সবুজেঘেরা মিলনপুর নামে একটি ছোট্ট গ্রাম ছিল। গ্রামের চারপাশে ছিল সবুজ খেত, বাঁশঝাড়, দীঘি আর বিল ঝিল। গ্রামে অনেক ছোট ছোট বাচ্চা ছেলে-মেয়ে ছিল। তারা সারাদিন মাঠে দৌড়ে বেড়াত, নদীতে সাঁতার কাটত, কখনো গাছে চড়ে পাকা আম কুড়াত। খেলাধুলা, দুষ্টুমি করেই দিন কেটে যেত। বই-খাতা খুলে বসা যেন তাদের জন্য খুব বিরক্তিকর কাজ। কেউ মন দিয়ে পড়তে চাইত না। সে গ্রামের স্কুলটা ছিল কাঁচা ইট আর টিনের ছাউনি দিয়ে তৈরি। স্কুলের বৃদ্ধ শিক্ষক হক মাস্টার অনেক চেষ্টা করলেও বাচ্চাদের পড়ায় মন বসত না। একদিন হক মাস্টার অসুস্থ হয়ে পড়লে গ্রামে এলো নতুন শিক্ষক। তার নাম সাদেক স্যার। সাদেক স্যার বয়সে তরুণ। তিনি খুব সহজে বাচ্চাদের সঙ্গে মিশে যান। প্রথম দিনেই তিনি মাঠে গিয়ে দেখলেন, স্কুলের অনেক বাচ্চাই পড়াশোনা ফাঁকি দিয়ে খেলায় মগ্ন। তিনি ডেকে বললেন, তোমরা সবাই ক্লাসে যাচ্ছ না কেন?
রাহিম নামের এক দুষ্টু ছেলে হেসে উত্তর দিল, স্যার, খেলাই তো মজা! বই পড়লে মাথা ব্যথা করে।
সবাই হেসে উঠল।
স্যারও হেসে বললেন, তাহলে আমি একটা খেলার গল্প শোনাই, কেমন?
সব বাচ্চা ছুটে এসে তার চারপাশে বসে পড়ল। স্যার বলতে শুরু করলেন, এক গ্রামে শুভ নামে একটা ছেলে ছিল। সে সবসময় মজা করত, পড়াশোনা করত না। একদিন খেলতে গিয়ে সে জঙ্গলে হারিয়ে গেল। পথ চেনার মতো জ্ঞান তার ছিল না, কারণ সে কখনো ভূগোল পড়েনি। তখন সে খুব ভয় পেল। যদি সে পড়াশোনা করত, তবে মানচিত্র দেখে পথ খুঁজে নিতে পারত। তাই না বল?
গল্প শুনে বাচ্চারা চুপচাপ হয়ে গেল। স্যার আবার বললেন, পড়াশোনা করলে শুধু বইয়ের অঙ্ক কিংবা অক্ষর শেখা হয় না। পড়াশোনা মানুষকে সাহসী করে, নতুন কিছু জানায়। বই হলো ডানা। এই ডানায় ভর করে মানুষ আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন দেখে।
মিনা নামের এক বুদ্ধিমতী মেয়ে জিজ্ঞেস করল, স্যার, বই পড়ে কি আমরা সত্যি উড়তে পারব?
স্যার মিষ্টি হেসে বললেন, অবশ্যই! তবে আকাশের পাখির মতো ওড়া নয়। বই তোমাদের নিয়ে যাবে দূরের দেশ, নতুন জগত ও স্বপ্নের রাজ্যে।
কথাগুলো শুনে বাচ্চাদের চোখে কৌতূহল জ্বলে উঠল। পরের দিন স্যার ক্লাসে এসে নতুন খেলা শুরু করলেন। তিনি একটা গল্পের বই বের করে বললেন, চলো আজ আমরা বই পড়া দিয়ে খেলা করব। আমি এক লাইন পড়ব, তোমরা পরের লাইন একসঙ্গে পড়বে।
শুরু হলো মজার খেলা। প্রথমে বাচ্চারা জড়তা বোধ করলেও ধীরে ধীরে তারা আনন্দ পেতে লাগল। এমনকি অঙ্কের ছক কষাও যেন মজার খেলায় পরিণত হলো।
একদিন স্যার ব্ল্যাক বোর্ডে লিখলেন, আমরা পড়ব, আমরা শিখব, আমরা বড় হয়ে দেশ গড়ব।
তিনি বাচ্চাদের দাঁড় করিয়ে একসঙ্গে এই স্লোগান দিতে বললেন। ক্লাসজুড়ে প্রতিধ্বনি উঠল।
ধীরে ধীরে গ্রামে বদল আসতে লাগল। কিছুদিন পর জেলা পর্যায়ের একটি কুইজ প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। আশপাশের অনেক স্কুল সেখানে অংশ নিলেও প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অর্জন করল মিলনপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। ?পুরস্কার হাতে পেয়ে রাহিম উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল, স্যার, যদি আপনি আমাদের পড়াশোনার মজা না বোঝাতেন, আমরা কোনোদিন এভাবে জিততে পারতাম না।
স্যার হেসে বললেন, তোমাদের মনেই শক্তি ছিল, আমি শুধু তা জাগিয়ে তুলেছি।
গ্রামের প্রতিটি শিশুর মুখে তখন প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল, আমরা পড়ব, আমরা শিখব, আমরা বড় হয়ে দেশ গড়ব।

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন