ইউক্রেনের জনবহুল এলাকায় ভয়াবহ ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে রাশিয়া। এতে বহু হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। কিয়েভ কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, বুধবার রাতভর ইউক্রেনের পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর তেরনোপিলে ভারী ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে রাশিয়া। ইউক্রেনের এই জনবহুল এলাকায় রুশ হামলায় অন্তত ১৬ জন নিহত হয়েছে। এ খবর দিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স। এতে বলা হয়, ইউক্রেনের পরিবহন ও জ¦ালানি অবকাঠামোগুলোকে লক্ষ্যবস্তু করেছে মস্কোর সৈন্যরা। এতে অন্তত ৪০ আহত হয়েছে। পাশাপাশি বিদ্যুদ্বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে বেশ কয়েকটি এলাকা। তেরনোপিলের একটি ভবনের উপরিভাগ থেকে আগুনের ফুলকি ও ধোঁয়া উড়তে দেখা গেছে। কিয়েভ কর্তৃপক্ষের দাবি, ৪৭০টির বেশি ড্রোন এবং ৪৮টি ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে হামলা চালায় মস্কো। এতে আরজেসজো ও লুবলিন বিমানবন্দর সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়। এতে স্থানীয়ভাবে দেশের দক্ষিণ-পূর্বাংশের আকাশ যোগাযোগ ব্যাহত হয়েছে।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেন, ‘রাশিয়া রাতভর ইউক্রেনে ৪৭০টিরও বেশি ড্রোন ও ৪৭টি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে।’ দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর খারকিভের তিনটি জেলাও ব্যাপক ড্রোন হামলার শিকার হয়েছে। এতে ৩০ জনেরও বেশি মানুষ আহত হয়েছে, যাদের মধ্যে শিশুও রয়েছে। অনলাইনে ছড়িয়ে পড়া ছবিতে দেখা গেছে, ভবন ও গাড়িতে আগুন ধরে গেছে। ইউক্রেনের জ¦ালানি মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, হামলার কারণে দেশের বেশ কয়েকটি অঞ্চলে বিদ্যুদ্বিভ্রাট দেখা দিয়েছে। বুধবার ভোরের এই হামলা ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়ার পূর্ণমাত্রার আগ্রাসন শুরুর পর পশ্চিম ইউক্রেনে সবচেয়ে প্রাণঘাতী হামলাগুলোর একটি। জেলেনস্কি জানান, তেরনোপিলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে এবং ধ্বংসস্তূপের নিচে মানুষ আটকে থাকতে পারে। হামলায় পশ্চিম ইউক্রেনের অন্যান্য অঞ্চলে জ¦ালানিসুবিধা, পরিবহন ও বেসামরিক অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ইভানো-ফ্রাঙ্কিভস্ক অঞ্চলের জ¦ালানি খাতও হামলার শিকার হয়েছে। সেখানে আহত তিনজনের মধ্যে দুজনই শিশু।
জেলেনস্কি জানান, লাভিভ অঞ্চলেও গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অঞ্চলের প্রধান জানান, একটি জ¦ালানি স্থাপনা লক্ষ্য করে হামলা চালানো হয়েছে। ইউক্রেনের সেনাবাহিনী রাশিয়ার অভ্যন্তরে সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে মার্কিন সরবরাহকৃত দূরপাল্লার এটিএসিএমএস ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করার এক দিন পর রাশিয়া এই হামলা চালিয়েছে। ইউক্রেন প্রথমবারের মতো রাশিয়ায় এটিএসিএমএস ব্যবহার করার কথা স্বীকার করেছে। রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ইউক্রেনকে দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর ভোরোনেজে চারটি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের জন্য অভিযুক্ত করেছে। কিন্তু বলেছে যে, সবগুলো ক্ষেপণাস্ত্র বিমান প্রতিরক্ষাব্যবস্থা দ্বারা ভূপাতিত করা হয়েছে। এদিকে, যুদ্ধ শেষ করার জন্য মার্কিন প্রচেষ্টা পুনরুজ্জীবিত করার প্রয়াসে জেলেনস্কি তুরস্কের রাজধানী আঙ্কারায় যাচ্ছেন।
রাশিয়ার পূর্ণ-স্কেল আক্রমণ শুরুর চতুর্থ বার্ষিকী আগামী ফেব্রুয়ারিতে এগিয়ে আসার সাথে সাথে যুদ্ধের অবসান কীভাবে করা যায়, সে বিষয়ে মস্কো ও কিয়েভ মৌলিক বিরোধিতা বজায় রেখেছে। চলতি মাসের শুরুতে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ জানান, ২০২৪ সালে পুতিন শান্তিচুক্তির জন্য রাশিয়ার শর্তাবলি নির্ধারণ করার পর থেকে তাতে আর কোনো পরিবর্তন হয়নি।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ করার লক্ষ্যে গোপন পরিকল্পনা করছে ট্রাম্প প্রশাসন। এই উদ্যোগের মধ্যে রয়েছে রাশিয়ান কর্মকর্তাদের সঙ্গে গোপন বৈঠক, পাশাপাশি ইউক্রেনের নিরাপত্তা এবং ইউরোপের বিস্তৃত স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার বিষয়গুলো সমাধান করা। মার্কিন সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুসারে, স্পেশাল এভোকোট স্টিভ উইটকফ এই উদ্যোগের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তিনি সরাসরি রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত এবং ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা উপদেষ্টার সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন, যাতে সংঘাতের সম্ভাব্য সমাধান তৈরি করা যায়। খবর অনুযায়ী প্রস্তাবিত পরিকল্পনায় ২৮টি ধারা আছে, যা ইউক্রেনে শান্তি ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা প্রদানকে কেন্দ্র করে। এ ছাড়া এটি ইউরোপের নিরাপত্তাসংক্রান্ত বিস্তৃত বিষয়গুলো সমাধান করতে এবং যুক্তরাষ্ট্রের রাশিয়া ও ইউক্রেনের সঙ্গে ভবিষ্যৎ সম্পর্কের রূপরেখা নির্ধারণে লক্ষ রাখে। যদিও বিস্তারিত তথ্য এখনো গোপন রাখা হয়েছে, তবে বৈঠকের গোপনীয় প্রকৃতি ইঙ্গিত দেয় যে এটি একটি উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ কূটনৈতিক প্রচেষ্টা। বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, কোনো চুক্তিই জিওপলিটিক্যাল পরিস্থিতি পুনরায় রূপান্তর করতে পারে এবং যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র-ইউক্রেন সম্পর্কের ভবিষ্যৎ প্রভাবিত করতে পারে।
ইউক্রেন যুক্তরাষ্ট্রের নির্মিত ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে রাশিয়ায় কয়েক দফা হামলা চালিয়েছে বলে দাবি করেছে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। গতকাল বুধবার মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ইউক্রেনীয় বাহিনী দক্ষিণ রাশিয়ার ভোরোনেজ শহরে বেসামরিক লক্ষ্যবস্তুতে হামলার চেষ্টায় চারটি এটিএসিএমসি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে। এর আগে মঙ্গলবার ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী জানিয়েছিল, তারা যুক্তরাষ্ট্রের সরবরাহকৃত এটিএসিএমসি ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে রাশিয়ার সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে আক্রমণ করেছে, যাকে তারা উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন বলে অভিহিত করেছে। কিয়েভ ২০২৩ সালে এসব ক্ষেপণাস্ত্র হাতে পেয়েছিল, তবে প্রাথমিকভাবে কেবল তাদের নিজস্ব অঞ্চলে এগুলো ব্যবহারের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা ছিল। রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় টেলিগ্রামে এক পোস্টে জানিয়েছে, রাশিয়ার এস-৪০০ বিমান প্রতিরক্ষা ক্রু এবং প্যানসির ক্ষেপণাস্ত্র ও অস্ত্রব্যবস্থা সব এটিএসিএমসি ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করতে সক্ষম হয়েছে। তবে ক্ষেপণাস্ত্রের ধ্বংসাবশেষ পড়ে ভোরোনেজের একটি বাড়ি ও একটি এতিমখানার ছাদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে মন্ত্রণালয় জানিয়েছে।
রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ অবসানের শান্তি প্রচেষ্টা জোরদারে আলোচনায় অংশ নিতে বুধবার তুরস্কে গেছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। তবে, যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ আলোচনায় অংশ নেবেন কি না, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে। কিয়েভ থেকে বার্তা সংস্থা এএফপি এ খবর জানায়। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের প্রধান সহযোগী আন্দ্রি ইয়েরমাক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে লিখেছেন, ‘প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির নেতৃত্বাধীন প্রতিনিধিদলের অংশ হিসেবে তুরস্কে পৌঁছেছি।’ তিনি আরও জানান, উইটকফের সঙ্গে ‘নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ’ রাখছি। তবে, উইটকফ এখনো নিশ্চিত করেননি যে তিনি আলোচনায় অংশ নেবেন কি না।
ইউক্রেনের সঙ্গে রাশিয়ার যুদ্ধ শেষ করতে একটি নতুন পরিকল্পনা নিয়ে গোপনে কাজ করছে ট্রাম্প প্রশাসন। এ পরিকল্পনায় রাশিয়ার পরামর্শ নেওয়া হচ্ছে। মঙ্গলবার মার্কিন ও রাশিয়ান কর্মকর্তাদের বরাতে এ তথ্য জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম অ্যাক্সিওস। ডোনাল্ড ট্রাম্পের গাজা যুদ্ধবিরতি পরিকল্পনার মতো এতে রয়েছে ২৮ দফা রোডম্যাপ।

