বুধবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


এ. এন. রাশেদা

প্রকাশিত: নভেম্বর ২৫, ২০২৫, ১১:৫৮ পিএম

শিক্ষায় প্রত্যাশা আকাশচুম্বী, প্রাপ্তিতে যত খেদ

এ. এন. রাশেদা

প্রকাশিত: নভেম্বর ২৫, ২০২৫, ১১:৫৮ পিএম

শিক্ষায় প্রত্যাশা আকাশচুম্বী, প্রাপ্তিতে যত খেদ

আজ ২০২৫-এ শুধু শিক্ষাব্যবস্থা নয়, সব ব্যবস্থা মহাদুর্যোগে, ‘যেন দুর্যোগের ঘনঘটা’। তবে তা শুধু পনেরো বা ষোলো বছর ধরেই না। স্বাধীনতার পর থেকেই। স্বাধীনতার আগেও যা ছিল নানা আঙ্গিকে নানান মাত্রায়, তবে কম। নিজ চোখেই দেখেছি ছাত্ররা যা করত চুপিচুপি। তবে তা শুধু আমার দেখাÑ পুরো শিক্ষাব্যবস্থা না। আমাদের বাড়ির মাঠের একপাশে একটি লম্বা ঘর ছিল। তখন ম্যাট্রিক পরীক্ষার সময় গ্রামের কিছু শিক্ষার্থী এসে খুব কাছেই ‘কেরামতিয়া হাই স্কুল’-এ পরীক্ষা দিত। ওরা এক ইঞ্চি প্রস্থ এবং দীর্ঘ দৈর্ঘ্যরে কাগজে খুব ক্ষুদ্রাকারে প্রশ্নের উত্তর লিখে নিত। পরীক্ষা শেষে আনাচে-কানাচে ওই সব স্তূপাকারে পড়ে থাকাতে আমাদের চোখে পড়ত। তবে শিক্ষকরা জড়িত ছিলেন বলে তখন শুনিনি। স্বাধীনতার পর থেকে আশির দশকে পত্রপত্রিকায় দেখেছি ‘পরীক্ষা কেন্দ্রের পাশে যেন হাট বসেছে’Ñ বলে পত্রিকার শিরোনাম। মাইকে প্রশ্নের উত্তর বলে দেওয়া, পাইপ বেয়ে দোতলায় উঠে প্রশ্নের উত্তর দিয়ে আসা ইত্যাদি। আবার পরবর্তী সময়ে স্কুুলকে চ্যাম্পিয়ন ঘোষণার ফলে দেখা গেল শিক্ষকরাই নকল সাপ্লাই করছেন এবং তাদের প্রটেক্ট করছেনÑ ‘সেরা স্কুল’ হওয়ার তকমা পাওয়ার জন্য। আবার প্রাথমিকে সমাপনী পিইসিই এবং অষ্টম শ্রেণিতে জেএসসি পরীক্ষায় একই ঘটনাÑ সেরা স্কুল হওয়ার প্রতিযোগিতায় শিক্ষকদের জড়িয়ে যাওয়া। এ তো একটি দিক মাত্র শিক্ষাব্যবস্থার। আর পুরো শিক্ষাব্যবস্থা যারা পরিচালনা করেনÑ শিক্ষা বোর্ড, শিক্ষা ভবন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, টেক্সট বুক বোর্ড, অডিট ইনম্পেকশন কমিটিÑ ইত্যাদি যা কিছু আছে, তারা হয়তো বা ১ শতাংশ বাদে দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত। আমি দুয়েকজনকে চিনতাম যারা সততার সঙ্গে কাজ করতেন। আর এসব দুর্নীতির কারণে ফাইল আটকে থাকে এবং শিক্ষা, শিক্ষক তথা সমগ্র দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়Ñ তার সামান্য কিছু নমুনা তুলে ধরব তা হয়তো হাজারের একভাগ হবেÑ যেসব পত্রিকার শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছিল। এসব থেকে আমরা একটু অতীত স্মরণ করতে পারি, ভবিষ্যতে সেখান থেকে যদি উত্তরণ ঘটানো যায়Ñ এই প্রত্যাশায়। কে না জানে কোনো কিছু উন্নয়নের পেছনে অর্থের প্রয়োজন। ইউনেস্কোর সুপারিশে উন্নয়নশীল দেশের জন্য জিডিপির ৭ শতাংশ এবং বাজেটের ৩০ শতাংশ বরাদ্দ করার কথা বলা হয়েছে। ১৯৭৩-৭৪ সালে বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ ছিল ২০ শতাংশ। কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের পর ক্রমে তা কমে আসে বাজেটের ৯ শতাংশে এবং তার সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতকে। তা হলে শিক্ষার উন্নয়ন কীভাবে সম্ভবপর হবে? দ্বিতীয় কথা মানসম্পন্ন এবং প্রয়োজনীয় শিক্ষক ও বর্তমানে প্রাথমিক থেকে কলেজ পর্যায়ের স্নাতক ও মাস্টার্স পর্যন্ত প্রচ- শিক্ষক স্বল্পতা। মাস্টার্স ডিগ্রিপ্রাপ্তরা এই পেশায় আসছে কিন্তু সুযোগ পেলে চলে যাচ্ছে। কারণ এ পেশাকে সম্মানজনক করা হয়নি, তাই।


১৯৭৪ সালে ড. খুদা কমিশনের রিপোর্ট যে কারণে বাস্তবায়ন শুরু করতে পারেনি বঙ্গবন্ধুর সরকার তা হলোÑ কতিপয় আমলার বিরোধিতা। ঠিক তেমনি ২০১০ সালের শিক্ষানীতি সম্পর্কে পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছেÑ ‘আমলাদের অদূরদর্শিতায় এগুচ্ছে না জাতীয় শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের কাজ : হতাশ শিক্ষানীতি প্রণয়নকারীরা।’


সকল উন্নয়নের মূল উপাদান হচ্ছেÑ শিক্ষা ও শিক্ষিত জনগোষ্ঠী। অথচ ১৯৯০ সালে পত্রিকায় শিরোনাম হয়েছিল ‘স্কুলগৃহ জরাজীর্ণ, ছাদ ধসে পড়ছে, ছাত্ররা গাছতলায় ক্লাস করছে, স্কুলে শিক্ষক নেই ইত্যাদি। আর সে বছর ১৯৯০ সালে এসএসসি পরীক্ষায় পাসের হার ছিল ৩১ দশমিক ৭৩ শতাংশ। অথচ ১৯৮৯ সালে এ হার ছিল ৪২ দশমিক ৯০, ১৯৮৮ সালে ছিল ৫৪ দশমিক ২১, ১৯৮৭ সালে ছিল ৫৯ দশমিক ৯৮ এবং ১৯৮৬ সালে ছিল ৬৬ দশমিক ৩৯ শতাংশ। দেখা যাচ্ছে যে, ক্রমান্বয়ে উন্নতি না হয়ে হয়েছে অবনতি। 
১৯৯১ সালের জুলাই-আগস্টের কিছু খবর দেখা যায়। ‘দেশের বিভিন্ন স্থানে ৮০টি বড় কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে তালা ঝুলছেÑ জাতীয় সংসদেও তা আলোচিত হয়েছে।’ ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাপক পরিমাণ অস্ত্র পাওয়া গেছে।’ 


১৯৯৪ সালের মার্চ মাসে স্কুল-কলেজের শিক্ষকরা আন্দোলনে নেমেছিলেন। কারণ ১৯৯১ সালে সরকারি প্রতিষ্ঠানে নতুন পে-স্কেল ঘোষণা দেওয়া হলেও বেসরকারি শিক্ষক ও কর্মচারীরা বেতনের যে ৭০ শতাংশ সরকারিভাবে পেতেন, তা স্কেলের আওতায় আনার ঘোষণা দেওয়া হয়নি। অর্থাৎ শিক্ষা এবং শিক্ষক যে শাসকদের চোখে অবহেলিত এটা তার একটি প্রমাণ। শিক্ষককে যদি তার সম্মানজনক পারিশ্রমিকের জন্য রাস্তায় নেমে আন্দোলন করতে হয়, তা হলে সেই দেশে শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতি হবে কীভাবে এবং দেশের উন্নতি বা হবে কী ভাবে?Ñ এইটি আসল প্রশ্ন।


এবার ২০১১ সালের কিছু খবর জানা যাক। ২০১১ সালের মধ্যে দেশের সব শিশুকে বিদ্যালয়ে আনার লক্ষ্য  ঘোষিত হয়েছিল ২০০৯ সালে এবং নিবন্ধিত হয়েছিল ১৯ লাখ ৭৯ হাজার ৮৯৫ জন শিশু শিক্ষার্থী। পরীক্ষা দিয়েছিল ১৮ লাখ ২৩ হাজার ৪৬৫ জন এবং পাস করেছিল ১৬ লাখ ২০ হাজার ৫৪ জন। এর অর্থ হলো পঞ্চম শ্রেণিতে আসার আগেই ঝরে গেছে ৩ লাখ ৫৯ হাজার ৮৪১ জন শিশু শিক্ষার্থী। পরিসংখ্যান দেওয়ার অর্থ হলো শুধু লক্ষ্য নির্ধারণ করলেই হবে না। সেই লক্ষ্য পূরণে চাই পৃথক ব্যবস্থা। স্কুলে প্রয়োজনীয় শিক্ষাকে খেলারছলে হৃদয়গ্রাহী করা, নাচ-গানে আনন্দময় করা। সারা বিশ্বের স্বীকৃত পথ হলো শিক্ষার্থীদের নাচ-গান, খেলাধুলার মাধ্যমে বেড়ে উঠতে সহায়তা করা। আর আমাদের দেশে এর সঙ্গে যুক্ত হতে হবে পরিবারের সক্ষমতা। অর্থাৎ সন্তানকে স্কুলে পাঠিয়ে বাবা-মায়ের যেন মনে না-হয় শিশুকে কাজে পাঠালে তাদের অভাবের তাড়না কিছুটা কম হতো।  সেজন্য প্রয়োজন শিক্ষাবৃত্তি। আর এসবের জন্যই তো প্রয়োজন শিক্ষা খাতে জিডিপির ৭ শতাংশ বরাদ্দ দিয়ে তা সম্ভবপর করা।


একে তো বরাদ্দ কম, অনদিকে লুটপাট। এবার লুটপাটের দুয়েকটি নমুনা তুলে ধরা যাক। সেপ্টেম্বর ২০১২ সালের প্রকাশিত খবরÑ ‘দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা : ৮টি এডিবির লাল তালিকাভুক্ত’, ‘শিক্ষার মানোন্নয়ন প্রকল্পের গাড়ি নিয়ে বিলাসিতা’, ‘সরকারি কলেজগুলোতে চার হাজার শিক্ষকের পদ শূন্য’, ‘১১ সরকারি স্কুলে কলেজ শাখার ক্লাস নেয়া হচ্ছেÑ স্কুলশিক্ষকদের দিয়ে’, ‘ফিজিওথেরাপি কলেজে নানা সমস্যা চলছে’,  ‘কারিগরি শিক্ষার বেহাল দশাÑ শিক্ষক সংকট, শ্রেণিকক্ষের অভাব, শিক্ষক নিয়োগ না দিয়েই দ্বিতীয় শিফট চালু, পদোন্নতি নেই, মান্ধাতার আমলের সিলেবাস’Ñ এই শিরোনাগুলোই তো বলে দিচ্ছে শিক্ষার সংকটের কথা। একটি ভালো খবর ছিলÑ ’৮৬ লাখ ছাত্রছাত্রীকে বিনা মূল্যে সহায়ক বই দিবে সরকার’। তারপরও কথা থাকবেÑ স্কুলে শিক্ষক তো লাগবে, তার যোগান কোথায়। 
২০১২ সালের নভেম্বরে প্রকাশিত হয়েছেÑ ‘সংকটে বিপর্যন্ত সরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট : উদাসীন শিক্ষা মন্ত্রণালয়’Ñ তার মানে, এর জন্য দায়ী ওই আমলারাই। ‘প্রাথমিক শিক্ষার টাকা লুটপাট’Ñ এটা তো সাধারণ মানুষ, খেতে না পাওয়া মানুষজন করে নাÑ এই যখন অব্যবস্থা, তার বিরুদ্ধে ভুক্তভোগীদের তো ফুঁসে উঠতেই হবে। তাই শিক্ষক নেতাদের দেয় আলটিমেটামÑ ’৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে দাবি না-মানলে ১২ জানুয়ারি থেকে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট।’ ধর্মঘট তো বিনা কারণে কেউ ডাকে না। আর শিক্ষকদের অভুক্ত রেখে অসম্মান করে জাতিকে উন্নত করাও যায় নাÑ তার প্রমাণ তো বর্তমান সময়ে ছাত্রসমাজ ও জনগণ দেখাচ্ছে। 
ওই বছরের ডিসেম্বর মাসে শিক্ষাক্ষেত্রে আশা ও নিরাশার খবরÑ দুই-ই প্রকাশিত হয়েছে। এক পত্রিকার খবরে দেখা যাচ্ছে ‘শিক্ষা খাতে সাফল্য অব্যাহত আছে। গতি এসেছে স্কুল ও কলেজের একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রমে আর আমলাতন্ত্রের গাফিলতিতে থমকে গেছে বহুল আলোচিত শিক্ষানীতি-২০১০। ঝিমিয়ে পড়েছে শিক্ষা-আইন কার্যক্রমও। অব্যবস্থাপনায় ডুবছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। বুঝতে বাকি থাকে না কলেজ পর্যায়ে কী নিদারুণ অবস্থা বিরাজ করছে। কোনো ক্লাস হয় না। কোনো কলেজে কোনো বিষয়ে একটিও ক্লাস হয় না। 


তবে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নানামুখী পদক্ষেপ সারাদেশের প্রায় শতভাগ শিশুর প্রাথমিকে ভর্তি নিশ্চিত হয়েছে। আবার পৌনে চার কোটি শিক্ষার্থীকে বিনামূল্যে ২৭ কোটি পাঠ্যবই দিচ্ছে সরকার। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তো সে কথাই বলে। সবার জন্য অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা. চিকিৎসা ও বাসস্থানÑ মানুষের মৌলিক অধিকার। অথচ আজকাল ‘মুক্তিযুদ্ধেও চেতনা’Ñ কথাটি বলে ব্যঙ্গবিদ্রুপ করতে দেখা যাচ্ছ কাউকে কাউকে। প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাক্রম চালু হয়েছে প্রাথমিক বিদ্যালয়েÑ এটি ভালো খবর। আর খারাপ হলোÑ শিক্ষক নিয়োগের আগেই তা করার ফল ভালো হয়নি। তবে ২৪ হাজার রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করেছে সরকার। স্বাধীনতার পর ৩৭ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারিকরণ করেছিল বঙ্গবন্ধুর সরকার। অথচ ‘জাতীয়করণ’ শব্দটি ভুলভাবে প্রয়োগ করা হয়। সরকারিকরণ ও জাতীয়করণ শব্দ দুটি ভিন্ন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহকে প্রকৃত অর্থে সরকারিকরণ করা হয়েছে। কিন্তু জাতীয়করণ করলে প্রতিষ্ঠানসমূহের সম্পত্তি প্রতিষ্ঠানের থাকত, থাকত স্বায়ত্তশাসন। যাই হোক, সে সময়ে যে-সৃজনশীল পদ্ধতি চালু করা হয়েছিলÑ তা মোটেও সৃজনশীল ছিল নাÑ শুধু নম্বর প্রাপ্তির ব্যবস্থা ছিল। যা তা লিখেও পূর্ণ নম্বর পাওয়া যেত। আর বলেও দেয়া হতো। যার অর্থ দাঁড়ায় উত্তর ঠিক না হলেও পূর্ণ মার্কস যেন পায়। 


এবার ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে প্রকাশিত শিক্ষার আর কিছু খবরের দিকে দৃষ্টি দেয়া যাক। ‘শিক্ষক স্বল্পতায় বন্ধের উপক্রম ১৪১ সরকারি হাইস্কুল’। উপজেলা পর্যায়ের এই সব হাইস্কুল চলছে ৩ বা ৪ জন শিক্ষক দিয়ে। আর আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় নিয়োগ কার্যক্রম বন্ধ, জোড়াতালির শিক্ষাপ্রশাসন। আবার ‘প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক ফেডারেশন’ দাবি জানিয়েছেÑ সরাসরি প্রধান শিক্ষক পদে নিয়োগ বন্ধ করে সহকারী শিক্ষক পদ থেকে নিয়োগ দিতে। যোগ্যতা ও দক্ষতারভিত্তিতে বিভাগীয় পরীক্ষার মাধ্যমে সর্বোচ্চ পদ পর্যন্ত শতভাগ বিভাগীয় পদোন্নতির সুযোগ প্রদান করা হোক।’ 


২০১৬ সালের আরেক খবরে দেখা যাচ্ছে যে, বগুড়ার আজিজুল হক সরকারি কলেজে শিক্ষার্থী সংখ্যা ৩৭ হাজার, শিক্ষক ১৬২ জন আর ক্লাস হয় তিন মাস। ১৯৮৫ সালে ওই কলেজে একবার আমার যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। তখন বায়োলজি ডিপার্টমেন্টে শুধু একজন ডেমনস্ট্রেটর ছিলেন, কোনো শিক্ষক ছিলেন না। আর বাগেরহাট পিসি কলেজে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে ইন্টারমিডিয়েট, অনার্স মাস্টার্সের জন্য ছিলেন মাত্র একজন শিক্ষকÑ ’৯০-এর দশকে। এভাবেই চলছে সারা দেশ। এমন হাজার হাজার উদাহরণ দেওয়া যাবেÑ এরপর কীভাবে বলা যাবেÑ শিক্ষার্থীরা প্রকৃত অর্থে শিক্ষিত হয়ে উঠছে?


এই সৃজনশীলের অবিশ্বাসযোগ্য ফল ২০১৬ সলেই দেখা গেছে এসএসসিতে পাসের হারে ৮৮ দশমিক ২৯ অর্থাৎ অতিরিক্ত নম্বর দিয়ে। আবার সৃজনশীল প্রশ্নপত্র নিয়ে যত বাহাদুরি করা হোক, তা যে নিষ্ফল ছিলÑ তা বলাই বাহুল্য, তা সাংবাদিকদের চোখে এড়াবে কীভাবে। তাই পত্রিকায় খবর হয়েছিল, ‘সৃজনশীল প্রশ্ন : শিক্ষক প্রশিক্ষণেই ত্রুটি। প্রশিক্ষণ দায়সারা গোছের। প্রশিক্ষণ নেই কারিগরি শিক্ষকদেরও। কিন্তু ‘শিক্ষার মানোন্নয়নের নামে কর্মকর্তাদের প্রমোদ ভ্রমণে’ যা হয়, তা পত্রিকায় ফলাও করে প্রকাশিত হলেও আমলাদের কোনো ক্ষতি হয় না। ক্ষতি হয় শিক্ষাসহ সব ব্যবস্থার। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে যদি শিক্ষার্থীরা প্রকৃত শিক্ষা না পায় তা হলে তার প্রতিঘাত তো সমগ্র সমাজ দেহেই প্রবাহিত হয়; অশিক্ষিত, অদক্ষ জনশক্তিÑ কোনো দেশ বা জাতিকে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে নিতে পারে না।
কে না জানে, বিজ্ঞান শিক্ষা ছাড়া জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে কোনো দেশ অগ্রসর হতে পারে না। অথচ সেই কাজটি করা হয়েছে বিজ্ঞান শিক্ষায় শিক্ষক নিয়োগ না দিয়ে মেধাবী শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধ না করে এবং পঙ্গু বানিয়ে ফেলা হয়েছে যারা প্রাণের টানে বিজ্ঞান বিভাগে এসেছিল। এমপি, মন্ত্রী এবং আমলাদের দুর্নীতি ও অবহেলা যে কী মাত্রায় হতে পারেÑ তার কিছু নমুনা দেখা যেতে পারে ২০১৮ সালের এপ্রিলে প্রকাশিত খবরেÑ ‘পাঁচ বছরে মন্ত্রণালয় একজনও নিয়োগ দেয়নিÑ ২১ হাজার বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক পদ শূন্য’Ñ এও ভাবা যায়! আবার ৩৪০টি সরকারি হাই স্কুলে শিক্ষকের পদ শূন্য ২৮৭৫ জন। আবার স্কুল-কলেজ অনুমোদনে নৈরাজ্যের খবরও প্রকাশিত হয়েছে। ২০১৮ সালের এইচএসসি পরীক্ষায় অনুপস্থিত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১৩ হাজার ৭১৮ জন। এটা কি উন্নয়নের নমুনা? আবার ২০১৮ সালে পত্রিকার শিরোনাম হয়েছেÑ এমপিওভুক্ত মাদ্রাসায় লাগামহীন দুর্নীতি। অনেক মাদ্রাসায় শিক্ষার্থীর চেয়ে শিক্ষক বেশি। বেশ কিছু মাদ্রাসা থেকে কেউ পাস করতে পারেনি। আবার পুরনো শিক্ষকদের বরখাস্ত করে ইচ্ছেমতো শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে বাণিজ্য হচ্ছে। ২০১৭ সালে ঝালকাঠির এক মাদ্রাসায় পিইসিই ও জেডিসি পরীক্ষায় বহিরাগত ছাত্রছাত্রী দ্বারা পারীক্ষার্থী দেখানো হয়েছে। আর মাদ্রাসায় শিক্ষক দ্বারা ছাত্রীর শীøলতাহানির খবর তো আছেই। 


২০১৮ সালের জুলাইতে খবর প্রকাশিত হয়েছেÑ সংসদে প্রশ্নোত্তরপর্বে জনপ্রশাসনমন্ত্রী বলেছেনÑ সরকারি চাকরিতে তিন লাখ পদ খালি এবং এর মধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে সর্বাধিক। দেশে এত বেকার রেখে এর মানে কী দেশকে পঙ্গু করে দেয়ার ষড়যন্ত্র না? আবার শিক্ষক নিয়োগ ও এমপিওভুক্তিতে ঘুষ-দুর্নীতি যে বেড়েই চলেছে তা প্রতিরোধের কোনো ব্যবস্থা সরকার নিতে পারে না। খবরে প্রকাশ ‘এক হাজার ১৬৩ কোটি টাকার আইসিটি প্রকল্পের দুর্নীতিতে মাউশির মহাপরিচালক এবং প্রকল্পের পিডি জড়িত’। আবার ৩৫ হাজারের বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সরবরাহ করা মাল্টিমিডিয়া এখনো শিক্ষক সংকট, লোকবল ও অদক্ষতার কারণে প্যাকেটবন্দি অবস্থায় পড়ে আছে। এমন অনেক উদাহরণ দেয়া যায়।


২০২৩ সালের জুলাই মাসে প্রকাশিত হয়েছে ‘শিক্ষাক্যাডারে বঞ্চনাই নিয়তি’ ‘অচল সব কলেজ দপ্তর’, ‘মাউশিতে পদোন্নতির চাবি সিন্ডিকেটের হাতে : স্থায়ী জ্যেষ্ঠতার তালিকা নেই’, আবার ‘প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচিতে ১০ পদের দুর্নীতি’, ‘শতভাগ ফেল, তবুও চলছে কলেজগুলো’, ‘৭৫ জন পরীক্ষা দিয়ে ৭৩ জন ফেল’। আবার ১৫.০৭.২০২৩ তারিখে পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে : ‘আজ থেকে সব বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে তালা ঝোলানোর ঘোষণা : জাতীয়করণ করার দাবি’। ২৪.০৬.২০২৩-এ প্রকাশিত হয়েছে ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে অনিয়ম দুর্নীতির বাসা’Ñ এখানে নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে বলা হয়েছে। এমন খবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে প্রকাশিত হয়েছে।
৩০ নভেম্বর ২০১৯ প্রকাশিত হয়েছে :  ‘প্রতিষ্ঠান, শিক্ষার্থী সবাই ভুয়া : তাও এমপিওভুক্তির তালিকায়’, ‘আইসিটি প্রকল্পে দু’মাসে ৭৫ কোটি টাকা তসরুফ করেছে তিন কর্মকর্তা’, ‘সরকারি কলেজে শিক্ষক সংকটে বেহাল শিক্ষা’, ‘যত্রতত্র অনার্স আর নয়’. ‘মসজিদ-মাদ্রাসার উন্নয়নে রেকর্ডÑ আর তার ফল ১৯৭১-এর স্বাধীনতাবিরোধীদের উত্তরণে।


২০২৪-এ শিক্ষাব্যবস্থার যেসব খবর প্রকাশিত হয়েছেÑ এসব তার সামান্য নমুনা। পাঠ্যপুস্তক : ‘এবার ব্লগ ও কোচিং সেন্টারের ওয়েবসাইট থেকে কপি’, ‘পাঠ্যবইয়ে এবারও ভুলের ছড়াছড়ি’, শিক্ষায় গ্রাম-শহরে বৈষম্য’, ‘জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৫ ধরনের আর্থিক অনিয়ম’, ‘শিক্ষক সংকট প্রকট হয়ে উঠেছে সরকারি কলেজগুলোয়’, ‘দুর্নীতি-অনিয়মের আখড়া আরবি বিশ্ববিদ্যালয়’, ‘ডলারে ঘুষ লেনদেন চক্রে দুদকের দুই কর্মকর্তা, কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সনদ বাণিজ্য’, ‘ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের এত অনিয়ম’, ‘সব ফেল বিদ্যালয় একীভূত হবে পাসের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে’, ‘সাত শিক্ষকের ৬ শিক্ষার্থীÑ তবু পাস নেই’ এই শিরোনামগুলো শিক্ষাব্যবস্থার করুণ চিত্রই প্রমাণ করছে। আর ২০২৪-এর শেষের দিকের খবর অর্থাৎ জুলাই আন্দোলনের পরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ শিক্ষাব্যবস্থার অবস্থাÑ এককথায় দুর্ভাগ্যজনক। এখানে শিক্ষক প্রহৃত হচ্ছেনÑ গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখা, চেয়ার থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়ার দৃশ্য বহু ঘটেছে। তাই এর সঙ্গে সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থা যে ভঙ্গুর এবং এক মহাবিপর্যায়ের সম্মুখীন তা প্রমাণের আর প্রয়োজন নেই। 
 

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!