আবারও মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা বাড়াতে এক ধাপ এগোল ইসরায়েল। এর আগে দেশটি ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেছে, সিরিয়ার আরও ভূমি দখল করেছে, লেবাননের হিজবুল্লাহ নেতাদের হত্যা করেছে আর গাজায় যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ৬৪ হাজার ৫০০-এর বেশি ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে। কিন্তু দোহায় হামলা নতুন মাত্রা তৈরি করল। যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র কাতারে মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে বড় মার্কিন সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। দেশটি ফিলিস্তিনের গাজায় যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠায় চুক্তি সই এবং সেখান থেকে ইসরায়েলি জিম্মিদের মুক্তির আলোচনায় নেতৃত্ব দিচ্ছে। সেই দেশেই কিনা সরাসরি হামলা চালাল ইসরায়েল।
দোহায় গত মঙ্গলবার হামলার দায় গোপন করার কোনো চেষ্টা করেনি ইসরায়েল। কাতারের রাজধানীতে বিস্ফোরণের শব্দ শোনার কয়েক মিনিটের মধ্যেই ইসরায়েলি কর্মকর্তারা গণমাধ্যমে এর দায় স্বীকার করেন। অল্প সময়ের মধ্যেই ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর কার্যালয় এক বিবৃতিতে ফিলিস্তিনি সংগঠন হামাসের কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতাকে লক্ষ্য করে চালানো এ হামলার প্রকাশ্য দায় নেয়। বিবৃতিতে বলা হয়, ইসরায়েল এটি শুরু করেছে, ইসরায়েল এটি পরিচালনা করেছে এবং ইসরায়েল পূর্ণ দায় নিচ্ছে।
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের জ্যেষ্ঠ বিশ্লেষক মায়েরাভ জোনজেইন আলজাজিরাকে বলেন, ‘আমরা দেখেছি, ইসরায়েল যখন ইচ্ছা মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের জনবহুল এলাকা ও রাজধানীতে হামলা চালায়। এখনো করছে, ভবিষ্যতেও করবেÑযদি না কেউ গুরুত্বের সঙ্গে এটি ঠেকানোর উদ্যোগ নেয়।’ ফিলিস্তিনি প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক হামজা আত্তার বলেন, এ হামলায় অনেকে বিস্মিত হয়েছেন। কারণ, এটি মোসাদের প্রচলিত কাজের ধারা থেকে অনেক বাইরে, যেখানে হত্যাকা- সাধারণত গাড়িবোমা, বিষপ্রয়োগ কিংবা গুলি ও স্নাইপার হামলার মাধ্যমে ঘটানো হয়। আমরা দেখেছি, ইসরায়েল যখন ইচ্ছা মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের জনবহুল এলাকা ও রাজধানীতে হামলা চালায়। এখনো করছে, ভবিষ্যতেও করবে, যদি না কেউ গুরুত্বের সঙ্গে এটি ঠেকানোর উদ্যোগ নেয়। হামজা আত্তার বলেন, ‘আমি মনে করি না...কাতারিরা কখনো ভেবেছিলেন, ইসরায়েল দোহায় বোমা ফেলবে।’
দোহাভিত্তিক লেখক ও সাংবাদিক আবদুল্লাহ আল-ইমাদি বলেন, কাতার গাজায় পরিস্থিতি শান্ত করতে ও উভয় পক্ষকে যুদ্ধ থেকে বের করে আনতে সবচেয়ে বেশি চেষ্টা করছে, কিন্তু ইসরায়েল এসব প্রচেষ্টাকে গুরুত্ব দিচ্ছে না।
আলজাজিরার জ্যেষ্ঠ রাজনৈতিক বিশ্লেষক মারওয়ান বিশারা বলেন, ‘বিশ্লেষণ করলে মনে হয়, যুক্তরাষ্ট্রের অনুমোদন ছাড়া ইসরায়েল এমন হামলা চালানোর সাহস করবে না। যদি যুক্তরাষ্ট্র সত্যিই অনুমোদন না দিয়ে থাকে, তবে আমাদের উচিত তাদের কাছ থেকে নিন্দা শোনা। যুদ্ধবিরতি নিয়ে আলোচনা চলার সময় ট্রাম্প প্রশাসনের উচিত তাদের ক্লায়েন্ট রাষ্ট্র ইসরায়েলের এ আচরণের নিন্দা করা।’
কাতারের রাজধানী দোহায় ইসরায়েলি হামলা শুধু একটি সামরিক অভিযান নয়, বরং মধ্যপ্রাচ্যের জন্য এক ‘গুরুত্বপূর্ণ মোড় ও সতর্কবার্তা’ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, ইসরায়েলের এমন বর্বরোচিত পদক্ষেপ প্রমাণ করছে, দেশটির কাছে কোনো ‘রেড লাইন’ বা চূড়ান্ত সীমারেখা মেনে চলার কোনো বাধ্যবাধকতা আর নেই। ইসরায়েল নিজেকে এমন এক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করছে, যে চাইলেই যেকোনো জায়গায় আঘাত হানতে পারে। এক বিশ্লেষক বলেন, ‘কেউ ইসরায়েলের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারছে না। যখন মার্কিনিদের কাছে অভিযোগ জানানো হয় যে, ইসরায়েল সীমা অতিক্রম করছে, তখন ওয়াশিংটন শুধু আশ্বাস দেয় যে, এমনটি আর হবে না। কিন্তু বাস্তবে বারবার ঘটছে।’
কাতারে ইসরায়েলি হামলার নিন্দা জানিয়েছেন জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস। তিনি বলেন, এ হামলা কাতারের সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখ-তার প্রতি পরিষ্কার লঙ্ঘন।
এদিকে হোয়াইট হাউসের এক কর্মকর্তা নিশ্চিত করেছেন, কাতারের দোহায় ইসরাইলি হামলার বিষয়ে হোয়াইট হাউসকে আগেই জানানো হয়েছিল।
জাতিসংঘ মহাসচিব কাতারকে এমন একটি দেশ হিসেবে বর্ণনা করেছেন যারা ‘যুদ্ধবিরতি ও সকল জিম্মিদের মুক্তিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।’
তিনি বলেন, ‘সব পক্ষের উচিত একটি স্থায়ী যুদ্ধবিরতির অর্জনের কাজ করা, সেটি ধ্বংস করা নয়।’ ন্যাটোর বাইরে কাতার যুক্তরাষ্ট্রের বড় মিত্র দেশ, যেখানে দেশটির ১০ হাজারের বেশি সেনা মোতায়েন রয়েছে।
কাতারে ইসরায়েলের হামলার পর এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মন্তব্যের প্রভাবে বিশ্ববাজারে তেলের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। বুধবার ব্রেন্ট ক্রুডের দাম ব্যারেলপ্রতি ০.৯২ শতাংশ বেড়ে ৬৭ ডলারে এবং মার্কিন ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েট ক্রুডের দাম ০.৯৭ শতাংশ বেড়ে ৬৩.২৪ ডলারে দাঁড়িয়েছে।
ইসরায়েল সব সময় তার মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থে কাজ করে না বলে উল্লেখ করেছেন জাতিসঙ্ঘে নিযুক্ত ইসরাইলি রাষ্ট্রদূত ড্যানি ড্যানন।মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইসরাইলের কাতারে হামাস নেতাদের লক্ষ্য করে চালানো হামলার সমালোচনা করার পর বুধবার (১০ সেপ্টেম্বর) রাষ্ট্রদূত ড্যানন এ কথা বলেছেন।
কাতারভিত্তিক গণমাধ্যম আল জাজিরা কূটনৈতিক সূত্রে জানিয়েছে, নিরাপত্তা পরিষদের আরব সদস্য আল জেরিয়ার অনুরোধে সংস্থাটি এই জরুরি বৈঠক আহ্বান করেছে। বার্তা সংস্থা রয়টার্সও নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক কূটনৈতিক সূত্রে বিষয়টি উল্লেখ করেছে।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন