ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

জাতিসংঘের প্রতিবেদনে দাবি

ভয় আর অবিশ্বাসের নাম ‘আরাকান আর্মি’

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২৫, ২০২৫, ১২:০০ পিএম
বাংলাদেশে আসছে রোহিঙ্গারা। ছবি- রয়টার্স

বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিয়ে ‘রোহিঙ্গাদের দৃষ্টিভঙ্গি: নিরাপদ, মর্যাদাপূর্ণ ও শান্তিপূর্ণ ভবিষ্যতের পথরেখা’ শীর্ষক এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে জাতিসংঘ মানবাধিকার হাই কমিশনার। নতুন এ প্রতিবেদনে, আরাকান আর্মিকে কোনো মুক্তিকামী শক্তি নয় বরং সন্ত্রাসী বা ডাকাত গোষ্ঠী হিসেবে অভিহিত করা হয়। তাদের শাসনামলে রাখাইনে রোহিঙ্গারা কোনোভাবেই নিরাপদ নয় উল্লেখ করে মিয়ানমারের বিদ্রোহী এ সংগঠনকে ভয় আর অবিশ্বাসের আরেক নাম বলে মন্তব্য করা হয়।

মঙ্গলবার (২৩ সেপ্টেম্বর) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বাংলাদেশে জাতিসংঘ আবাসিক সমন্বয়কারীর দপ্তর থেকে এ বিষয়ে জানানো হয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, রাখাইনে চলমান সংঘাতে দেড় লাখের বেশি রোহিঙ্গা ২০২৩ সালের শেষ দিক থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। এর আগে কক্সবাজারে আশ্রয় নিয়েছে ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী। কিন্তু ফেরার স্বপ্ন আজও অধরা।

প্রতিবেদনে অংশ নেওয়া প্রায় সবাই জানিয়েছেন, আরাকান আর্মির শাসনে কোনোভাবেই নিরাপদ থাকা সম্ভব নয়। তাঁদের চোখে এএ কোনো মুক্তিকামী শক্তি নয়, বরং ‘সন্ত্রাসী’ বা ‘ডাকাত’ গোষ্ঠী। অভিযোগ এসেছে,  চলাফেরায় কঠোর বিধিনিষেধ, জোরপূর্বক শ্রম ও শিশু-কিশোরদের সশস্ত্র দলে ভেড়ানো, নারীদের ওপর সহিংসতা, নির্বিচার গ্রেপ্তার আর লুটপাটের ঘটনা নিয়ে।

প্রতিবেদনে অংশ নেওয়া প্রতিটি রোহিঙ্গা একবাক্যে বলেছেন যে, তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য মিয়ানমারে ফেরত যাওয়া। তবে সেই প্রত্যাবর্তন হবে মর্যাদা ও অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার শর্তে। নাগরিকত্ব, পরিচয় স্বীকৃতি, সমান অধিকার, চলাচলের স্বাধীনতা, শিক্ষা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা তাদের প্রধান দাবি। তবে ২০১৭ সালের দমন অভিযান থেকে বেঁচে যাওয়া অনেকে, বিশেষ করে নারী ও প্রতিবন্ধীরা ব্যক্তিগতভাবে ফেরার আগ্রহ হারালেও গোটা জনগোষ্ঠীর প্রত্যাবর্তনের পক্ষে একাত্ম।

অংশগ্রহণকারীদের মতে, সংকটের মূলে রয়েছে গভীর জাতিগত বিদ্বেষ আর ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা। শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হওয়ায় রোহিঙ্গারা রাজনৈতিকভাবেও দুর্বল হয়ে পড়েছে। তাই ভবিষ্যতের জন্য তারা দাবি তুলেছেন অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতন্ত্র, নতুন সংবিধান, আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষী বাহিনীর তত্ত্বাবধানে নিরাপদ অঞ্চল এবং জমি-ঘরবাড়ি ফেরতের।

রোহিঙ্গাদের কাছে ন্যায়বিচার মানে তিনটি বিষয়- নাগরিকত্ব ও অধিকার ফেরত, জমি ও সম্পত্তি পুনরুদ্ধার এবং অপরাধীদের শাস্তি। তবে আন্তর্জাতিক আদালতের দীর্ঘসূত্রতায় অনেকেই সংশয়ে আছেন। প্রতিবেদনে উঠে এসেছে রোহিঙ্গা শিবিরে নেতৃত্বের অভাব এবং প্রবাসী নেতৃত্বের প্রতি অনাস্থা। অনেকেই অভিযোগ করেছেন, স্থানীয় নেতাদের দুর্নীতি ও সশস্ত্র গোষ্ঠীর প্রভাব সাধারণ রোহিঙ্গাদের বিশ্বাস হারিয়ে দিয়েছে। নারী অংশগ্রহণও প্রায় নেই বললেই চলে।

নিরাপত্তার পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের জরুরি চাহিদার তালিকায় রয়েছে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, খাদ্য ও আয়ের সুযোগ। যুবসমাজের কাছে শিক্ষা কেবল ভবিষ্যতের নয়, মর্যাদা ফেরানোরও মাধ্যম। এমন অবস্থায় শুধু ত্রাণ নয়, রাজনৈতিক সমাধানই রোহিঙ্গাদের প্রধান দাবি। তাদের প্রত্যাশা যে, জাতিসংঘ, আঞ্চলিক শক্তি আর মুসলিমপ্রধান দেশগুলো মিয়ানমারের ওপর কূটনৈতিক চাপ বাড়াবে, অপরাধীদের জবাবদিহি নিশ্চিত করবে এবং প্রত্যাবর্তনের পথ তৈরি করবে।

চলমান সংকট মোকাবিলায় প্রতিবেদনে বেশ কয়েকটি সুপারিশ করা হয়েছে। যেমন আরাকান আর্মিকে আন্তর্জাতিক আইন মানতে হবে, গণতন্ত্রপন্থি আন্দোলনে রোহিঙ্গা নিপীড়নের স্বীকৃতি দিতে হবে, যুবসমাজকে উচ্চশিক্ষার সুযোগ দিতে হবে, কূটনৈতিক চাপ ও নিষেধাজ্ঞা জোরদার করতে হবে।