন বা কারিগরি সহায়তা রয়েছে। অর্থনীতিবিদদের হিসাবে, বর্তমানে চীনা বিনিয়োগের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ হাজার কোটি ডলারেরও বেশি। এই বিনিয়োগের মধ্যে রয়েছে শিল্পাঞ্চল, বিদ্যুৎকেন্দ্র, রেলওয়ে, বন্দর সম্প্রসারণ ও টেলিকম অবকাঠামো। এসব প্রকল্প বাংলাদেশের উৎপাদন, লজিস্টিকস ও রপ্তানি সক্ষমতা বাড়াচ্ছে। দেশের বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মুস্তফা কে মুজেরি রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘চীন আমাদের উন্নয়নের অন্যতম ঘনিষ্ঠ সহযোগী। তারা বড় প্রকল্পে সহযোগিতা দিচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘চীন শুধু ঋণ দিচ্ছে না, তারা প্রযুক্তি দিয়েও আমাদের পাশে রয়েছে। আমরা সবাই জানি চীন এখন প্রযুক্তিতে অনেক এগিয়ে। তিস্তা মহাপরিকল্পনায়ও তারা আমাদের সহযোগিতা করছে। চীন তিস্তা প্রকল্পে টেকনিক্যালি অনেক পজিটিভ। এতে উত্তরবঙ্গে কৃষিতে ভালো কাজ হবে। তারা আমাদের অন্যতম বৃহত্তম উন্নয়ন সহযোগী। মিলিটারিতেও আমাদের নানাভাবে সহায়তা দেয়।’
পদ্মা সেতু নির্মাণ সম্ভব হয়েছে বিস্ময়কর চীনা প্রযুক্তির কল্যাণে
পদ্মা সেতু নির্মাণের কাজ শুরু থেকেই ছিল চ্যালেঞ্জিং। নির্মাণকাজের প্রতিটি পর্বেই কোনো না কোনো চ্যালেঞ্জ ছিল। খরস্রোতা পদ্মার বুকে সেতু নির্মাণ মুখের কথা নয়। এখানে নদীশাসন যেমন চ্যালেঞ্জিং ছিল, তেমনি নদীর তলদেশে পাথর না থাকায় পাইলিং করাটাও ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। সবকিছুই সম্ভব হয়েছে বিস্ময়কর চীনা প্রযুক্তির জন্য। পাইলিংয়ের উপরিভাগে স্ক্রিন গ্রাউটিং করে (অতিমিহি সিমেন্টের স্তর) পাইলের ওজন বহনক্ষমতা বাড়ানো হয়। পিলার ও স্টিলের কাঠামোর সংযোগস্থলে ১০০ টনের বিয়ারিং বসানো হয়। সাধারণত সেতুতে বিয়ারিং বসানো হয় দুটি করে। কিন্তু পদ্মা সেতুতে দুই স্প্যানের সংযোগস্থলে তিনটি করে বিয়ারিং ব্যবহার করা হয়েছে। সবকিছুই সম্ভব হয়েছে চীনা প্রযুক্তির কল্যাণে। সর্বোচ্চ ১২২ মিটার গভীর পর্যন্ত এই সেতুর পাইল বসানো হয়েছে। ভূমিকম্প প্রতিরোধ বিবেচনায় ব্যবহৃত হয়েছে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি। আর প্রযুক্তি-প্রকৌশলে পাঁচটি বিশ্বরেকর্ড স্পর্শ করেছে পদ্মা সেতু। গভীরতম পাইল ও পেন্ডুলাম বিয়ারিংয়ের অন্যতম। পৃথিবীর বড় বড় তিনটি ড্রেজার আনা হয়েছিল। সেগুলোর মাধ্যমে নদীর তলায় ৮শ কেজির জিওব্যাগে তুলনামূলকভাবে মোটা বালি ভরে বটম লেয়ার বা স্তর তৈরি করা হয়েছে। এ ছাড়া পদ্মা সেতুর রেল সংযোগ প্রকল্পে চীনের অর্থায়নে চায়না রেলওয়ে গ্রুপ লিমিটেডের প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে কংক্রিটের স্লিপার ব্যবহার করে রেল ট্র্যাক তৈরি করা হয়। এ ছাড়া সেতুটি নির্মাণে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়, যা দ্রুত এবং উন্নতমানের কাজ নিশ্চিত করেছে। রেললাইন তৈরি ও ট্র্যাক স্থাপন করা হয় আধুনিক চীনা প্রযুক্তিতে, যার মধ্যে রয়েছে কংক্রিটের স্লিপার ব্যবহার।
কর্ণফুলী টানেল তৈরির জন্য ৫শ কোটি টাকা দামের খনন যন্ত্র আনা হয়
২০২৩ সালের অক্টোবরে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত হয় দেশের প্রথম টানেল। এর মাধ্যমে নদীর তলদেশে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম সড়ক টানেলের উদ্বোধন করা হয়। প্রকল্পে টানেল বোরিং মেশিন (টিবিএম) প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। এটা বিশাল ও শক্তিশালী এক ধরনের যন্ত্র, যা নদীর তলদেশ দিয়ে সুড়ঙ্গ খনন করতে সক্ষম। এই বিশেষ টিবিএম মেশিনটি ছিল দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড়, যা প্রায় ৫শ কোটি টাকা ব্যয়ে দেড় বছর ধরে চীনের চাংশু এলাকায় তৈরি করা হয়। এটি টানেল নির্মাণের জন্য ব্যবহৃত একটি স্বয়ংক্রিয় খনন যন্ত্র, যা ঘুরন্ত কাটার হেড দিয়ে মাটি ও পাথর কেটে সুড়ঙ্গ তৈরি করে। এই উন্নত প্রযুক্তি ছাড়া টানেল নির্মাণ কঠিন হতো।
আরও যেসব প্রকল্পে বিনিয়োগ করছে চীন
পদ্মা সেতু রেল লিংক, দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগার প্ল্যান্টের মতো জনগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পও বাস্তবায়ন হয়েছে চীনের অর্থায়নে। অর্থায়নের পাশাপাশি ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পেও ছিল চীনের বড় বড় কোম্পানির অংশগ্রহণ। ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কিছু কিছু পিলারের কাজও দৃশ্যমান। ২৪ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যবিশিষ্ট এক্সপ্রেসওয়েটির নির্মাণকাজ পুরোদমে চলছে। মোট এক হাজার ৯৬০টি পিলারের মধ্যে এক হাজার ২০০টি পিলার দাঁড়িয়ে গেছে। সার্বিক অগ্রগতি ৫০ শতাংশ। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৭ হাজার ৫৫৩ কোটি চার লাখ টাকা। এর মধ্যে চীনের এক্সিম ব্যাংক ঋণ হিসেবে দিচ্ছে ৯ হাজার ৬৯২ কোটি টাকা। বাকি সাত হাজার ৮৬০ কোটি টাকা দেবে বাংলাদেশ সরকার। চীনা ঋণে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে চায় অন্তর্বর্তী সরকার। গত মার্চে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের চীন সফরের পর প্রকল্পটি এগিয়ে নিতে কাজ শুরু হয়। প্রকল্প বাস্তবায়নে চীনের কাছে ৬ হাজার ৭শ কোটি টাকা চেয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। সরকারের নীতিনির্ধারকরা বলছেন, এ বছরের মধ্যেই আর্থিক চুক্তিতে (ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাগ্রিমেন্ট) সই করতে পারে দুই দেশ। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বলছে, এরই মধ্যে চীনের রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত সংস্থা প্রকল্পের সমীক্ষা করেছে। প্রকল্পটির পুরো নাম ‘কম্প্রিহেনসিভ ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড রেস্টোরেশন অব তিস্তা রিভার প্রজেক্ট’ বা তিস্তা নদীর সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা ও পুনরুদ্ধার প্রকল্প। জানতে চাইলে পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, ‘তিস্তা প্রকল্প চীনের ঋণে বাস্তবায়নে বর্তমান সরকারের আগ্রহ রয়েছে। চীনও প্রকল্পটিতে বিনিয়োগ করতে চায়। দুই পক্ষের সম্মতিতেই বিষয়টি অগ্রসর হচ্ছে। চলতি অর্থবছর চীনের সঙ্গে হওয়া ঋণচুক্তির ফলে চারটি প্রকল্প খুব দ্রুতই আবার গতি ফিরে পাবে।
ক্রমে বাড়ছে চীনা ঋণ
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) জানায়, যেখানে স্বাধীনতার পর থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত মাত্র ২৭০ মিলিয়ন ডলারের ঋণ দিয়েছিল দেশটি, সেখানে গত ১২ বছরে দিয়েছে ৬ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার। এই সময়ে প্রতিশ্রুত ঋণ ১০ দশমিক ২৯ বিলিয়ন ডলার। ঋণ দেওয়া উন্নয়ন সহযোগীদের মধ্যে পঞ্চম স্থানে উঠে এসেছে চীন। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি ঋণ নিয়েছে বিশ্বব্যাংক থেকে, যা মোট ঋণের ৩১ শতাংশ। এরপরই রয়েছে এডিবি ২৩ শতাংশ এবং মোট ঋণের ১৭ শতাংশ জাপানের কাছ থেকে নেওয়া। এরপরই রাশিয়া ১০ শতাংশ এবং মোট ঋণের ৯ শতাংশ নেওয়া চীনের কাছ থেকে। গত এক দশকে চীনের প্রতিশ্রুত ঋণ ও ঋণছাড় দুটোই বেড়েছে। ২০১৩ সালে চীনের ঋণ দেওয়ার অঙ্গীকার ছিল ৩৫ দশমিক ৯৮ কোটি ডলার। ছাড় করে ৭ দশমিক ৭ কোটি ডলার। ২০১৪ সালের প্রতিশ্রুতি ছিল ৫ কোটি ডলার, ঋণছাড় করে ৪৭ দশমিক ২৭ কোটি ডলার। মূলত ২০১৪ সাল থেকে চীনা ঋণের প্রবাহ ও ছাড় বাড়তে থাকে। ২০১৫ সালে চীন কোনো ঋণের প্রতিশ্রুতি না দিলেও ১২ দশমিক ১২ কোটি ডলার ছাড় করে। এর পরের পাঁচ বছরে ঋণছাড় ছিল ভালো মাত্রায়। ২০২০ সালে চীন ২৪২ দশমিক ৭৪ কোটি ডলার ঋণের প্রতিশ্রুতি দেয় এবং ছাড় করে ৬৯ দশমিক ৫৪ কোটি ডলার। ২০২১ সালে কোনো প্রতিশ্রুতি না থাকলেও ৮৮ দশমিক ৭৯ কোটি ডলার ছাড় করে দেশটি। ২০২২ সালে প্রতিশ্রুত ঋণ ১১২ দশমিক ৬৯ কোটি ডলার, ছাড় ৯৮ দশমিক ৯৫ কোটি ডলার। ২০২৩ সালে ২৭ দশমিক ৬২ কোটি ডলার প্রতিশ্রুত ঋণের বিপরীতে ছাড় ১১৩ দশমিক ২৭ কোটি ডলার। এ ছাড়া ভারতের সঙ্গে যেভাবে টাকা-রুপিতে লেনদেনের সিদ্ধান্ত হয়েছে, সেই ধারাবাহিকতায় টাকা-ইউয়ানে লেনদেনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হতে পারে। এ বিষয়ে দুই দেশের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক সইয়ের প্রস্তুতি চলছে।
চীনা ঋণের সিংহভাগ এসেছে গত ৬ বছরে
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্যে দেখা যায়, স্বাধীনতার পর থেকে চীন বাংলাদেশকে যে পরিমাণ ঋণ দিয়েছে তার ৯৫ শতাংশই এসেছে গত ১২ বছরে। শেষ ছয় বছরে এসেছে ৮৫ শতাংশ। ২০১৯-২০ অর্থবছরের তুলনায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে দ্বিগুণ হয়েছে দেশটির ঋণছাড়। অর্থাৎ, ২০১৩ সালে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ বা বিআরআই (এক অঞ্চল, এক পথ) চালুর পর থেকেই বড় আকারে ঋণ দেওয়া শুরু করে। জানা যায়, ২০১৬ সালের অক্টোবরে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের বাংলাদেশ সফরের সময় ২৭টি প্রকল্প চূড়ান্ত করা হয়। এসব প্রকল্পে প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দেয় দেশটি। যার মধ্যে ১০ বিলিয়ন ডলার ঋণের চুক্তি হয়েছে। তিন বিলিয়ন ডলারের ঋণ চুক্তির অপেক্ষায়। বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে গতি আসার সঙ্গে সঙ্গে সাধারণত অর্থছাড়ও বাড়ে। চীনের প্রায় ৩০টি কোম্পানি বাংলাদেশের বিশেষ চীনা শিল্প অর্থনৈতিক অঞ্চলে ১০০ কোটি ডলার বিনিয়োগের অঙ্গীকার করেছে। এই অঙ্গীকার প্রধান উপদেষ্টা বেসরকারি খাতকে বাংলাদেশের উৎপাদন শিল্পে বিনিয়োগ করতে আহ্বান জানানোর পর এসেছে। ইআরডির তথ্যমতে, গত বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত বহুপক্ষীয় এবং দ্বিপক্ষীয় উন্নয়ন অংশীদারদের কাছে বাংলাদেশের মোট ঋণের স্থিতি ছিল ৬২ দশমিক ৩১ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে চীনের অংশ ৫ দশমিক ৩৭ বিলিয়ন ডলার, যা মোট ঋণের ৮ দশমিক ৬২ শতাংশ। বাংলাদেশের ঋণের স্থিতিতে চীনের অবস্থান চতুর্থ। চীন সরকার সাধারণত দুই ধরনের ঋণ দেয়, এর একটি হলো মার্কিন ডলারে প্রেফারেনশিয়াল বায়ার্স ক্রেডিট (পিবিসি) এবং অন্যটি চীনের নিজস্ব মুদ্রায় গভর্নমেন্ট কনসেশনাল লোন (জিসিএল)।
চীনা ঋণে চলমান ছয় প্রকল্প
চীনা ঋণে চলমান ছয় প্রকল্প হচ্ছেÑ চট্টগ্রামের সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং বা এসপিএম, ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, পিজিসিবির আওতায় বিদ্যুতের সঞ্চালন লাইনের উন্নয়ন, ডিপিডিসির আওতায় বিদ্যুতের বিতরণ ব্যবস্থার উন্নয়ন, জাতীয় তথ্যপ্রযুক্তির নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ এবং রাজশাহী ওয়াসার ভূ-উপরিস্থ পানি সরবরাহ প্রকল্প। কক্সবাজারের মহেশখালীতে সাগরের তলদেশ দিয়ে তেল সরবরাহের জন্য নির্মিত পাইপলাইন এখন উদ্বোধনের অপেক্ষায়। এটি সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং বা এসপিএম প্রকল্প নামে পরিচিত। এর আগে, গত বছরের জুলাইয়ে রাজধানীর আফতাবনগরের কাছে দাশেরকান্দিতে চালু হয় দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম একক পয়ঃশোধনাগারের কার্যক্রম। ঋণের বাইরে অনুদানের টাকায় বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত আটটি মৈত্রী সেতু নির্মাণ করেছে চীন।
কমবে সহজ শর্তের ঋণ, বাজারভিত্তিক বড় ভরসা চীন
স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উত্তরণের (এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন) আগেই বাংলাদেশের নমনীয় বা সহজ শর্তের ঋণপ্রবাহ ক্রমাগত কমছে। এতে ব্যয়বহুল হয়ে পড়ছে বৈদেশিক ঋণ। এমনকি গত অর্থবছরে সরকারের মোট বৈদেশিক ঋণের প্রায় অর্ধেকই বাজারভিত্তিক হারে নেওয়া হয়েছে। এলডিসি উত্তরণের পর সহজ শর্ত বা নমণীয় ঋণের ওপর আরও প্রভাব পড়বে। তখন বাজারভিত্তিক ঋণের প্রবাহ আরও বাড়বে। বাজারভিত্তিক ঋণের প্রবাহ বাড়লে দেশের উন্নয়নে চীন বড় ভরসা হবে বলে দাবি অর্থনীতিবিদদের। ইআরডির তথ্য অনুযায়ী, সরকারের বাজারভিত্তিক ভাসমান সুদহারের ঋণ বড় আকারে উল্লম্ফন হয়েছে। বর্তমানে এলডিসি হিসাবে থাকার পরও বাংলাদেশ ২০২৪-২৫ অর্থবছরে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে যে ঋণ নিয়েছে তার ৪২ দশমিক ৭ শতাংশই বাজারভিত্তিক ঋণ। এর আগের অর্থবছরে এ ধরনের ঋণের পরিমাণ ছিল মাত্র ২৮ দশমিক ২ শতাংশ। গত দুই অর্থবছর ধরে চীনের কোনো ঋণে সুদ বাড়েনি। তবে চীন ডলারে নির্দিষ্ট সুদে ঋণ না দিয়ে বাজারভিত্তিক হার এবং তাদের নিজস্ব মুদ্রা ইউয়ানে (আরএমবি) ঋণ দিতে আগ্রহী। বর্তমানে চীনা ঋণের সুদহার ২ শতাংশ।
সম্পর্কের নতুন অধ্যায়
চলতি বছরের মার্চে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস চীনে সরকারি সফরে যান। আলোচনায় ছিল বাণিজ্য ভারসাম্য, বিনিয়োগ, প্রযুক্তি স্থানান্তর ও ঋণ পুনর্গঠন। চীন বাংলাদেশকে সবুজ জ্বালানি ও শিল্পাঞ্চল উন্নয়নে সহযোগিতা আশ্বাস দেয়। তিন মাস পর জুনে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির প্রতিনিধিরা চীন সফর করে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নেতৃত্বে দলীয় প্রতিনিধি দল চীনে যায়। আলোচনায় উঠে আসে উন্নয়ন অভিজ্ঞতা বিনিময়, রাজনৈতিক বোঝাপড়া ও বিনিয়োগ সহযোগিতা।
পরের মাসে অর্থাৎ জুলাইয়ে জামায়াতে ইসলামী প্রতিনিধি দল চীন সফর করে। তারা চীনা থিঙ্কট্যাঙ্কের সঙ্গে বৈঠক করে ইসলামী অর্থনীতি, মানবসম্পদ উন্নয়ন ও বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে বাংলাদেশের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করেন। পরের মাস আগস্টে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল চীন সফর করে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এসব সফর বাংলাদেশের ‘বহুমুখী কূটনীতি’ নীতিরই প্রতিফলন। পশ্চিমা চাপের বিপরীতে চীনের অ-হস্তক্ষেপমূলক সহযোগিতা ঢাকার কাছে কার্যকর বিকল্প। চীনও বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চলে প্রভাব বাড়াতে বাংলাদেশের অবস্থান কৌশলগতভাবে দেখছে।

