ঢাকা মঙ্গলবার, ১৪ অক্টোবর, ২০২৫

গাজা-ইসরায়েল যুদ্ধবিরতি

ক্লান্ত উপত্যকায় আনন্দাশ্রু, বাঁধভাঙা উল্লাস

ভিনদেশ ডেস্ক
প্রকাশিত: অক্টোবর ১৪, ২০২৫, ০১:০৯ এএম

দীর্ঘ ৩৪ বছর ইসরায়েলি কারাগারে বন্দি ছিল দুই ভাই। আবদেল জাওয়াদ শামাসনে ও মোহাম্মদ শামাসনে। অবশেষে বাড়ি ফিরেছেন এই দুই ফিলিস্তিনি ভাই। সর্বশেষ যুদ্ধবিরতি চুক্তির আওতায় তাদের মুক্তির তালিকা প্রকাশের খবর ছড়িয়ে পড়তেই উৎসবের আমেজ নেমে এসেছে অধিকৃত পশ্চিম তীরের কাতান্না গ্রামে অবস্থিত শামাসনে পরিবারে। ৮৩ বছর বয়সি মা হালিমা শামাসনের আনন্দ ধরে রাখতে কষ্ট হচ্ছিল। তিনি আবেগঘন কণ্ঠে বলেন, ‘আজ আমার আনন্দ আর ধরে না, মনে হচ্ছে পৃথিবীর সব সুখ যেন আমার ঘরেই এসে জমা হয়েছে।’ পরম প্রতীক্ষায় থাকা মা আরও জানান, পরিচিতজনেরা ফোন করে নিশ্চিত করেছে যে তার দুই ছেলের নাম মুক্তিপ্রাপ্ত বন্দিদের তালিকায় রয়েছে। এ খবর দিয়েছে অনলাইন আলজাজিরা।

ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ গাজায় আটক ইসরায়েলি জিম্মিদের বিনিময়ে ২৫০ জন ফিলিস্তিনি বন্দিকে মুক্তি দেওয়ার তালিকা প্রকাশ করেছে। এই তালিকায়ই রয়েছে শামাসনে ভাইদের নাম। বাবা ইউসুফ শামাসনে নাতি-নাতনি ও পরিবার-পরিজনদের নিয়ে ছেলেদের স্বাগত জানানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ঘরের দেয়ালে টাঙানো দুই ভাইয়ের পুরোনো ছবি সাক্ষ্য দেয় তাদের দীর্ঘ কারাবাসের। ১৯৮০-এর দশকে তোলা সেই ছবিতে তারা যুবক, ঠিক তখনই গ্রেপ্তার হয়েছিলেন দুজন। এখন আবদেল জাওয়াদের বয়স ৬২ বছর, আর মোহাম্মদের বয়স প্রায় ৬০-এর কাছাকাছি। মা হালিমা ছেলেদের আগমনের অপেক্ষায় পরেছেন ঐতিহ্যবাহী ফিলিস্তিনি সূচিকর্ম করা তাবরিজ পোশাক, আর বাবা ইউসুফ পরেছেন স্যুট ও মাথায় পরেছেন কেফিয়া স্কার্ফ, ফিলিস্তিনি প্রতিরোধের প্রতীক হিসেবে যেটি পরিচিত। বাড়ির দেয়ালে টাঙানো ‘প্রিজনার্স ক্লাব’-এর পোস্টার আজও পরিবারের দীর্ঘ অপেক্ষার ইতিহাস মনে করিয়ে দেয়। আবদেল জাওয়াদের ছেলে আজুজ শামাসনে বলেন, ‘বাবাকে যখন গ্রেপ্তার করা হয়, তখন আমার বয়স ছিল মাত্র ৯ বছর। আজ আমার বয়স ৪৪।

আমি নিজে বাবা হয়েছি, কিন্তু বাবাকে ছাড়া বড় হওয়া যেন এক জীবন্ত বেদনা।’ তিনি জানান, গত ৮ বছর ধরে বাবার সঙ্গে তার দেখা করার অনুমতিও ছিল না; কারা কর্তৃপক্ষ সাক্ষাৎ নিষিদ্ধ করে রেখেছিল। ইসরায়েলি অভিযোগ অনুযায়ী, আবদেল জাওয়াদ হত্যা, হত্যাচেষ্টা ও ষড়যন্ত্রের অভিযোগে যাবজ্জীবন কারাদ- পান। ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে যখন শত শত ফিলিস্তিনি বন্দি মুক্তি পেয়েছিল, তখন শামাসনে ভাইদের নাম সেই তালিকায় ছিল না। বাবা ইউসুফ বলেন, ‘আগেরবার আশা ছিল, কিন্তু তা পূরণ হয়নি। এবার মনে হচ্ছে সত্যিই তারা ফিরবে।’

মুক্তির খবর নিশ্চিত হলেও পরিবার কিছুটা উদ্বিগ্ন। কারণ অতীতে অনেক বন্দিকে মুক্তি দেওয়ার পর বিদেশে নির্বাসনে পাঠানো হয়েছিল। ইউসুফ শঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, ‘আমি চাই তারা এখানেই ফিরুক। বিদেশে পাঠালে আমরা তাদের আর দেখতে পাব না।’

পূর্বের বন্দি বিনিময় চুক্তিতে পরিবারগুলো অপেক্ষা করত, তারপর জানত যে তাদের স্বজন পশ্চিম তীর ত্যাগ করতে পারবে না এবং অন্যত্র বহিষ্কৃত পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে পারবে না। মুক্ত হওয়া অনেকেই অনুরূপ সীমাবদ্ধতার মুখোমুখি হবেন। তারা পশ্চিম তীরে ফিরে গিয়ে পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে পারবেন না। কিছু পরিবারের জন্য এই মুহূর্ত অনেক দেরিতে এসেছে। আইদা শরণার্থীশিবিরের এক বন্দির মা ৩২ বছর ধরে ছেলের মুক্তির অপেক্ষায়। ছেলেকে মুক্ত দেখার আগেই তিনি আগস্টে মারা গেছেন। অনেকের জন্য এই দিন আনন্দ ও শোকের সমন্বয়ে ভরা থাকবে।

বিবিসির সংবাদদাতা টম বেনেট জানিয়েছেন, ২৫০ জন ফিলিস্তিনি বন্দি এবং গাজা থেকে আটক ১ হাজার ৭০০ জনকে মুক্তি পেয়েছে। তাদের মধ্যে ২২টি শিশুও আছে। ইসরায়েলের সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, দখলকৃত পশ্চিম তীরে ওফার কারাগার থেকে এসব বন্দি মুক্তি পেয়েছেন। শুক্রবার (১০ অক্টোবর) এসব বন্দির নামের তালিকা প্রকাশ করে ইসরায়েলের বিচার মন্ত্রণালয়।

 জিম্মি মুক্তির প্রক্রিয়া শুরুর খবরে তেল আবিবে জড়ো হওয়া মানুষের মধ্যে অশ্রুসজল উচ্ছ্বাস দেখা গেছে। একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে আনন্দের পাশাপাশি কান্নায় ভেঙে পড়েন অনেকে। ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, হামাসের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া সাত জিম্মি কিছুক্ষণ আগে সীমান্ত অতিক্রম করে ইসরায়েলে প্রবেশ করেছেন। তারা এখন প্রাথমিক অভ্যর্থনা কেন্দ্রের দিকে যাচ্ছেন। ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলে ওই কেন্দ্রেই তারা তাদের পরিবারের সদস্যদের সাথে মিলিত হবেন। ওদিকে ‘দ্য হোস্টেজ ও মিসিং ফ্যামিলিজ ফোরাম’ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘ওয়েলকাম হোম’ পোস্ট করে মুক্তি পাওয়াদের স্বাগত জানিয়েছে। এ সংগঠনটি জিম্মি মুক্তির দাবিতে ব্যাপক প্রচার চালিয়ে আসছিল। আমাদের সংগ্রাম শেষ হয়নি। শেষ জিম্মির অবস্থান শনাক্ত ও যথাযথ দাফনের জন্য ফেরত না পাওয়া পর্যন্ত এই সংগ্রাম শেষ হবে না। এটি আমাদের নৈতিক দায়িত্ব, বলেছে সংগঠনটি।

এদিকে, ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, গাজা থেকে দ্বিতীয় দফায় জীবিত জিম্মিদের মুক্তি দিয়ে রেড ক্রসের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। ফিলিস্তিনের শাসকগোষ্ঠী হামাস সোমবার দুপুরে দ্বিতীয় দফায় গাজা থেকে ২০ জন ইসরায়েলি জিম্মিকে মুক্তি দিয়ে রেড ক্রসের কাছে হস্তান্তর করেছে। তবে এখন পর্যন্ত মৃত ২৮ জন ইসরায়েলি জিম্মির মরদেহ হস্তান্তর করেনি হামাস। মৃত জিম্মিদের মধ্যে কতজনের মরদেহ আজ হস্তান্তর করা হবে তা স্পষ্ট নয়। আলজাজিরার প্রতিবেদন বলছে, ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ, মার্কিন পক্ষ এবং মধ্যস্থতাকারীরা আগে থেকেই জানতেন যে, সবার মরদেহ আজ ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। কারণ যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলেও গাজা ভূখ-ের প্রায় ৫৩ শতাংশ এখনো ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। দুই বছরের যুদ্ধে ইসরায়েলি বাহিনী পুরো গাজা উপত্যকাকে কার্যত ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে। এ কারণে মৃত জিম্মিদের দেহাবশেষ খুঁজে বের করতে সমস্যায় পড়তে পারে হামাস। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে মরদেহগুলো উদ্ধার করা, তারা কোথায় আছে তা জানা, তাদের অবস্থান নির্ধারণ করা বেশ কঠিন একটি কাজ। এ কাজে বাইরের বিশেষজ্ঞদের হস্তক্ষেপের প্রয়োজন হতে পারে।

মুক্তির এই ধাপটি যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ২০ দফা পরিকল্পনার অধীনে ইসরায়েল ও হামাসের যুদ্ধবিরতি চুক্তির অংশ। প্রথম পর্যায়ে ২৫০ জন বন্দি ছাড়াও যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর আটক ১৭০০-এর বেশি গাজাবাসীকে মুক্তির ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলের ভূখ-ে ঢুকে অতর্কিত হামলা চালায় প্রায় এক হাজার হামাস যোদ্ধা। তারা এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়ে ১ হাজার ২০০ ইসরায়েলিকে হত্যা এবং ২৫১ জনকে জিম্মি করে গাজায় নিয়ে যায়। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর এটি ছিল দেশটির ইতিহাসে সবচেয়ে প্রাণঘাতী হামলা।

পরদিনÑ অর্থাৎ ৮ অক্টোবর হামাসের হামলার জবাবে গাজায় ব্যাপক সামরিক অভিযান শুরু করে ইসরায়েল। ভয়াবহ সেই অভিযানে গত দুই বছরে গাজায় ৬৭ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত এবং প্রায় ১ লাখ ৭০ হাজার আহত হয়েছেন।