যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজায় সাত কিলোমিটার লম্বা একটি টানেল খুঁজে পাওয়ার দাবি করেছে ইসরাইলের প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ)। টানেলটি রাফা এলাকার শরণার্থী সংস্থার কম্পাউন্ড, মসজিদ, ক্লিনিক ও স্কুলের নিচ দিয়ে গেছে। তারা বলছে, টানেলটি ২৫ ফুট গভীর, এর মধ্যে ৮০টি গোপন কক্ষ রয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত এক ভিডিওতে দেখা গেছে, মাটির নিচে ওই সুড়ঙ্গে থাকার যাবতীয় ব্যবস্থা রয়েছে। বাহিনীটির দাবি, ওই টানেলেই ইসরায়েলের লেফটেন্যান্ট হাদার গোল্ডিন-এর মরদেহ রাখা হয়েছিল। তিনি ২০১৪ সালে হামলার পর নিখোঁজ ছিলেন। হামাস কমান্ডাররা অস্ত্র সংরক্ষণ, আক্রমণ পরিকল্পনা ও বসবাসের জন্য এই টানেলটি ব্যবহার করত। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী গাজার টানেলটি তল্লাশি করার সময় সিনিয়র হামাস কমান্ডারদের ব্যবহৃত কক্ষ খুঁজে পেয়েছে। যার মধ্যে মে মাসে হামাস নেতা মোহাম্মেদ সিনওয়ার-এর সঙ্গে নিহত হওয়া মোহাম্মাদ শাবানার কক্ষও রয়েছে। ইসরায়েল হামাসের মারওয়ান আল-হামস নামে এক সদস্যকে গ্রেফতার করেছে। তিনি লেফটেন্যান্ট গোল্ডিনের মৃত্যুর সঙ্গে সম্পৃক্ত ও টানেলের কোথায় তার মরদেহ রাখা হয়েছে তা জানতেন। গোল্ডিনকে উদ্ধার করে ইসরায়েলে সমাধিস্থ করাই ছিল এই অভিযানের লক্ষ্য। আইডিএফের জানিয়েছে, টানেলটি খুঁজে বের করেছে ‘এলিট ইয়াহালোম কমব্যাট ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিট’ ও ‘দ্য শায়েতেত ১৩ নেভাল কমান্ডো ইউনিট’।
পোস্টে বলা হয়েছে, ৭ কিলোমিটার লম্বা টানেলটি গাজার দক্ষিণের ঘনবসতিপূর্ণ রাফা শহরের নিচ দিয়ে গিয়েছে। এ ছাড়া জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থী সংস্থা ইউএনআডিব্লিউএ, শিশুদের স্কুল, হাসপাতাল এবং মসজিদের মধ্য দিয়ে টানেলটি গিয়েছে বলেও দাবি করেছে আইডিএফ।ইসরাইলি সেনাবাহিনী আরও দবি করে, হামাস কমান্ডাররা অস্ত্র সংরক্ষণ, আক্রমণ পরিকল্পনা এবং বসবাসের জন্য এই টানেলটি ব্যবহার করত। আইডিএফের তথ্যমতে, নতুন সন্ধান পাওয়া টানেলটি সাত কিলোমিটার লম্বা, ২৫ ফুট গভীর এবং ভেতরে অন্তত ৮০টি গোপন কক্ষ রয়েছে। ইসরাইলি সংবাদমাধ্যম টাইমস অব ইসরাইলের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৪ সালে হামাসের হাতে নিহত ইসরাইলের সেনা সদস্য হাদার গোল্ডইনকে এই সুড়ঙ্গে রাখা হয়েছিল। প্রায় ১১ বছর পরে চলতি নভেম্বর মাসের শুরুতে সেখান থেকেই গোল্ডইনের দেহাবশেষ খুঁজে পায় ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী। গাজা শহরের মাটির নিচে হামাসের তৈরি করা গোপন টানেল নেটওয়ার্কের একাংশে আক্রমণের কথা জানিয়েছে ইসরায়েল। শনিবারের হামলার ঘটনার পর পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে হামাসকে লক্ষ্য করে নিরবচ্ছিন্ন আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে দেশটি। ইসরায়েল ডিফেন্স ফোর্সের (আইডিএফ) একজন মুখপাত্র বৃহস্পতিবার এক ভিডিও বার্তায় বলেছেন, “গাজা উপত্যকার একটি স্তর বেসামরিক নাগরিকদের এবং আরেকটি স্তর আছে হামাসের জন্য। আমরা হামাসের তৈরি করা সেই দ্বিতীয় স্তরটিতে পৌঁছানোর চেষ্টা করছি”। তাদের দাবি, “এসব বাংকার গাজার বেসামরিক নাগরিকদের জন্য নয়। এটা শুধু হামাস আর অন্য সন্ত্রাসীদের জন্য, যাতে করে তারা ইসরায়েলের ভূখ- লক্ষ্য করে রকেট হামলা বা সন্ত্রাসী কার্যক্রম কিংবা এ ধরনের অপারেশনের পরিকল্পনার জন্য ব্যবহার করতে পারে।’ এই টানেল নেটওয়ার্কের আকার সম্পর্কে ধারণা করা কঠিন, যাকে ইসরায়েল বলছে ‘গাজা মেট্রো’, কারণ মনে করা হয় এটা এমন একটা এলাকার নিচে বিস্তৃত, যা লম্বায় প্রায় ৪১ কিলোমিটার আর প্রস্থে ১০ কিলোমিটার। ২০২১ সালের সংঘাতের পর আইডিএফ বিমান হামলা করে ১০০ কিলোমিটারেরও বেশি টানেল ধ্বংসের দাবি করেছিল। হামাস তখন বলেছিল যে তাদের টানেল ৫০০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এবং এর মাত্র পাঁচ শতাংশ আক্রান্ত হয়েছে। টানেল সংক্রান্ত এসব তথ্য বোঝার জন্য যেটা উল্লেখ করা যায়, তা হলো পুরো লন্ডন শহরের আন্ডারগ্রাউন্ডের দৈর্ঘ্য ৪০০ কিলোমিটারের মতো।
গাজায় টানেল নির্মাণ শুরু হয় ২০০৫ সালে ইসরায়েল সৈন্য ও বসতি স্থাপনকারীদের প্রত্যাহারের আগে থেকেই। তবে এর গতি বাড়ে দু বছর পর হামাস গাজার নিয়ন্ত্রণ পাওয়ার পর। ফলে নিরাপত্তাজনিত কারণে ইসরায়েল ও মিসর পণ্য পরিবহন ও মানুষের আসা-যাওয়ার ওপরে কড়াকড়ি আরোপ শুরু করে। একপর্যায়ে মিসর সীমান্তে প্রায় আড়াই হাজার টানেল হামাস ও অন্য সশস্ত্র গোষ্ঠী ব্যবহার করেছে বাণিজ্যিক পণ্য, তেল ও অস্ত্র চোরাচালানের জন্য।২০১০ সালের পর গাজায় চোরাচালানের গুরুত্ব কমে যায় কারণ ইসরায়েল তাদের ক্রসিং ব্যবহার করে বেশি পণ্য আমদানির সুযোগ দেয়া শুরু করে। পরে মিশর কিছু টানেল ধ্বংস করে বা বন্যার পানিতে ভাসিয়ে দেয়।হামাস ও অন্য গ্রুপগুলোও তখন ইসরায়েলি বাহিনীর ওপর হামলার জন্য নতুন করে টানেল খনন শুরু করে।২০০৬ সালে ইসরায়েল সীমান্তে এমন টানেল ব্যবহার করে দুজন ইসরায়েলি সেনাকে হত্যা করে এবং আরেকজনকে তুলে নেয়া হয়, যাকে পরে পাঁচ বছর জিম্মি রাখা হয়েছিলো।
২০১৩ সালে আইডিএফ ১ দশমিক ৬ কিলোমিটার লম্বা ও ১৮ মিটার গভীর টানেল আবিষ্কার করে, যার ছাদ ও দেয়াল ছিলো কংক্রিটের তৈরি। এটি গাজা উপত্যকা থেকে শুরু করে ইসরায়েলের কিবুতয এলাকার কাছাকাছি পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। স্থানীয় অধিবাসীরা বিচিত্র শব্দ শোনার পর ইসরায়েলিরা এটিকে চিহ্নিত করে।পরের বছর নিজেদের প্রতি হুমকি দূর করতে এ ধরনের ‘সন্ত্রাসী টানেল’গুলোকে নিশ্চিহ্ন করার প্রয়োজন বোধ করে ইসরায়েল।
আইডিএফ পরে ৩০ কিলোমিটারের বেশি টানেল ধ্বংস করে দেয়ার দাবি করে।

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন