যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে ‘নো কিংস’ স্লোগান সামনে রেখে ট্রাম্পবিরোধী ব্যাপক বিক্ষোভ চলছে। সড়ক ও পাতাল রেলেও প্রবেশপথগুলো লোকে লোকারণ্য হয়ে পড়েছিল। তারা ‘রাজতন্ত্র নয়, গণতন্ত্র’ এবং ‘সংবিধান বিকল্প কিছু নয়’- এমন স্লোগান সংবলিত প্ল্যাকার্ড বহন করেছেন। নিউ ইয়র্ক, ওয়াশিংটন, লস অ্যাঞ্জেলেসসহ ছোট শহরগুলোতেও লাখ লাখ মানুষ রাস্তায় নেমেছে। বিক্ষোভকারীরা ট্রাম্প প্রশাসনের কর্তৃত্ববাদী নীতির প্রতিবাদ জানাচ্ছে। এতে রাজনীতিক, শিল্পী, সাধারণ নাগরিক থেকে শুরু করে প্রবীণরাও অংশ নিয়েছেন। শনিবার (১৮ অক্টোবর) এক বিবৃতিতে আয়োজকরা বলেছেন, ট্রাম্পের নীতির বিরুদ্ধে দেশব্যাপী বিক্ষোভে কমপক্ষে ৭০ লাখ মানুষ অংশ নিয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়, জনতা অহিংসভাবে কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে একসঙ্গে দাঁড়িয়েছে এবং নিশ্চিত করেছে যে, এই দেশ জনগণের, রাজাদের নয়।
আয়োজকরা আরও বলেছেন, মার্কিন ইতিহাসের বৃহত্তম বিক্ষোভগুলোর মধ্যে একটিতে আজ প্রায় ৭০ মিলিয়ন আমেরিকান ২ হাজার ৭০০টিরও বেশি শহরে শান্তিপূর্ণ কর্মকা-ের জন্য একত্রিত হয়েছে। বিক্ষোভকারীরা অভিযোগ করছেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান না হয়ে ‘রাজা’ হিসেবে স্বৈরশাসন চালাচ্ছেন। তারা বলছেন, ট্রাম্প তার কার্যনির্বাহী ক্ষমতার সীমা অতিক্রম করছেন এবং জনগণ এই অতিরিক্ত ক্ষমতা সহ্য করবে না।
আন্দোলনের অংশ হিসেবে বিক্ষোভকারীরা ব্যানার, ব্যালুন ও নানা স্লোগান হাতে মিছিল করেছেন। ১৮ দিন ধরে চলা শাটডাউনের মধ্যে অনুষ্ঠিত এই বিক্ষোভগুলো ট্রাম্পের কর্মকা-ের বহিঃপ্রকাশ। আমেরিকান সিভিল লিবার্টিজ ইউনিয়ন জানিয়েছে, তাদের আইনজীবী দল শান্তিপূর্ণ ও সুসংগঠিত মার্চ নিশ্চিত করতে মাঠে কাজ করছে। এর আগে পূর্ববর্তী নো কিংস বিক্ষোভগুলো ১৪ জুন ট্রাম্পের জন্মদিনে এবং ওয়াশিংটনে সামরিক কুচকাওয়াজের দিনে হয়েছিল। সেসব বিক্ষোভে শহরগুলোতে কমপক্ষে ২১০০টি বিক্ষোভে প্রায় ৫০ লাখ মানুষ অংশ নিয়েছিল। এদিকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ফক্স বিজনেসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, তিনি ‘রাজা নন’। শনিবার সারা দেশে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া ‘নো কিংস’ প্রতিবাদ কর্মসূচির আগে তিনি এ কথা বলেন। তবে তিনি একই সঙ্গে দাবি করেন যে, চলমান সরকারি শাটডাউন তাকে এককভাবে ফেডারেল কর্মসূচি বন্ধ করে দেওয়ার ক্ষমতা দিয়েছে।
শীর্ষ রিপাবলিকান নেতারা বারবার এই প্রতিবাদগুলোকে ‘আমেরিকা-বিরোধী’ সমাবেশ বলে অভিহিত করেছেন। তবে আয়োজকরা বলেন, এ কর্মসূচির উদ্দেশ্য আমেরিকাকে ঘৃণা করা নয়; বরং ট্রাম্প প্রশাসনের প্রতি সাধারণ মানুষের অসন্তোষ প্রকাশের সুযোগ করে দেওয়া। ফক্স বিজনেসের মারিয়া বার্তিরোমোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ট্রাম্প বলেন, ‘ওরা আমাকে রাজা বলে ডাকছে। আমি কোনো রাজা নই।’ সাক্ষাৎকারের ক্লিপটি শুক্রবার প্রকাশ করা হয়। ট্রাম্প আরও বলেন, ডেমোক্র্যাটরা চাইলে সরকার থেকে ‘চিরতরে’ দূরে থাকতে পারে, যাতে তিনি ডেমোক্র্যাটদের অগ্রাধিকারের বিষয়গুলোÑ যেমন ওয়েলফেয়ার কর্মসূচিÑ কেটে দিতে পারেন। তিনি বলেন, ‘ওরা একটা ভুল করেছে, তারা সেটা বুঝতে পারেনি। এতে আমার এমন অধিকার তৈরি হয়েছে, যাতে আমি সেসব কর্মসূচি বন্ধ করতে পারি, যেগুলো রিপাবলিকানরা কখনোই চাইত না। আমরা সেটা করছি, আর আমরা সেগুলো স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দিচ্ছি।’ তবে সংবিধানের প্রথম অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, সরকারের ব্যয় ও কোন কর্মসূচিতে অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হবেÑ এই ক্ষমতা প্রেসিডেন্টের নয়, কংগ্রেসের হাতে।
আগামী শনিবার যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টি অঙ্গরাজ্যে আড়াই হাজারেরও বেশি ‘নো কিংস’ প্রতিবাদ কর্মসূচি আয়োজনের পরিকল্পনা রয়েছে। এসব কর্মসূচির আয়োজক বা সহযোগী সংগঠনের মধ্যে রয়েছেÑ আমেরিকান সিভিল লিবার্টিজ ইউনিয়ন (এসিএলইউ), আমেরিকান ফেডারেশন অব টিচার্স, হিউম্যান রাইটস ক্যাম্পেইন, ইনডিভিজিবল, মুভঅনসহ আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। শীর্ষস্থানীয় রিপাবলিকান নেতারা, বিশেষ করে প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার মাইক জনসন (রিপাবলিকান-লুইজিয়ানা), আগেভাগেই এই প্রতিবাদগুলোকে ‘আমেরিকা-বিদ্বেষী সমাবেশ’ এবং ‘অ্যান্টিফা পরিচালিত আন্দোলন’ বলে সমালোচনা করেছেন। তবে জনসন শুক্রবার বলেন, ‘এই দেশে শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশ বা প্রতিবাদের অধিকার প্রয়োগ করতে চাইলে কারো পথে কোনো বাধা তৈরি করা হবে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘এটাই প্রমাণ করে, আমাদের প্রজাতন্ত্র কতটা শক্তিশালী, আর আমেরিকা কতটা সুন্দর একটি দেশ।
তারা এমন একটি দেশের সমালোচনা করছে, যে দেশ তাদের এই অধিকার প্রয়োগের সুযোগ দিচ্ছে।’ সরকারি শাটডাউন চালিয়ে যাওয়ার মতো কোনো যুক্তি এখন আর স্পিকার জনসনের হাতে নেই’, আগেই অ্যাক্সিওসের এপ্রিল রুবিনকে দেওয়া এক বিবৃতিতে এমনটাই বলেন ‘নো কিংস’ আন্দোলনের আয়োজকরা। তাদের দাবি, সরকার আবার চালু করা, সাশ্রয়ী স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা কিংবা শ্রমজীবী মানুষের জন্য জীবনযাত্রার ব্যয় কমানোর কাজ করার বদলে জনসন এখন আক্রমণ করছেন সেই লাখ লাখ আমেরিকানকে, যারা শান্তিপূর্ণভাবে একত্রিত হয়ে বলছেনÑ আমেরিকা জনগণের, কোনো রাজার নয়। যদিও ট্রাম্প নিজেই একসময় বলেছিলেন, পুনর্নির্বাচিত হলে তিনি ‘প্রথম দিন’ থেকেই একজন স্বৈরশাসকের (ডিক্টেটর) মতো আচরণ করবেন।
এ বছর শুরুর দিকে যখন তিনি স্থানীয় সরকারগুলোর অনুমতি ছাড়াই ন্যাশনাল গার্ড পাঠিয়েছিলেন, ডেমোক্র্যাট-নিয়ন্ত্রিত (ব্লু) শহরগুলোতে, তখন তার স্বৈরাচারী আচরণের অভিযোগে সমালোচনা করা হয়। জবাবে ট্রাম্প বলেন, ‘আমি কোনো স্বৈরশাসককে পছন্দ করি না। আমি স্বৈরশাসক নই। আমি সাধারণ জ্ঞানে সমৃদ্ধ ও বুদ্ধিমান একজন মানুষ।’ এ ছাড়া, গত ফেব্রুয়ারিতে হোয়াইট হাউসের সরকারি এক্স (টুইটার) অ্যাকাউন্ট তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে, কারণ তারা প্রেসিডেন্টের একটি ভুয়া টাইম ম্যাগাজিনের কাভার ছবি পোস্ট করেছিল। সেখানে ট্রাম্পকে মুকুট পরা অবস্থায় দেখানো হয় এবং ওপরে লেখা ছিলÑ ‘রাজা দীর্ঘজীবী হোন!’
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার ‘ট্রুথ সোশ্যাল’ অ্যাকাউন্টে এআই-নির্মিত একটি ভিডিও পোস্ট করেছেন। ওই ভিডিওতে দেখা যায়, তিনি মাথায় মুকুট পরে ‘কিং ট্রাম্প’ লেখা একটি যুদ্ধবিমান চালাচ্ছেন এবং ‘নো কিংস’ লেখা ব্যানারের বিক্ষোভকারীদের ওপর বাদামি রঙের তরল ফেলছেন। ভিডিওটি ট্রাম্পের ব্যক্তিগত ও সরকারি উভয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম অ্যাকাউন্টে শেয়ার করা হয়। এতে দেখা যায়, টাইমস স্কয়ারের ওপর দিয়ে ট্রাম্পের বিমান উড়ে যাচ্ছে এবং বিক্ষোভকারীদের ওপর তরল বোমা ঢালছে। ব্যাকরাউন্ডে বাজছে কেনি লগিনসের জনপ্রিয় গান ‘ডেঞ্জার জোন’। ‘নো কিংস’ নামে আয়োজিত বিক্ষোভটি যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টি অঙ্গরাজ্যে অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে আয়োজকদের দাবি অনুযায়ী প্রায় ৭০ লাখ মানুষ অংশ নেয়। এ কর্মসূচিকে নিয়ে রিপাবলিকানরা শুরু থেকেই অতিরঞ্জিত মন্তব্য, সমালোচনা এবং উপহাস করতে থাকেন।
কংগ্রেসের স্পিকার মাইক জনসনসহ রিপাবলিকান নেতারা এ বিক্ষোভকে আমেরিকাবিদ্বেষী হিসেবে অভিহিত করেন। পরিবহনমন্ত্রী শন ডাফি দাবি করেন, এসব বিক্ষোভে অংশগ্রহণকারীরা হামাসপন্থি অথবা অ্যান্টিফা (ট্রাম্প প্রশাসন এটিকে সন্ত্রাসীগোষ্ঠী হিসেবে বিবেচনা করে) সংগঠনের এজেন্ট।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন