বেসরকারি জীবনবিমা কোম্পানি রূপালী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মো. গোলাম কিবরিয়ার বিরুদ্ধে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। ভুয়া ব্যবসা, মেডিকেল বিল, ভ্রমণ খরচসহ নানান উপায়ে তিনি অর্থ আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ। এমনকি তথ্য গোপন করে বিতর্কিত শিক্ষা সনদ দিয়ে তিনি সিইও হয়েছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে। এসব অভিযোগের বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে বিমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষকে (আইডিআরএ) নির্দেশ দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ।
সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে এ-সংক্রান্ত একটি চিঠি আইডিআরএ চেয়ারম্যান বরাবর পাঠানো হয়েছে। চিঠির সঙ্গে মো. গোলাম কিবরিয়ার বিরুদ্ধে জমা পড়া অভিযোগের কপি সংযুক্ত করে বিধি মোতাবেক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। রূপালী লাইফের ডেপুটি ম্যানেজার (নিরীক্ষা বিভাগ) মো. জহিরুল ইসলাম এ অভিযোগ দিয়েছেন। অভিযোগের কপি অর্থ উপদেষ্টাকে দেওয়ার পাশাপাশি দুর্নীতি দমন কমিশনকেও দেওয়া হয়েছে।
অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, মো. গোলাম কিবরিয়া ২০০০ সালে ভুয়া অভিজ্ঞতার সনদ দেখিয়ে এজিএম হিসেবে যোগ দেন। পরে ভুয়া এমবিএ সনদ দেখিয়ে ২০১৪ সালে সিইওর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। দায়িত্বভার গ্রহণ করে কোম্পানির ভেতরে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়ে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট ও নিজস্ব বলয় সৃষ্টি করেন। এই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে তিনি বহু জাল-জালিয়াতি, বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে ভুয়া বিল-ভাউচার তৈরি করে নানাবিধ খাত থেকে বছরের পর বছর কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করে আসছেন।
কোম্পানির উন্নয়ন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নামে বছর শেষে বণ্টন না করা বিভিন্ন ধরনের কমিশন বিল, ইনসেনটিভ বিল, বেতন-ভাতা প্রভৃতি কমিশন ইনচার্জ মো. আকতার হোসেনের (এভিপি) প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় আত্মসাৎ করেন, যার পরিমাণ ৯৯ হাজার ৩৭৯ টাকা। কমিশন-সংক্রান্ত যেকোনো ধরনের বিল সংশ্লিষ্ট উন্নয়ন কর্মকর্তার ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে পরিশোধের নিয়ম থাকলেও এ ক্ষেত্রে সেই নিয়ম পরিপালন করা হয়নি। এ খাতে বছরের পর বছর নামে-বেনামে নানান জালিয়াতির মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা কমিশন বিল আত্মসাৎ করা হয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে।
২০২৪ সালের ২০ থেকে ২২ ডিসেম্বর রূপালী লাইফের সিইও ঢাকা-চট্টগ্রাম ভ্রমণ করে কোম্পানির ৩৫ হাজার ৯৯২ টাকা আত্মসাৎ করেন বলে অভিযোগ করা হয়েছে। এভাবে পরিবার-পরিজন নিয়ে দেশ-বিদেশে ভ্রমণ করে কোম্পানির লাখ লাখ টাকা তছরুপ করেন বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে। সিইওর দপ্তরে বিভিন্ন সময়ে উন্নয়ন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আগমন দেখিয়ে ওই কর্মীদের নামে ভুয়া বিল-ভাউচার নিজে তৈরি করে, আপ্যায়ন বিল দেখিয়ে তা আত্মসাতের অভিযোগ করা হয়েছে। রূপালী লাইফের সিইও বছরের পর বছর ভুয়া বিল-ভাউচার তৈরি করে লাখ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেন বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, যা তদন্ত করা হলে প্রকৃত আত্মসাতের পরিমাণ বের হয়ে আসবে বলে এতে দাবি করা হয়েছে।
উন্নয়ন সভা, বিভিন্ন দিবস ও প্রচারণা দেখিয়ে বিল তুলে কোম্পানির অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে বলেও অভিযোগ করা হয়েছে। এমনকি কোম্পানির গাড়ি অন্য কর্মকর্তার নামে বরাদ্দ দেখিয়ে সিইও নিজের পরিবারের সদস্যদের সার্বক্ষণিক ব্যবহারের সুযোগ করে দিয়েছেন। কোম্পানির মুরাকিব, ইভিপি ও ইনচার্জ (দাবি বিভাগ) মাওলানা মো. খালিদ সাইফুল্লাহর নামে গ-২০-৯৩৪৬ (এক্সজিও) গাড়িটি বরাদ্দ দেখিয়ে সিইও পরিবার-পরিজনকে সার্বক্ষণিক ব্যবহারের সুযোগ করে দিয়েছেন। এই গাড়ির মাসিক জ¦ালানি, গ্যারেজ বিল ও রক্ষণাবেক্ষণের নামে গাড়ির বরাদ্দের তারিখ থেকে ২০২৫ সালের এপ্রিল পর্যন্ত ১৫ লাখ ৫২ হাজার টাকা তছরুপ করার অভিযোগ তোলা হয়েছে।
কোম্পানির অবলিখন বিভাগের বিভাগীয় ইনচার্জ মো. আব্দুল্লাহ-ইভিপির প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে প্রতি সপ্তাহে গড়ে ২০-২২ হাজার টাকার ভুয়া মেডিকেল বিল-ভাউচার তৈরি করে সিন্ডিকেট সদস্যদের মাধ্যমে বিল দাখিল করার অভিযোগ তোলা হয়েছে। এই বিল অনুমোদন দেন কোম্পানির সিএফও। বছরে পর বছর এভাবে ভুয়া মেডিকেল বিল-ভাউচার তৈরি করে আত্মসাৎ করা হচ্ছে। কোম্পানির সব কেনাকাটা ও সেবা ক্রয়ের মাধ্যম হলো সংস্থাপন বিভাগ। এ বিভাগের আওতাধীন স্টোর বিভাগ, আইটি বিভাগ, পরিবহন বিভাগসহ সব বিভাগের যাবতীয় প্রিন্টিং, স্টেশনারি সামগ্রী এবং সব ধরনের ইলেকট্রিক মালামাল কেনা হয়। গাড়ির যাবতীয় রক্ষণাবেক্ষণ, মেরামত, নতুন গাড়ি ক্রয়সহ গাড়িসংক্রান্ত যাবতীয় কার্যাবলি এই বিভাগের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়।
এই গুরুত্বপূর্ণ বিভাগের দায়িত্বে রয়েছেন কোম্পানিটির আত্মগোপনে থাকা চেয়ারম্যানের আপন খালাতো ভাই মো. সাইদুল ইসলাম (এসভিপি ও ইনচার্জ, সংস্থাপন বিভাগ)। আরেক খালাতো ভাই মেজবাহ উদ্দিন মিলন (এভিপি ও ইনচার্জ, স্টোর বিভাগ)। এ বিভাগের মাধ্যমে পাতানো টেন্ডার দেখিয়ে কোটি কোটি টাকা সুকৌশলে আত্মসাৎ করা হয়েছে বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে। কোম্পানির যাবতীয় কাজ কোম্পানির চেয়ারম্যান ও সিইওর একাধিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান থেকে কেনা ও ছাপানো হয় বলেও অভিযোগ করা হয়েছে।জহিরুল ইসলাম অভিযোগ করেন, রূপালী লাইফে দীর্ঘদিন ধরে ভুয়া ভ্রমণ দেখিয়ে ভুয়া জ¦ালানি বিল-ভাউচার তৈরি করে অর্থ আত্মসাৎ করা হচ্ছে। তদন্ত করা হলে কোটি কোটি টাকার ওপরে আত্মসাতের প্রমাণ পাওয়া যাবে।
তার আরও অভিযোগ, সিইও বিভিন্ন সময়ে ক্যাশ থেকে তার সিন্ডিকেটের মাধ্যমে আইওইউ বাবদ লাখ লাখ টাকা নগদ গ্রহণ করেন। পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন ধরনের ভুয়া বিল-ভাউচারের মাধ্যমে ওই আইওইউর টাকা সমন্বয়ের মাধ্যমে আত্মসাৎ করা হয়। এ বিষয়ে অভিযোগ করা হয়েছে, রূপালী লাইফের সিইও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ হওয়া সত্ত্বেও ক্ষমতার অপব্যবহার করে এবং বিভিন্ন জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে কোম্পানির ভবিষ্য তহবিল থেকে প্রায় ৬০ লাখ টাকা উত্তোলন করেছেন, যা সম্পূর্ণ অনৈতিক ও নিয়মবহির্ভূত কাজ।
রূপালী লাইফের বিভিন্ন প্রকল্পে একাধিক ডামি কোড সৃষ্টি করে ওই ডামি কোডের মাধ্যমে অর্জিত ব্যবসার বিপরীতে বিভিন্ন ধরনের কমিশনের বিল, রিনিউয়াল বিল, ইনসেনটিভ বিল, রিলিজ, মোবাইল ফোন, জ¦ালানি বিলসহ অন্য বিল প্রস্তুত করে আত্মসাৎ করা হয় বলে অভিযোগ করা হয়েছে।
এ ছাড়া বছরের পর বছর ভুয়া ব্যবসা দেখিয়ে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করে ভুয়া কমিশন বিল প্রস্তুত করে আইটি বিভাগের ইনচার্জ ওমর ফারুক সোহেল (সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট), মাওলানা খালিদ সাইফুল্লাহ (ইভিপি) ও মুরাকিব এবং কমিশন ইনচার্জ মো. আকতার হোসেনের (এভিপি) প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় চেয়ারম্যান ও সিইও ওই টাকা অবৈধভাবে উত্তোলন করেন বলে অভিযোগ করা হয়েছে। ভুয়াভাবে প্রদর্শিত ব্যবসার প্রিমিয়ামের টাকা ব্যাংক ও নগদে উপস্থাপন করলেও বাস্তবে কোনো টাকা ব্যাংকে জমা হয় না।
বিতর্কিত দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মো. গোলাম কিবরিয়ার বিবিএ, এমবিএ সনদ ভুয়া বলে প্রকাশিত হওয়ার পর তার পরদিন বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাচন (ফেব্রুয়ারি ২০২৫ তারিখে অনুষ্ঠিত) থেকে তার মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নেন। বিতর্কিত দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভুয়া বিবিএ, এমবিএ সনদ গ্রহণ করে এবং উক্ত সনদ নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএর কাছে দাখিল করে ১০ বছর কোম্পানিতে সিইও হিসেবে কর্মরত। এ বিষয়ে অভিযোগ করা হয়েছে, বছরের পর বছর গ্রাহকদের হয়রানির পাশাপাশি মৃত্যু দাবি চেক, প্রত্যাশিত সুবিধার চেক, মেয়াদোত্তীর্ণ চেকসহ অন্যান্য সেবা থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। মৃত্যু দাবির চেক, মেয়াদোত্তীর্ণ চেক বছরের পর বছর ঘুরেও কাক্সিক্ষত সময়ে গ্রাহকেরা পাচ্ছেন না।
মো. গোলাম কিবরিয়া সিইও হওয়ার পর থেকে সালভিত্তিক কোম্পানির আয়-ব্যয় এবং গ্রাহকদের পেমেন্ট কীভাবে হয়েছে তা নিরপেক্ষ তদন্ত হলে সিইও ও চেয়ারম্যান কী পরিমাণ টাকা লুটপাট করেছেন, তার চিত্র বের হয়ে আসবে বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে। অভিযোগের বিষয়ে রূপালী লাইফের সিইও মো. গোলাম কিবরিয়া বলেন, ‘অর্থ মন্ত্রণালয়ের চিঠিটি আমি দেখেছি। আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ করা হয়েছে, তার সবগুলো মিথ্যা। একটি অভিযোগও সত্য নয়।’