সাত দশকেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্পে এক পথিকৃৎ ও স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠানের নাম ‘স্টুডেন্ট ওয়েজ’। প্রতিষ্ঠানটি কেবল একটি প্রকাশনা সংস্থার ভূমিকায় সীমাবদ্ধ নেই; বরং জাতি গঠন, মননশীল চিন্তাচর্চা এবং সৃজনশীল সংস্কৃতির বিকাশে রেখে আসছে গুরুত্বপূর্ণ অবদান। প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই স্টুডেন্ট ওয়েজ যে দর্শন ধারণ করে এগিয়েছে, তা ছিল অনেক বৃহৎ ও সুদূরপ্রসারী। শুধু বই প্রকাশ নয়, বরং একটি প্রজ্ঞাভিত্তিক ও জ্ঞানসমৃদ্ধ সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখার লক্ষ্যে এগিয়ে এসেছে প্রতিষ্ঠানটি। ফলে এর প্রকাশনা কার্যক্রম সাহিত্য, শিক্ষার প্রসার, মানবিক মূল্যবোধের উন্নয়ন এবং প্রগতিশীল চিন্তার চর্চার দিকে নিরন্তর মনোযোগী থেকেছে প্রজšে§র পর প্রজš§। তবে সময়ের গতিপথে পরিবর্তন এসেছে সাহিত্যচর্চার ধরণে। বদলেছে পাঠক এবং লেখকের চাহিদা। সাহিত্যজগতের নানা সংকট ও সম্ভাবনার মধ্য দিয়ে প্রকাশনা শিল্প আজ এক নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি।এই বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে প্রকাশনা শিল্পের বর্তমান অবস্থা, সাহিত্যজগতের নানা ক্রাইসিস, নতুন লেখকের বই প্রকাশে বিভিন্ন ধরনরে সমস্যা ও সমাধান এবং প্রকাশনীর ভবিষ্যৎ স্বপ্নসহ নানা বিষয়ে দৈনিক রূপালী বাংলাদেশের সঙ্গে কথা বলছেনে ‘স্টুডন্টে ওয়েজ’-এর তৃতীয় প্রজন্মের প্রকাশক মো. মাশফিকউল্লাহ তন্ময়। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আরফান হোসাইন রাফি
প্রকাশনা শিল্পের বর্তমান অবস্থা এবং সব মিলিয়ে আপনাদের দিনকাল কেমন কাটছে?
প্রকাশনা শিল্প বর্তমানে এক পরিবর্তনশীল সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ডিজিটাল যুগের জোয়ারে যেখানে পাঠকরা মোবাইল ও অনলাইন মাধ্যমে দ্রুত তথ্য গ্রহণে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে, সেখানে আমাদের মতো প্রকাশকদের জন্য চ্যালেঞ্জ যেমন বেড়েছে, তেমনি সম্ভাবনাও তৈরি হয়েছে। আমরা পাঠকের চাহিদা ও সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কাজ করছি। ছাপার সংস্কৃতি ধরে রাখার পাশাপাশি, আমরা ডিজিটাল কনটেন্ট ও অনলাইন রিচের দিকে নজর দিচ্ছি। শিক্ষার্থী, তরুণ লেখক ও সাধারণ পাঠকদের জন্য মানসম্পন্ন লেখা পৌঁছে দেওয়াই আমাদের মূল লক্ষ্য। তবে বদলে যাচ্ছে পাঠক, বদলে যাচ্ছে মাধ্যম। আগে যেখানে পাঠক বই বা পত্রিকা হাতে নিয়ে সময় কাটাত, এখন তারা হয়তো ইনস্টাগ্রামে বা ফেসবুকে এক মিনিটের রিল দেখছে। এ পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মেলাতে আমরা নতুন লেখা, নতুন ফরম্যাট, এমনকি অডিও বা ভিজ্যুয়াল কনটেন্টের দিকেও ভাবছি।
‘স্টুডেন্ট ওয়েজ’ ৭৫ বছরে পা রেখেছে আপনি কত বছর ধরে এই যাত্রার সঙ্গী?
আমি স্টুডেন্ট ওয়েজের তৃতীয় প্রজন্মের প্রকাশক। আমার দাদা এবং বাবার পর ধারাবাহিকভাবে আমি সরাসরি যুক্ত হয়েছি প্রায় ১২ বছর ধরে। তখন থেকেই এর চিন্তাধারা, মানসম্পন্ন প্রকাশনা আমাকে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত করেছে।
আপনার প্রকাশনী থেকে বই আসা এ পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য লেখক কারা?
স্টুডেন্ট ওয়েজের সঙ্গে এ পর্যন্ত অনেক কিংবদন্তি লেখকের কাজ হয়েছে। যার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য
আনোয়ার পাশা, আহমদ ছফা, ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, মুহাম্মদ আবদুল হাই, আনিসুজ্জামান, শওকত ওসমান, আকবর উদ্দিন, মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ, মযহারুল ইসলাম, নীলিমা ইব্রাহিম প্রফেসর মোবাশ্বের আলী, সৈয়দ শামসুল হক, হুমায়ূন আহমেদ, ইমদাদুল হক মিলন, অধ্যাপক অজিত কুমার গুহ, সেলিনা হোসেন, আবদুল মান্নান সৈয়দ, শামস রশিদ, বেদুইন সামাদ, ড. মনিরুজ্জামান, আহমদ ছফা, শামসুদ্দীন আবুল কালাম, শহীদ আখন্দ, কবি জসিম উদ্দিন, আকবর হোসেন, মোহাম্মদ নাসির আলী, মইনুল আহসান সাবের, লুৎফর রহমান রিটনসহ আরও অনেকে। এ ছাড়া অনেক তরুণ লেখক আমাদের মাধ্যমেই প্রথমবার বই প্রকাশ করেছেন এবং এখন তারা প্রতিষ্ঠিত লেখক হিসেবে স্বীকৃত।
সামনের বইমেলা সম্ভবত রমজান মাসে পড়বে। এ ক্ষেত্রে ঝুঁকি এড়াতে কী ধরনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন বা নেওয়া উচিত বলে মনে করেন?
রমজান মাসে বইমেলা আয়োজন কিছুটা চ্যালেঞ্জিং হলেও, সঠিক পরিকল্পনা থাকলে এটিকে সুযোগে রূপান্তর করা সম্ভব। এটি পাঠক ও প্রকাশকের উভয়ের জন্যই এক ভিন্ন অভিজ্ঞতা হয়ে উঠতে পারে। এ পরিস্থিতিতে বাংলা একাডেমির ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বইমেলার আয়োজন রমজান মাসের আগে বা পরে সরিয়ে নেওয়া, যেমন রমজানের পর ঈদের সপ্তাহে আয়োজন করা যেতে পারে। পুরো মাসব্যাপী মেলার পরিবর্তে ১৫ দিনের সংক্ষিপ্ত ও কার্যকর বইমেলা করা হতে পারে। বাংলা একাডেমি বইমেলার মূল আয়োজক এবং নীতিনির্ধারক। বাংলা একাডেমির সঙ্গে প্রকাশক ও লেখকদের পরামর্শই নির্ধারণ করবে ভবিষ্যতের পথ। আমি আশাবাদী, যৌক্তিক আলোচনা ও সমঝোতার মাধ্যমে এমন একটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে, যাতে পাঠক,
লেখক এবং প্রকাশক সব পক্ষই উপকৃত হয়।
একজন প্রকাশক হিসেবে আপনার যাত্রার শুরুটা কেমন ছিল, সেই গল্পটা জানতে চাই?
আমার প্রকাশক হওয়ার যাত্রা অন্যদের মতো হয়নি। এটি আমার রক্তে, আমার পারিবারিক গর্বে, আমার শৈশবের প্রতিটি মুহূর্তে মিশে রয়েছে। স্টুডেন্ট ওয়েজ আমাদের পারিবারিক প্রতিষ্ঠান, যার সূচনা ১৯৫০ সালে আমার দাদা করেন। এরপর আমার বাবা এ দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়ে প্রতিষ্ঠানকে আরও পরিণত করেন। তিনি ছিলেন এক দূরদৃষ্টি সম্পন্ন মানুষ। বিশ্বাস করতেন, বই কেবল জ্ঞান নয়, আত্মার খোরাক। শৈশব থেকেই বই ছিল আমার নিকটতম সঙ্গী। আমাদের বাড়িতে বই মানেই ছিল জানালার মতো, যেখানে আমি নতুন জগৎ, নতুন ভাবনা, নতুন মানুষ আবিষ্কার করতাম। বইয়ের গন্ধ, ছাপার শব্দ, লেখকদের আগমন সবকিছুই ছিল আমার বেড়ে ওঠার অংশ। আমার বাবার মৃত্যুর পর স্টুডেন্ট ওয়েজের পুরো দায়িত্ব গ্রহণ করি। সেটি ছিল আবেগ, শ্রদ্ধা, আর প্রতিশ্রুতির এক অনন্য মুহূর্ত।
সাহিত্যজগৎ বর্তমানে বইমেলাকেন্দ্রিক হয়ে
পড়েছে। মেলা ছাড়া নতুন লেখক বা পাঠকের আগ্রহ কমে যাচ্ছে-আপনার
মতে সমাধান
কী হতে পারে?
হ্যাঁ, বর্তমানে এমন একটি প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। সাহিত্যের সবই যেন হয় ফেব্রুয়ারির মেলাকে ঘিরেই। ফলে সারা বছরের সাহিত্যচর্চা অনেকটা নিস্তেজ হয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে করণীয় হতে পারে ঋতুভিত্তিক, দিবসভিত্তিক বা বিষয়ভিত্তিক বই প্রকাশ করে পাঠকের আগ্রহ ধরে রাখা। প্রতি বইয়ের জন্য ছোট পরিসরে লঞ্চ ইভেন্ট, লেখক-পাঠক মতবিনিময় আয়োজন জনপ্রিয়তা বাড়াতে পারে। বিভিন্ন শহরে ‘গল্প উৎসব’, ‘লেখক সন্ধ্যা’ আয়োজন করে বইমেলা-নির্ভরতা কমানো যেতে পারে।
‘স্টুডেন্ট ওয়েজ’-এর পাশাপাশি আপনি ‘বর্ষা দুপুর’ নামে একটি প্রকাশনা পরিচালনা করেন। এর পেছনে মূল
উদ্দেশ্য কী?
অনেক প্রতিভা শুধু সুযোগের অভাবে হারিয়ে যায়, আমি চাই না এমনটা হোক। ‘বর্ষা দুপুর’ নতুন লেখকদের জন্য এক সাহসী স্বপ্ন। যেখানে তারা তাদের প্রথম বই প্রকাশের সাহস পায়, আত্মবিশ্বাস গড়ে তোলে
এবং পাঠকের সঙ্গে
যুক্ত হয়।
স্টুডেন্ট ওয়েজ একটি পারিবারিক উত্তরাধিকার যা আমার দাদার হাত ধরে শুরু, বাবার মাধ্যমে সমৃদ্ধ এবং বর্তমানে আমার তত্ত্বাবধানে চলছে। কিন্তু বর্ষাদুপুর এটি সম্পূর্ণ আমার নিজস্ব সৃষ্টি। আমি নিজেই এটি শুরু করি প্রায় ১৫ বছর আগে এবং এটি ছিল আমার একান্ত একটি স্বপ্ন যা তরুণ লেখক, নতুন ভাবনা এবং ভবিষ্যতের সাহিত্য নির্মাণের জন্য তৈরি করেছি।
বর্ষা মানে নতুন সম্ভাবনার বার্তা, আর দুপুর মানে ভরদুপুরে চিন্তার উদ্ভাসন। আমি চাইছিলাম এমন একটি নাম, যা শুনলেই মনে হয় এখানে কিছু আলাদা হচ্ছে, এখানে নতুন শব্দেরা জন্ম নিচ্ছে।
নতুন লেখকের বই প্রকাশে কী ধরনের
সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়? সমাধানের পথ
কী হতে পারে?
নতুন লেখকরা বই প্রকাশে আজকাল যে সমস্যার মুখোমুখি হন, তা শুধু প্রকাশনার ধাপে নয়, বরং লেখালেখির বোধ ও প্রস্তুতিতে গড়ে ওঠে এক শূন্যতা। অনেক তরুণ লেখক ফেসবুক পোস্ট বা অনলাইন কনটেন্ট লেখার অভ্যাস থেকে সরাসরি বই প্রকাশ করতে চান, যা গভীর সাহিত্যচর্চার বদলে একটি তাৎক্ষণিকতা তৈরি করে। আমার পরামর্শ হলো, বই প্রকাশের আগে অনেক বই পড়া দরকার, সাহিত্য বোঝা দরকার, আর প্রথমে পত্রিকায় বা দৈনিক সংবাদপত্রে লেখার চর্চা শুরু করা উচিত। কারণ পাঠ, চিন্তা এবং লেখার কৌশল আয়ত্ত না করে বই প্রকাশ করলে সেটি পাঠকের কাছে প্রভাব ফেলতে পারে না। তাই একজন ভালো লেখক হওয়ার প্রথম ধাপ হলো ভালো পাঠক হওয়া। সাহিত্যের ধারাবাহিকতা, শব্দচয়ন, ভাবগঠন এবং পাঠকের মনস্তত্ত্ব বোঝার জন্য নিয়মিত বই পড়া অত্যন্ত জরুরি। পা-ুলিপি নির্মাণের সময় ধৈর্য ধরে খসড়া লেখার পর অন্তত দুইবার নিজে রিভিউ করে সম্পাদন করা দরকার। শব্দ, সংলাপ, ধারা এবং শেষ পর্যন্ত পাঠককে কী বার্তা দিতে চায়, তা সুস্পষ্টভাবে বোঝা জরুরি। এ ছাড়া লেখার লক্ষ্য নির্ধারণের বিকল্প নেই।
এত দীর্ঘ সময় ধরে প্রতিষ্ঠিত প্রকাশনী ‘স্টুডেন্ট ওয়েজ’ নিয়ে ভবিষ্যৎ স্বপ্ন কী দেখছেন?
আমাদের প্রকাশনীর বয়স এখন ৭৫ বছরের ঊর্ধ্বে। এই প্রকাশনীর উত্তরাধিকার বহন করা মানে শুধু একটি প্রতিষ্ঠান চালিয়ে যাওয়া নয়, বরং একটি বাংলাদেশের প্রকাশনা ইতিহাসের অধ্যায়কে বাঁচিয়ে রাখা। আমি প্রকাশনী নিয়ে স্বপ্ন দেখি ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মিলনে এক নতুন ইতিহাস তৈরি করার। এ জন্য, আমি চাই সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে স্টুডেন্ট ওয়েজের প্রতিটি বই ছাপার পাশাপাশি ই-বুক ও অডিও বুক রূপেও পাঠকের কাছে পৌঁছাক। পাশাপাশি, যারা লেখালেখি শুরু করছেন, তাদের জন্য একটি ‘লেখক তৈরি’ কর্মসূচি চালু করতে চাই, যেখানে তারা লেখা, সম্পাদনা, পাঠক চাহিদা সব বিষয়ে প্রস্তুতি নিতে পারবেন। এর পাশাপাশি, দেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ভাবনার ওপর তথ্যনির্ভর বই প্রকাশ করে স্টুডেন্ট ওয়েজকে গবেষণার এক উৎসস্থানে পরিণত করাও আমার লক্ষ্য। আমি চাই আমাদের প্রকাশিত বইগুলো বিশ্বের বাংলা ভাষাভাষী ও অনুবাদপ্রিয় পাঠকদের হাতে পৌঁছাক, যাতে বাংলাদেশি ভাবনা বিশ্বমঞ্চে জায়গা করে নিতে পারে।
এ ছাড়া পাঠক-মঞ্চ, আলোচনাচক্র ও সামাজিক প্রচারণার মাধ্যমে স্টুডেন্ট ওয়েজকে একটি সচেতন পাঠক-সমাজের অংশ করে তুলতে চাই। কারণ, বই যেন শুধু পণ্য নয়, হয়ে উঠুক চিন্তার উৎস। সর্বোপরি, ৭৫ বছরের স্টুডেন্ট ওয়েজ কেবল সময়ের গায়ে লেখা একটি সংখ্যা নয়, এটি একটি শিকড়গাঁথা প্রতিষ্ঠান, যেখান থেকে প্রকাশনা সংস্কৃতির অনেক শাখা-প্রশাখা জন্ম নিয়েছে। এখন সময় এসেছে, সেই শক্ত শিকড়ের ওপর নতুন স্বপ্নের ডালপালা গজিয়ে তোলার। যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সাহিত্যচর্চা আরও প্রাণবন্ত, আধুনিক এবং বিশ্বমুখী হয়ে উঠতে পারে।
আপনার মতামত লিখুন :