সাদামাটা ছোট্ট একটি হলঘর। সাদা রঙের দেয়ালঘেরা জায়গাটি। বেশ কয়েকজন মা ও স্ত্রী চুপচাপ বসে আছেন সামনের সারিতে। বাবা, ভাই ও বন্ধুরা দাঁড়িয়ে আছেন পেছনের দিকে। দেয়াল ঘেঁষে। সবার চোখ স্থির একদিকে। ফিলিস্তিনের গাজার দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত খান ইউনিসের নাসের মেডিকেল কমপ্লেক্সের ওই কক্ষের একটি স্ক্রিনের দিকে। সেখানে দেখানো হচ্ছে পচে-গেলে যাওয়া মরদেহের ছবি। এসব দেহাবশেষের কোনো একটি হয়তো তাদেরই এক প্রিয়জনের। গাজার স্থানীয় কর্তৃপক্ষের আমন্ত্রণে এখানে এসেছে পরিবারগুলো। নিবিষ্টভাবে ছবিগুলো দেখছেন পরিবারের সদস্যরা। এ আশায় যে, ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে নিহত এই ফিলিস্তিনিদের মধ্যে যদি নিখোঁজ স্বজনকে শনাক্ত করা যায়। মরদেহগুলো সম্প্রতি ফিলিস্তিনের সংগঠন হামাসের সঙ্গে হওয়া বন্দি বিনিময় চুক্তির অংশ হিসেবে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ হস্তান্তর করেছে। মরদেহগুলোতে নির্যাতন ও পচনের সুস্পষ্ট চিহ্ন রয়েছে। তবে এগুলো ফেরত দেওয়া হয়েছে শনাক্তকরণের কোনো উপায় ছাড়াই। এমনকি মৃত্যুর তারিখ বা স্থানেরও উল্লেখ করা হয়নি। গাজায় ডিএনএ পরীক্ষার সরঞ্জাম না থাকায় স্বজনদের জন্য তাদের প্রিয়জনকে শনাক্ত করার একমাত্র উপায় হলো পচে-গলে বিকৃত হয়ে যাওয়া মরদেহের ছবি মনোযোগ দিয়ে দেখা। এটি যেমন নিদারুণ যন্ত্রণাভরা এক প্রক্রিয়া, ঠিক তেমনি আর কোনো উপায়ও নেই। পচা-গলা মরদেহের ছবি দেখে পরিচয়ের সূত্র খুঁজতে থাকা শোকাহত মায়েদের একজন ওয়াফা আল-আলোউল। ৪৫ বছর বয়সী এই নারী বর্তমানে চিকিৎসার জন্য মিশরে রয়েছেন। ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় শনাক্ত করার অংশ হিসেবে মরদেহের ছবিগুলো অনলাইনে পরিবারের সদস্যদের জন্য প্রকাশ করেছে। এরপর থেকে তিনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা ছবিগুলো দেখছেন।
ওয়াফার ছেলে মোহাম্মদ আল–আলোউল কোনো চিহ্ন পান কি না খুঁজে দেখছেন। গত সেপ্টেম্বরে তার ছেলে নিখোঁজ হয়েছিল। মিডল ইস্ট আইকে তিনি বলেন, ‘আমি মরদেহগুলোর মধ্যে তার মুখটা খুঁজে বেড়াই।’ হামাসের সঙ্গে চুক্তির অংশ হিসেবে ইসরায়েল এখন পর্যন্ত ২৭০ জনের মরদেহ ফেরত দিয়েছে। এসব মরদেহের বেশির ভাগ পচে এতটাই বিকৃত হয়ে গেছে যে, শনাক্ত করার উপায় নেই। কিছু মরদেহের হাত-পা নেই, কিছু ছিল হাতকড়া পরা বা চোখ বাঁধা অবস্থায়। মরদেহগুলোতে নির্যাতন ও বিচারবহির্ভূত হত্যার স্পষ্ট চিহ্ন দেখা গেছে। মোহাম্মদের মা বলেন, ‘আমি চুল থেকে হাত, উচ্চতা এবং জুতোÑ প্রতিটি খুঁটিনাটি মনোযোগ দিয়ে দেখি। আর কেবলই হতাশায় ভেঙে পড়ি। আমার আত্মীয়রা ইসরায়েলের ফেরত দেওয়া মরদেহগুলো খুঁজেছে, কিন্তু তারা তাকে খুঁজে পায়নি।’ হামাসের সঙ্গে চুক্তির অংশ হিসেবে ইসরায়েল এখন পর্যন্ত ২৭০ জনের মরদেহ ফেরত দিয়েছে। এসব মরদেহের বেশির ভাগ পচে এতটাই বিকৃত হয়ে গেছে যে, শনাক্ত করার উপায় নেই। কিছু মরদেহের হাত-পা নেই, কিছু ছিল হাতকড়া পরা বা চোখ বাঁধা অবস্থায়। মরদেহগুলোতে নির্যাতন ও বিচারবহির্ভূত হত্যার স্পষ্ট চিহ্ন দেখা গেছে। এখন পর্যন্ত স্বজনদের মাধ্যমে মাত্র ৭৮ জনকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে।
গাজায় ইসরায়েলি গণহত্যা শুরু হওয়ার পর থেকে আনুমানিক ১০ হাজার মানুষ এখনো নিখোঁজ রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তাদের বেশির ভাগের মরদেহই ইসরায়েলি হামলায় বিধ্বস্ত ঘরবাড়ি বা স্থাপনার ধ্বংসস্তূপের নিচে আছে বলে মনে করা হচ্ছে। জেনেভাভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন ইউরো-মেড হিউম্যান রাইটস মনিটরের হিসাবে তুলে নেওয়া প্রায় ২ হাজার ৭০০ ফিলিস্তিনি এখনো ইসরায়েলি হেফাজতে রয়েছে। তবে তাদের ভাগ্যে কী ঘটেছে, সে বিষয়ে কোনো তথ্য নেই।
ওয়াফা বলেন, ‘মরদেহ শনাক্তকারী দলের দিকে তাকিয়ে আর বন্দিদের তালিকায় নজর রাখতে রাখতে এখন আমার সময় কাটছে।’ তিনি বলেন, ‘কখনো কখনো আমি বন্দিদের মধ্যে তার নাম দেখার আশা করি। আবার কখনো কখনো ভয়ে থাকি, নিহতদের ছবির মধ্যে যদি তাকে দেখি।’
গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যার শিকার হয়েছে প্রায় ৬৯ হাজার ফিলিস্তিনি। প্রায় দুই বছর ধরে চলা হামলায় অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় এখন মাত্র হাতেগোনা কয়েকটি স্বাস্থ্যকেন্দ্র চালু রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) জানিয়েছে, গাজার স্বাস্থ্যব্যবস্থার ৯২ শতাংশেরও বেশি ধ্বংস হয়ে গেছে। এর মধ্যে পরিচয়হীন দেহাবশেষ শনাক্তের ফরেনসিক পরিষেবাও রয়েছে। এদিকে যুদ্ধবিরতি সত্ত্বেও ইসরায়েলের অব্যাহত অবরোধের কারণে নতুন ফরেনসিক সরঞ্জাম, যেমন ডিএনএ পরীক্ষার যন্ত্র গাজায় প্রবেশ করতে পারছে না। এতে মরদেহ শনাক্ত করার প্রচেষ্টা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
গাজার উত্তরাঞ্চলের বেত লাহিয়া এলাকায় ওয়াফার পরিবার আশ্রয় নিয়েছিল। সেখানে ইসরায়েলি বোমাবর্ষণে তিনি মারাত্মকভাবে দগ্ধ হন। এরপর গত এপ্রিলে তাকে চিকিৎসার জন্য মিশরে সরিয়ে নেওয়া হয়। সেই থেকে গাজায় থাকা সন্তানদের সঙ্গে আবার মিলিত হওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে অপেক্ষা করছেন ওয়াফা। গত সেপ্টেম্বরে তিনি জানতে পারেন, তার বড় ছেলে মোহাম্মদ নিখোঁজ। সদ্য বাস্তুচ্যুত হওয়া পরিবারের জন্য একটি অস্থায়ী আশ্রয় তৈরি করতে কাঠ ও ত্রিপল খুঁজতে বেরিয়েছিল সে। ওয়াফা বলেন, ‘পরিবারের কেউ শেষবারের মতো তাকে সেদিনই দেখেছিল।’ মোহাম্মদের মা বলেন, ‘পরিবারকে রক্ষা করার জন্য কিছু খুঁজতে সে এক আত্মীয়ের সঙ্গে বের হয়েছিল। তারা দুজনই নিখোঁজ হয়ে যায়, আর কখনো ফেরেনি। সেই থেকে আমি বুকভরা কষ্ট নিয়ে বেঁচে আছি।’ গত অক্টোবরে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পরেও পরিবার কোনো খবর পায়নি। আত্মীয়রা সর্বত্র খুঁজেছেÑ ভবনে, ধ্বংসস্তূপের নিচে, রাস্তার ধারে। কিন্তু কোনো চিহ্নই মেলেনি।
হামাসের সঙ্গে যুদ্ধবিরতির অংশ হিসেবে ইসরায়েল পাঁচ ফিলিস্তিনি বন্দিকে মুক্তি দিয়েছে। এতে গাজায় পরিবারগুলোর মধ্যে কিছুটা স্বস্তি ফিরে এসেছে। এ ছাড়া দখলদার দেশটি ৪৫ ফিলিস্তিনি বন্দির মরদেহও ফেরত দিয়েছে। কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরার প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে। স্থানীয় সময় গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় মুক্তি পান ওই পাঁচ ফিলিস্তিনি। পরে তাদের শারীরিক পরীক্ষার জন্য দেইর আল-বালাহর আল-আকসা হাসপাতালে নেওয়া হয়। হাসপাতালে স্বজনেরা জড়ো হন। কেউ কেউ মুক্ত হওয়া বন্দিদের জড়িয়ে ধরেন, কেউ আবার নিখোঁজ পরিবারের সদস্যদের খোঁজে উদ্বিগ্নভাবে ঘুরে বেড়ান। গাজায় আল জাজিরার সাংবাদিক হিন্দ খুদারি বলেন, ‘যুদ্ধবিরতির পর ইসরায়েলি বাহিনী এই প্রথমবার অজানা ফিলিস্তিনি বন্দিদের মুক্তি দিল।’ ইসরায়েলে এখনো হাজারো ফিলিস্তিনি বন্দি আছেন। তাদের অনেকে অভিযোগ ছাড়াই আটক, যাকে মানবাধিকার সংস্থাগুলো স্বেচ্ছাচারী আটক বলে মনে করে। এর আগে সোমবার গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, আন্তর্জাতিক রেডক্রস কমিটির (আইসিআরসি) মাধ্যমে ইসরায়েল তাদের কাছে আরও ৪৫ ফিলিস্তিনির মরদেহ হস্তান্তর করেছে। এ নিয়ে যুদ্ধবিরতির অংশ হিসেবে এখন পর্যন্ত ২৭০টি মরদেহ গাজায় ফেরত এসেছে। মন্ত্রণালয় বলেছে, ফরেনসিক টিম এখন পর্যন্ত ৭৮টি মরদেহ শনাক্ত করেছে। চিকিৎসা নীতিমালা ও প্রটোকল মেনে পরীক্ষার পর মরদেহগুলো পরিবারের কাছে ফেরত দেওয়া হবে। কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ফেরত পাওয়া অনেক মরদেহে নির্যাতনের চিহ্ন ছিল। কারও হাত বাঁধা, চোখ বেঁধে রাখা, মুখ বিকৃতÑ এমন অবস্থায় মরদেহগুলো পাঠানো হয়েছে। তা ছাড়া মরদেহগুলোর সঙ্গে কোনো শনাক্তকরণ ট্যাগও ছিল না। এই মরদেহ ও বন্দিবিনিময় যুদ্ধবিরতির প্রথম ধাপের অংশ। ১০ অক্টোবর থেকে কার্যকর এই যুদ্ধবিরতি তুরস্ক, মিশর ও কাতারের মধ্যস্থতায় হয়েছে। এতে যুক্তরাষ্ট্রও ভূমিকা রেখেছে।
এদিকে যুদ্ধবিরতি কার্যকর থাকলেও ইসরায়েল হামলা চালানো অব্যাহত রেখেছে। নাসের মেডিকেল কমপ্লেক্সের একটি সূত্র আল জাজিরাকে জানায়, সোমবার রাফাহর উত্তরে ইসরায়েলি গোলাগুলিতে তিনজন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী জানিয়েছে, দক্ষিণ গাজায় তারা বিমান হামলা চালিয়েছে। তাদের দাবি, কিছু ব্যক্তি ‘হলুদ রেখা’ অতিক্রম করেছিল, যা ইসরায়েল নিয়ন্ত্রিত এলাকা। তারা এটিকে যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন বলে অভিহিত করে। এ ঘটনা স্বাধীনভাবে যাচাই করা যায়নি। এ ছাড়া ওই একই ঘটনায় নিহত তিনজন ফিলিস্তিনির কথা ইসরায়েল বলছে কি না, সেটিও পরিষ্কার নয়। কারণ, গাজা শহরের পূর্বাঞ্চলে ইসরায়েলি বাহিনীর গুলিতে যে তিনজন আহত হয়েছে, তাদের মধ্যে একটি শিশুও আছে বলে আল-আহলি আরব হাসপাতালের একটি সূত্র জানিয়েছে। গাজা শহর থেকে আল জাজিরার তারেক আবু আজযুম জানিয়েছেন, ইসরায়েল এখনো কোয়াডকপ্টার ড্রোন ব্যবহার করে আংশিক ধসে যাওয়া ভবনের ওপর গ্রেনেড ফেলছে। তিনি বলেন, স্থানীয় কর্তৃপক্ষ এসব কর্মকা-কে যুদ্ধবিরতির লঙ্ঘন হিসেবে দেখছে। গাজার সরকারি গণমাধ্যম কার্যালয় অভিযোগ করেছে, যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর থেকে ইসরায়েল ১২৫ বারের বেশি লঙ্ঘন করেছে। তারা সতর্ক করে বলেছে, এই হামলাগুলো অব্যাহত থাকলে পূর্ণমাত্রার যুদ্ধ আবার শুরু হতে পারে।

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন