ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোটের তপশিল ঘোষণার প্রহর গুনছে দেশ। নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, যেকোনো মুহূর্তে ঘোষণা হতে পারে তপশিল। সেই সঙ্গে রাষ্ট্রপতি, প্রধান বিচারপতি, সুপ্রিম কোর্ট এবং প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায়ের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক। সব মিলিয়ে স্পষ্ট যে নির্বাচন আয়োজনের জন্য প্রস্তুতি এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে। কিন্তু প্রস্তুতির দৃশ্যমানতা ও বাস্তবতার মধ্যে ব্যবধান কতটুকু এই প্রশ্নই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
ইসি বলেছে, তারা একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। ইতোমধ্যে রিটার্নিং অফিসার, সহকারী রিটার্নিং অফিসার, বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট, ইলেক্টোরাল ইনকোয়ারি কমিটি, মনিটরিং সেলসহ বিভিন্ন কাঠামোর খসড়া, পরিপত্র ও ফরমেট প্রস্তুত করা হয়েছে। সশস্ত্র বাহিনী, পুলিশ, বিজিবি, র্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রায় ৯ লাখ সদস্য এবার নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করবে, যা দেশের নির্বাচন ইতিহাসে সর্বোচ্চ। নিরাপত্তা ব্যবস্থার এই বিপুল প্রস্তুতি নিঃসন্দেহে একটি সুশৃঙ্খল পরিবেশ তৈরিতে সহায়ক হবে।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, শুধু সামরিক বা প্রশাসনিক শক্তি বাড়ানোই কি সুষ্ঠু নির্বাচনের নিশ্চয়তা? অতীত অভিজ্ঞতা বলে, সুষ্ঠু নির্বাচনের আসল শর্ত হলো রাজনৈতিক আস্থা, স্বচ্ছতা, সবার সমান অংশগ্রহণ এবং ইসির নিরপেক্ষতা। দেশের নির্বাচন যতই নিরাপত্তানির্ভর হোক, এর প্রাণশক্তি থাকে জনগণের ভোটাধিকার ও রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার ন্যায্যতায়।
এই প্রেক্ষাপটে চিন্তার বিষয় হলো, তপশিল ঘোষণার পর অনুমোদনহীন বা ‘অযৌক্তিক’ আন্দোলন কঠোর হাতে দমন করা হবে বলে সরকার যে সতর্কবার্তা দিয়েছে, তা গণতান্ত্রিক পরিবেশের জন্য কতটা সহায়ক হবে। দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এমন, বিরোধী দলের অংশগ্রহণ, আন্দোলন, রাস্তায় মানুষের অবস্থান এসবই রাজনৈতিক সমীকরণের অংশ। নির্বাচনের মুহূর্তে আন্দোলন দমনের কঠোর ঘোষণা মানুষের মনে শঙ্কা তৈরি করতেই পারে। আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখতে নিষেধাজ্ঞা প্রয়োজন হতে পারে, কিন্তু ‘কঠোর দমন’-এর ভাষা রাজনৈতিকভাবে বিপরীত প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে।
অন্তর্বর্তী সরকারের যুক্তি, গত দেড় বছরে দুই হাজারের বেশি আন্দোলন হয়েছে, সরকার নানামুখী দাবি-দাওয়ায় সাড়া দিয়েছে, তাই এখন নির্বাচনমুখী সময়ে আর কোনো উত্তেজনা যেন সৃষ্টি না হয়। যুক্তি বাস্তবসম্মত হলেও, গণতান্ত্রিক রাজনীতির একটি মৌলিক উপাদান হলো সহনশীলতা। নির্বাচনের আগে যদি রাজনৈতিক কণ্ঠরোধ বা সমাবেশ সীমিত হয়, তাহলে সেটি পুরো নির্বাচনি প্রক্রিয়ার গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে।
এবারের তপশিল ঘোষণা জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়ে করবেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। রেকর্ডকৃত এই ভাষণে তিনি ভোটারদের উদ্দেশে আহ্বান জানাবেন এবং রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আচরণবিধি মেনে চলার অনুরোধ করবেন। এর আগের দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে সরাসরি সম্প্রচারের মাধ্যমে তপশিল ঘোষণা করা হয়েছিল। এবার রেকর্ডকৃত ভাষণ নির্বাচন কমিশনের প্রস্তুতিকে আরও পদ্ধতিগত করতে পারে, তবে ভাষণের বার্তা কতটা আস্থা তৈরি করবে, সেটিই আসল বিবেচ্য।
এই মুহূর্তে দেশের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ, একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন করা। আন্দোলন, অবিশ্বাস, রাজনৈতিক দূরত্ব, প্রশাসনিক প্রভাব, সবকিছু উপেক্ষা করে একটি শান্তিপূর্ণ, অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন আয়োজন করা সহজ নয়। কিন্তু গণতন্ত্রকে এগিয়ে নিতে হলে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতেই হবে।
আমরা মনে করি, এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা প্রধান শক্তি হলো আস্থার পুনর্গঠন। সরকার, ইসি, প্রশাসন এবং রাজনৈতিক দল সব পক্ষকে সংযম, সহিষ্ণুতা এবং সমতাপূর্ণ আচরণ দেখাতে হবে। কঠোরতা নয়, বরং ন্যায় ও স্বচ্ছতা নির্বাচনকে সফল করে। বিরোধী রাজনৈতিক শক্তির জন্যও প্রয়োজন দায়িত্বশীল আচরণ, অহিংস পথ এবং আলোচনার দরজা খোলা রাখা।
গণতন্ত্রের সত্যিকারের শক্তি প্রমাণিত হয় শান্তিপূর্ণ ও স্বচ্ছ নির্বাচনের মাধ্যমে। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সেই পরীক্ষার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এই নির্বাচন জাতির জন্য শুধু প্রতিনিধিত্বের নয়। বরং এটি বিশ্বাস, আস্থা ও রাজনৈতিক সংস্কৃতির পুনর্গঠনের সুযোগ। সেই সুযোগকে আমরা কাজে লাগাতে পারব কিনা, তার উত্তর মিলবে শিগগিরই।

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন