রুদ্রপ্রতাপ গ্রামের একজন সাধারণ মানুষ ছিলেন। পেশায় কৃষক, কিন্তু মনুষ্যত্বে একজন সম্পদশালী। তার জীবনের মূলমন্ত্র ছিল দান ও দয়া। বাপ-দাদার সঞ্চয় অনেক না থাকলেও, যা ছিল তা তিনি দুহাতে বিলিয়ে দিতে প্রস্তুত ছিলেন। গ্রামের লোকজন তাকে সম্মানের চোখে দেখত, যদিও সবাই বুঝতে পারত না তার দানের গুণ। মানুষের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া যেন তার কাছে একটা স্বাভাবিক কাজ ছিল।
একদিন রুদ্রপ্রতাপ মাঠ থেকে কাজ সেরে বাড়ি ফিরছিলেন। হঠাৎ গ্রামের পথে একজন ভিক্ষুক তার সামনে এসে দাঁড়ায়। ভিক্ষুকের বয়স প্রায় পঞ্চাশের কাছাকাছি, গায়ের কাপড় ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন। রুদ্রপ্রতাপ তাকিয়ে থাকলেন তার মুখের দিকে। ভিক্ষুকটি বলল, ‘বাবু, কিছু সাহায্য করুন। খুব কষ্টে আছি।’
রুদ্রপ্রতাপ পকেট থেকে কিছু পয়সা বের করে ভিক্ষুকের হাতে দিলেন। কিন্তু ভিক্ষুকের চাহনি যেন আরও কিছু চায়, যেন কোনো দানের চেয়ে গভীর কিছু। রুদ্রপ্রতাপ বুঝতে পারলেন, শুধু পয়সা দিলেই তার কাজ শেষ হচ্ছে না। তিনি ভিক্ষুককে বললেন, ‘তোমার নাম কী?’
ভিক্ষুক বলল, ‘আমার নাম হরিপদ।’
‘তুমি কেন এমন পথে পথে ঘুরছো?’
হরিপদ একটু থেমে উত্তর দিল, ‘আমার একসময় একটা ছোট্ট দোকান ছিল, পরিবার ছিল, সব ছিল। কিন্তু কিছু ভুল সিদ্ধান্তের কারণে সবকিছু শেষ হয়ে গেল। এখন আমি শুধু বাঁচার জন্য এখানে-ওখানে ঘুরি।’
রুদ্রপ্রতাপ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। তিনি অনুভব করলেন, শুধু পয়সা দিলেই এই সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। তার মনে হলো, এখানে দরকার একটু দয়া, একটু সহানুভূতি। তিনি হরিপদকে তার বাড়িতে নিয়ে গেলেন। তাকে খাওয়ালেন, পরানোর জন্য ভালো কাপড় দিলেন। কিছুক্ষণ পর, রুদ্রপ্রতাপ তার সঙ্গে গল্প করতে বসলেন। হরিপদকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমার দোকান কি আর ফিরে পেতে চাও?’
হরিপদ বিস্মিত হয়ে উত্তর দিল, ‘সে কি আর সম্ভব, বাবু? আমি তো সব হারিয়ে ফেলেছি।’
রুদ্রপ্রতাপ বললেন, ‘জীবনে কখনো হাল ছাড়তে নেই। দানের মতোই দয়া হলো এমন একটা বিষয়, যা শুধু ত্রাণ দেয় না, মানুষকে আত্মবিশ্বাসও ফিরিয়ে দেয়। তুমি চাইলে আবার শুরু করতে পার।’
হরিপদ কিছুক্ষণ ভাবল। রুদ্রপ্রতাপের কথা তাকে নতুন করে অনুপ্রাণিত করেছিল। সে বলল, ‘আপনার কথায় নতুন শক্তি পাচ্ছি। যদি সুযোগ পাই, আমি আবার চেষ্টা করব।’
রুদ্রপ্রতাপ তখন তাকে কিছু টাকা দিলেন, যা দিয়ে সে তার পুরোনো দোকানটা আবার চালু করতে পারে। কিন্তু রুদ্রপ্রতাপ শুধু টাকা দিয়েই থেমে থাকেননি, তিনি হরিপদকে একধরনের বিশ্বাস এবং আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। সেই বিশ্বাস, যা তার দান এবং দয়ার গভীরে লুকিয়ে ছিল।
দিন কেটে যায়। কয়েক মাস পর রুদ্রপ্রতাপ যখন আবার গ্রামের পথে হেঁটে যাচ্ছিলেন, তিনি দেখেন একটি ছোট্ট দোকানে মানুষের ভিড়। দোকানের মালিক হরিপদ, আর তার মুখে আত্মবিশ্বাসের হাসি। রুদ্রপ্রতাপ অনুভব করলেন, তার দয়া শুধু একজন মানুষের জীবনে পরিবর্তন আনেনি, সেই পরিবর্তন এক সময় পুরো সমাজকে ছুঁয়ে যাবে।
তবে গল্পের এখানেই শেষ নয়। রুদ্রপ্রতাপ নিজেও জীবনের এক বড় সংকটে পড়ে। কয়েক বছর পর এক মহামারি আঘাত হানে গ্রামে। ফসল নষ্ট হয়ে যায়, রুদ্রপ্রতাপের জমিও প্রভাবিত হয়। তিনি নিজেও অর্থনৈতিক দুঃসময়ে পড়েন। একসময়, যিনি সমাজের জন্য এতকিছু করেছেন, আজ তিনিই অসহায় হয়ে পড়েন। কেউ সাহায্যের হাত বাড়াতে এগিয়ে আসে না। রুদ্রপ্রতাপ বুঝলেন, জীবনে দেওয়া এবং নেওয়ার সমীকরণ সবসময় সরল নয়।
এই সংকটের সময়েই হরিপদ এসে হাজির হয়। রুদ্রপ্রতাপকে সে তার দোকানের আয়ে সহায়তা করতে চায়। হরিপদ বলল, ‘বাবু, আপনি না থাকলে আমি আজ এখানে দাঁড়াতে পারতাম না। আজ আমি আপনার সাহায্য ছাড়া থাকতে পারি না।’
রুদ্রপ্রতাপ প্রথমে নিতে চাননি, কিন্তু হরিপদের দৃঢ়তার সামনে তিনি নত হলেন। তার চোখে জল এসে গেল। তিনি বুঝতে পারলেন, সত্যিকার দয়া শুধু তাৎক্ষণিক সহানুভূতি নয়, এটি চিরস্থায়ী বৃত্ত হয়ে ফিরে আসে। হরিপদের সাহায্য পেয়ে রুদ্রপ্রতাপ আবার মাথা তুলে দাঁড়ালেন।
সমাজে অনেকেই আছে যারা অর্থ, ক্ষমতা, এবং প্রতিপত্তি দিয়ে নিজেদের দাতা মনে করে। কিন্তু রুদ্রপ্রতাপের মতো মানুষ দেখায়, দানের প্রকৃত অর্থ শুধু বস্তুগত সম্পদ নয়। দয়া এবং সহানুভূতি দিয়ে মানুষের জীবন বদলে দেওয়া যায়, আর সেই বদল মানুষকে আবার সাহায্যের পথে ফিরিয়ে নিয়ে আসে। এটাই দানের প্রকৃত জয়।
দান এবং দয়াÑ এই দুটি বিষয় জীবনে কীভাবে পারস্পরিকভাবে কাজ করে তা রুদ্রপ্রতাপ ও হরিপদের জীবনের মাধ্যমে ফুটে উঠেছে। একজনের দেওয়া শুধু তাৎক্ষণিক সাহায্য নয়, এটি মানুষের জীবনে স্থায়ী পরিবর্তন আনতে পারে। আর সেই পরিবর্তনের ফল একদিন আবার ফিরে আসে।

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন