বুধবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


স্বপ্না চক্রবর্তী

প্রকাশিত: নভেম্বর ২৬, ২০২৫, ০১:১৪ এএম

ঢামেকে স্বার্থের চাদর

স্বপ্না চক্রবর্তী

প্রকাশিত: নভেম্বর ২৬, ২০২৫, ০১:১৪ এএম

ঢামেকে স্বার্থের চাদর

  • অর্থোপেডিক বিভাগে ২ ওয়ার্ডের ৬ ইউনিটের কয়েকটি ওষুধ কোম্পানির টাকায় কেনা হয়েছে চাদর
  • যেসব কোম্পানির টাকায় চাদর কেনা, তাদের ওষুধ ছাড়া অন্য কোম্পানির ওষুধ লিখতে মানা
  • বিভাগীয় চেয়ারম্যানের ব্যক্তি উদ্যোগে হয়েছে সবই। তার খামখেয়ালিতেও চলছে বিভাগ
  • প্রয়োজন না থাকলেও আলাদা সার্ভার কেনার উদ্যোগ
  • ডাক্তারদের টাকায় কিনেছেন ইন্টারেকটিভ প্যানেল
  • নিচ্ছেন আলাদা সার্ভার কেনার উদ্যোগ
  • ক্ষোভ চিকিৎসকদের

সারা দেশের সব হাসপাতালই যখন রোগী ভর্তি করাতে অস্বীকৃতি জানায় তখন শেষ আশ্রয় দেশের সবচেয়ে বড় হাসপাতাল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। এখানে প্রতিদিন চিকিৎসা নিতে আসেন কয়েক হাজার রোগী। শয্যার অনুপাতে বেশি রোগী হলেও এখান থেকে কেউ ফেরে না বিনা চিকিৎসায়। সরকারের সর্বোচ্চ নজরদারিতেও রয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। তবুও এ হাসপাতালের অর্থোপেডিক সার্জারি বিভাগটি চলছে পরিচালকের একচ্ছত্র স্বেচ্ছাচারিতায়। রোগীদের কল্যাণের নামে নিয়মবহির্ভূতভাবে ওষুধ কোম্পানির কাছ থেকে নিয়েছেন বিছানার চাদর কেনার টাকা। আর চিকিৎসকদের বাধ্য করছেন ওই কোম্পানির ওষুধের নাম লিখতে। চিকিৎসকদের কাছ থেকে ডোনেশনের নামে চাঁদা তুলে কিনেছেন ইন্টারেকটিভ প্যানেল। একই পদ্ধতিতে কিনেছেন প্রজেক্টর। এখন উদ্যোগ নিয়েছেন আলাদা সার্ভার কেনার। সবই কোনো না কোনো ওষুধ কোম্পানির বা ডাক্তারদের চাঁদার টাকায় কেনার এ উদ্যোগকে তিনি হাসপাতালের কল্যাণের জন্য দাবি করলেও এটিকে সম্পূর্ণ অনৈতিক বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। সরকারি হাসপাতালে নিয়মের বাইরে ব্যক্তির টাকায় একটি সুঁইও কেনার সুযোগ নেই বলে জানান তারা।

অর্থোপেডিক সার্জারি বিভাগের ১১৩ এবং ১১৫ নাম্বারÑ এ দুই ওয়ার্ডে রয়েছে ৬টি ইউনিট। যেগুলোর আলাদা আলাদা নাম। রংধনুর সাত রঙের আসমানি ছাড়া বেগুনী, নীল, সবুজ, কমলা, লাল, হলুদ রঙের ইউনিটগুলো নজর কাড়বে যে কারোই। কারণ প্রত্যেকটি ইউনিটের সঙ্গে মিল রেখে সব শয্যায় বিছানো রয়েছে রঙ-বেরঙের চাদর। আর এই চাদর কেনা হয়েছে বিভাগের বর্তমান প্রধান অধ্যাপক ডা. সৈয়দ জাকির হোসেনের নির্দেশনায়। কিন্তু এর জন্য কোনো টেন্ডার বা সরকার থেকে পাননি এক টাকাও। এরিস্টো ফার্মা, বেক্সিমকো, স্কয়ারসহ কয়েকটি কোম্পানি থেকে চাদর কেনার জন্য তিনি নিয়েছেন ৫ লাখ করে টাকা। এসব টাকায় চাদর কিনেছেন তিনি। যা সরকারি নীতিমালার সম্পূর্ণ বাইরে। বেসরকারি ওষুধ কোম্পানির টাকায় চাদর কেনার কারণ জানতে চাইলে রূপালী বাংলাদেশের সঙ্গে মোবাইলে দীর্ঘ আলাপে অধ্যাপক ডা. সৈয়দ জাকির হোসেন বলেন, ‘চাদর কেনার বিষয়টি তো এক বছর আগের। এটি নিয়ে এখন কথা হচ্ছে কেন? আমি তো শুধু চাদর কিনিনি। বিভাগের কল্যাণে যা যা করণীয় অনেক কিছুই করেছি। এই যেমন ধরেন আমাদের একটা ইন্টারেকটিভ প্যানেল (ডিজিটাল স্মার্ট বোর্ড-ক্লাসরুমে ব্যবহারের জন্য) কিনেছি চিকিৎসকদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে। যেখানে খরচ হয়েছে ৪ লাখ ৬০ হাজার টাকা।’ চিকিৎসকরা নিজ উদ্যোগেই সেই টাকা দিয়েছেন বলেও দাবি করেন তিনি। তিনি আরও বলেন, ‘একইভাবে নিজেরা উদ্যোগ নিয়ে বিভাগে সিসিটিভি ক্যামেরা লাগিয়েছি।’ কথা বলার এক পর্যায়ে প্রতিবেদককে চায়ের দাওয়াত দিয়ে বলেন, ‘আপনি সামনা-সামনি আসেন। বিভাগের কল্যাণে কি কি কাজ করেছি তা নিজের চোখে দেখে যান।’ তার সঙ্গে চা না খেয়ে প্রতিবেদন না লেখার জন্যও অনুরোধ করেন।

কিন্তু তার সঙ্গে দেখা করলে প্রতিবেদন লেখা যাবে না দাবি করে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিভাগের এক চিকিৎসক রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘তিনি এমনভাবে আপনাকে বিষয়গুলোর ব্যাখ্যা দেবেন যে আপনি আর প্রতিবেদন করতে পারবেন না। তিনি বিভাগীয় প্রধান হয়েও কোনো অস্ত্রোপচার করেন না। একটাও ক্লাস নেন না। এমনকি দুপুরের আগে কোনোদিন বিভাগেই আসেন না। তিনি ক্যানসার সারভাইভর অজুহাতে এমন স্বেচ্ছাচারিতা করছেন। সরকারিভাবেই বিভাগে সিসিটিভি লাগানো আছে। কিন্তু বিশেষ কাউকে সুবিধা দিতে তিনি বাড়তি এসব ক্যামেরা লাগিয়েছেন। যেগুলোর কোনো প্রয়োজনই নেই। যদি যোগ্য লোকই না হন তাহলে পদ আকড়ে থেকে কি লাভ?’

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের বিভাগে এক্স-রে মেশিনের সংকট প্রকট। প্লাস্টার রুমের জন্যও নেই পর্যাপ্ত চিকিৎসক। যে বিভাগীয় প্রধান সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপনসহ আলাদা সার্ভার কেনার উদ্যোগ নেওয়ার মতো জটিল কাজগুলো করছেন তিনি এক্স-রে মেশিনের জন্য কোনো উদ্যোগ নিচ্ছেন না কেন?’

এতসব স্বেচ্ছাচারিতার পরও রোগীরা যে সুচিকিৎসা পাচ্ছেন তা কিন্তু নয়। সরেজমিনে দেখা যায়, সকাল ১০টায় সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে ঢামেকের অর্থোপেডিক বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসেন রাজধানীর মহানগর এলাকার বাসিন্দা সিকান্দার হোসেন। চিকিৎসক একটি এক্স-রে করতে দিয়েছেন। কিন্তু এক্স-রে রুমের সামনে দীর্ঘ লাইন দেখে তিনি পাশের একটি বেসরকারি হাসপাতালে যান। একই রকমভাবে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আহত শিল্পী আক্তারকে ডাক্তার নিজেই বলেন, ‘খোদ পরিচালক বলে দিলেও এখানে আপনি এক্স-রে করার সুযোগ পাবেন না।’

বিভাগের প্লাস্টার রুমেও নেই পর্যাপ্ত চিকিৎসক। দুইজন ডাক্তার একেকজন রোগীর প্লাস্টার করছেন। এসব দিকে কেনো নজর দিচ্ছেন না জানতে চাইলে অধ্যাপক ডা. জাকির হোসেন বলেন, ‘বিভাগের উন্নয়নে যা যা করণীয় তা ধারাবাহিকভাবে করে যাচ্ছি। আপনারা জানেন সরকারের পক্ষ থেকে কোনো যন্ত্রপাতি পেতে হলে কত ঘাট ঘুরতে হয়। টেন্ডার প্রক্রিয়া শেষ করতেই বছর চলে যায়। আমার আগে যিনি বিভাগীয় প্রধান ছিলেন তার কাছে একটি অর্থোস্কোপি মেশিন আসে। কিন্তু তিনি সেটি রিসিভ করেননি। কারণ এটির রিকুইজিশন এর আগের বিভাগীয় প্রধান দিয়েছিলেন। এখন এটির জন্য প্রত্যেক রোগীর বাড়তি খরচ হচ্ছে ২৫ থেকে ২৬ হাজার টাকা। এমন দীর্ঘসূত্রতা থেকে বের হতেই আমি এসব উদ্যোগ নিয়েছি। কারো কোনো ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে না।’

তবে সরকারি হাসপাতালের কেনাকাটায় এমন উদ্যোগ সম্পূর্ণ অনৈতিক উল্লেখ করে অর্থোপেডিক সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. অনুপ মোস্তফা রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘বিস্তারিত আমি এ বিষয়ে কিছু বলতে পারব না। তবে সরকারি হাসপাতালে সরকারিভাবেই যেকোনো কেনাকাটা হবে। এর বাইরে একটি গজ বা সুতাও কেনা যাবে না। কেউ যদি সেটি করে তাহলে নিশ্চয়ই তার ব্যক্তিস্বার্থ রয়েছে এতে তা স্পষ্ট।’

ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল-২ ও সাবেক বার্ন ইউনিট মিলে প্রতিষ্ঠানটিতে বর্তমানে দুই হাজার ৯০০ শয্যা রয়েছে। যদিও এখানে প্রতিদিন গড়ে চার সহ¯্রাধিক রোগী চিকিৎসাধীন থাকেন। জরুরি বিভাগ এবং বহির্বিভাগ মিলে প্রতিদিন প্রায় ১০ হাজার মানুষ এই হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। একই ছাতার নিচে মেলে সব ধরনের চিকিৎসা সেবা। এখানে ৪২টি অপারেশন থিয়েটার আছে। গাইনির জন্য আছে পৃথক অপারেশন থিয়েটার। নিউরো সার্জারি, গাইনি ও ক্যাজুয়েলটিসহ সব ধরনের জরুরি অপারেশন ২৪ ঘণ্টাই হয়ে থাকে। প্রতিদিন বিভিন্ন ঘটনা-দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের সংকটাপন্ন দুই শতাধিক রোগী জরুরি বিভাগে চিকিৎসার জন্য আসেন। এরমধ্যে ৯৫ ভাগ রোগীকে ভর্তি করা হয় জানিয়ে হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘রোগীর সেবা আমাদের আমাদের সর্বোচ্চ লক্ষ্য। এর জন্য সরকার থেকে পর্যাপ্ত সহযোগিতা আমরা পাই। কিন্তু কোনো বিভাগ যদি এ রকম অনৈতিকভাবে নিজের স্বেচ্ছাচারিতায় কেনাকাটা করে থাকেন তাহলে অবশ্যই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

যেকোনো রোগ আক্রান্ত রোগীদের সেবায় হাসপাতালটিতে কার্ডিয়াক সার্জারি, ডায়াবেটিস, গ্যাস্ট্রোলিভার, থোরাসিক সার্জারি,  ক্যানসার, কিডনিসহ সব ধরনের বিশেষায়িত ইউনিট আছে। সব মিলিয়ে মোট ৩৭টি বিভাগ আছে। প্রায় ১৮০০ চিকিৎসক, ২৬৫০ নার্স ও অন্যান্য কর্মচারী দিনরাত চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। এনেসথেসিওলজিস্ট সংকট প্রকট। ডাক্তার, নার্সসহ স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের টানা ২৪ ঘণ্টা জরুরি অপারেশনসহ চিকিৎসা সেবা দিতে হয়। এখানে কোনো ধরনের অনিয়ম মানা হবে বলে মন্তব্য করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবু জাফরও। তিনি রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘ঢাকা মেডিকেলের জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সব সময় সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সবকিছু দিচ্ছে। সেখানে কেউ নিজের স্বার্থে একটি সুইও কেনার ক্ষমতা রাখে না। বিষয়টি অবশ্যই তদন্ত করা হবে।’

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!