ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

জিইডির বিশ্লেষণ

রাজস্ব ঘাটতি বাড়ায় ব্যাংক নির্ভরতা বাড়িয়েছে সরকার

রূপালী প্রতিবেদক
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২৫, ২০২৫, ১২:৩৭ এএম

বাংলাদেশের অর্থনীতি ২০২৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে এক ধরনের বৈপরীত্যের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। একদিকে রপ্তানি ও রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ছে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে; অন্যদিকে দেশীয় অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ প্রচ- ধাক্কা খেয়েছে। একদিকে দেশের বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি তলানিতে থাকায় বেসরকারি বিনিয়োগে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে।

অন্যদিকে রাজস্ব ঘাটতি বাড়তে থাকায় দেশের কর আদায় কম হওয়ায় রাজস্ব ঘাটতি মেটাতে সরকারের ব্যাংক নির্ভরতা বাড়ায় এ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। ফলে ব্যাংক খাতে সরকারের ঋণের চাপ বেসরকারি খাতকে কার্যত ‘ক্রাউড আউট’ করছে, অর্থাৎ ব্যবসায়ীদের জন্য পর্যাপ্ত ঋণপ্রবাহ সীমিত হয়ে পড়ছে। এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) মাসিক হালনাগাদ প্রতিবেদনে এসব বিশ্লেষণ তুলে ধরা হয়েছে।

এতে বলা হয়, বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, জুন ২০২৫ শেষে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি নেমে এসেছে মাত্র ৬.৪৯ শতাংশে, যা ইতিহাসের সর্বনিম্ন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার অনেক নিচে এ প্রবৃদ্ধি ব্যবসায়ীদের অনাগ্রহ, উচ্চ সুদহার, রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং ব্যাংকগুলোর সতর্ক ঋণ নীতির প্রতিফলন।

অন্যদিকে সরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বিপরীত চিত্র তুলে ধরেছে। জুন শেষে এ খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ১৩ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশে, যা এক বছর আগের ৯ দশমিক ৬৬ শতাংশ থেকে অনেক বেশি। কর আদায় কম হওয়ায় রাজস্ব ঘাটতি মেটাতে সরকারের ব্যাংক নির্ভরতা বাড়ায় এ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। ফলে ব্যাংক খাতে সরকারের ঋণের চাপ বেসরকারি খাতকে কার্যত ‘ক্রাউড আউট’ করছে, অর্থাৎ ব্যবসায়ীদের জন্য পর্যাপ্ত ঋণপ্রবাহ সীমিত হয়ে পড়ছে। এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে।

জিইডি বলছে, অর্থনীতির আরেকটি দুর্বল দিক হলো উন্নয়ন ব্যয়ের ধীরগতি। নতুন অর্থবছর শুরুর প্রথম দুই মাস (জুলাই-আগস্ট, ২০২৫-২৬) এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছে মাত্র ২.৩৯ শতাংশ, যা আগের বছরের একই সময়ের ২.৫৭ শতাংশ থেকেও কম। যদিও আগস্ট মাসে বাস্তবায়ন সামান্য উন্নতি হয়েছে, তবে সামগ্রিক অগ্রগতি কাক্সিক্ষত নয়। এতে বোঝা যায়, প্রকল্প বাস্তবায়নে কাঠামোগত সমস্যাগুলো কাটেনি।

রাজস্ব খাতেও লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থতা দেখা দিয়েছে। আগস্টে রাজস্ব আয় হয়েছে ২৭ হাজার ১৬২ কোটি টাকা, যেখানে লক্ষ্য ছিল ৩০ হাজার ৮৮৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক মাসেই ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা। তবে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় রাজস্ব আয় বেড়েছে ১৭.৬৩ শতাংশ, যা কিছুটা আশার সঞ্চার করলেও টার্গেট পূরণে দীর্ঘ পথ বাকি। অন্যদিকে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কিছুটা স্বস্তি এসেছে। আগস্টে সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি নেমেছে ৮.২৯ শতাংশে, যা গত দুই বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। খাদ্য মূল্যস্ফীতি ৭.৬ শতাংশে স্থিতিশীল থাকলেও নন-ফুড মূল্যস্ফীতি কমে আসায় সামগ্রিক চিত্র উন্নত হয়েছে। চাল, পাঙ্গাস মাছ, ভোজ্যতেলসহ কয়েকটি পণ্যের দাম খাদ্য মূল্যস্ফীতিকে চাঙ্গা রাখলেও আলু ও পেঁয়াজের দামে পতন সামগ্রিক চাপ কিছুটা কমিয়েছে।

অন্যদিকে বহিঃখাত অর্থনীতির চিত্র তুলনামূলকভাবে উজ্জ্বল। রপ্তানি আয় কয়েক মাস ধরেই ৪ হাজার মিলিয়ন মার্কিন ডলারের ওপরে রয়েছে, জুলাইয়ে রপ্তানি আয় পৌঁছেছে প্রায় ৪ হাজার ৭৭০ মিলিয়ন ডলারে। একই সঙ্গে রিজার্ভ বেড়ে আগস্টে দাঁড়িয়েছে ৩১.১৭ বিলিয়ন ডলারে, যা গত বছরের সেপ্টেম্বরের ২৪.৮৬ বিলিয়ন ডলারের তুলনায় অনেক বেশি। ডলারের বিনিময় হারও স্থিতিশীল রয়েছে ১২০-১২২ টাকার মধ্যে, যা ব্যবসায়িক আস্থাকে বাড়াচ্ছে।

তবে সামগ্রিক বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, বহিঃখাতে শক্তিশালী অবস্থান এবং মূল্যস্ফীতিতে স্বস্তি থাকলেও দেশীয় অর্থনীতির আসল চালিকাশক্তি বেসরকারি বিনিয়োগ গভীর সংকটে রয়েছে। প্রাইভেট সেক্টর ক্রেডিট প্রবৃদ্ধির এ রেকর্ড নিম্নগতি যদি কাটানো না যায়, তবে কর্মসংস্থান সৃষ্টি, শিল্প সম্প্রসারণ এবং প্রবৃদ্ধির গতিপথে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে অর্থনীতিবিদরা সতর্ক করছেন।