গত পাঁচ অর্থবছরে ইউরোপের দেশ নেদারল্যান্ডসে বাংলাদেশের রপ্তানি বেড়েছে ৯২ শতাংশেরও বেশি। ২০২০-২১ অর্থবছরে যেখানে রপ্তানির পরিমাণ ছিল ১ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলার, সেখানে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে তা দাঁড়িয়েছে ২ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলারে। এই আয়ের সিংহভাগই এসেছে তৈরি পোশাক খাত থেকে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯-২০ অর্থবছরে নেদারল্যান্ডসে বাংলাদেশের রপ্তানির পরিমাণ ছিল ১ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলার। পাঁচ বছরে তা ৯২ শতাংশেরও বেশি বেড়ে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দাঁড়িয়েছে ২ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে। এই প্রবৃদ্ধি নেদারল্যান্ডসের বাজারে বাংলাদেশের পণ্যের প্রতিযোগিতামূলক সক্ষমতা ও দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য সম্পর্কের গভীরতার বৃদ্ধি নির্দেশ করে। অন্যদিকে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে রপ্তানি ১ দশমিক ৯৩ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ২ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে, যা ২১ দশমিক ৮ শতাংশ বেশি।
২০২৪-২৫ অর্থবছরে তৈরি পোশাক রপ্তানি ২১ দশমিক ২১ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ দশমিক ০৮ বিলিয়ন ডলারে, যেখানে এর আগের বছর এ খাত থেকে আয় ছিল ১ দশমিক ৭২ বিলিয়ন ডলার। মোট রপ্তানি আয়ের মধ্যে নিটওয়্যার পণ্যের অবদান ছিল ১ দশমিক ২১ বিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের ৯২৬ মিলিয়ন ডলারের তুলনায় ৩১ দশমিক ৬৯ শতাংশ বেশি। ওভেন পণ্যের রপ্তানি ৯ দশমিক ০৪ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৭৯ মিলিয়ন ডলারে, যেখানে আগের বছর তা ছিল ৭৯৭ মিলিয়ন ডলার। তৈরি পোশাক ছাড়াও অন্য প্রধান রপ্তানিপণ্যের মধ্যে ছিল টেক্সটাইল সামগ্রী ও পুরাতন বস্ত্রজাত পণ্য, যেগুলো থেকে আয় হয়েছে ৫০ মিলিয়ন ডলার। পাদুকা ও অনুরূপ সামগ্রী থেকে আয় হয়েছে ৯৬ দশমিক ৭৫ মিলিয়ন ডলার এবং হেডগিয়ার থেকে ৭ দশমিক ৩৫ মিলিয়ন ডলার।
রপ্তানিকারক ও সংশ্লিষ্টরা জানান, পণ্যের গুণগত মানোন্নয়ন, সাপ্লাই চেইন ব্যবস্থাপনার উন্নতি, টেকসই উৎপাদন, সময়মতো সরবরাহ এবং পণ্যবৈচিত্র্য বৃদ্ধির মতো একাধিক কারণে রপ্তানি আয় উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। এই প্রবৃদ্ধিকে দীর্ঘস্থায়ী করতে এবং বর্তমান গতি ধরে রাখতে বাংলাদেশকে উচ্চমূল্যের খাত যেমনÑ ওষুধশিল্প, আইসিটি সেবা ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্য রপ্তানির দিকে নজর দিতে হবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
আমস্টারডামে ইউরোপীয় ভোক্তাদের জন্য ‘দ্য বেস্ট অব বাংলাদেশ ইন ইউরোপ’ শীর্ষক একটি বিশেষ প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছিল, যা এই বাজারে রপ্তানি বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। প্রদর্শনীটি আয়োজন করে বাংলাদেশ অ্যাপারেল এক্সচেঞ্জ। নেদারল্যান্ডসের ভোক্তারা ফ্যাশন-প্রিয় এবং আধুনিক পোশাকের প্রতি আকৃষ্ট। তারা ফ্যাশনের পেছনে ভালো অর্থ ব্যয় করে, যা বাংলাদেশি পণ্যের চাহিদা বাড়াতে সহায়ক হয়েছে বলে জানান বিজিএমইএর সাবেক পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল। তিনি বর্তমানে ডেনিম এক্সপার্টের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি বলেন, ‘সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশ টেকসই উৎপাদনে দারুণ অগ্রগতি করেছে। নেদারল্যান্ডস পরিবেশ ও টেকসই বিষয়ে অত্যন্ত সচেতন। ফলে ক্রেতারা বাংলাদেশি পণ্যকে অগ্রাধিকার দিচ্ছেন।’ ইউরোপীয় ইউনিয়নের কিছু দেশ নেদারল্যান্ডসের মাধ্যমে পণ্য আমদানি করে, যা রপ্তানি আয় বৃদ্ধির আরেকটি কারণ হতে পারে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
রুবেল আরও বলেন, ‘আমরা আমস্টারডামে ‘দ্য বেস্ট অব বাংলাদেশ’-এর দুটি আসর আয়োজন করেছি, যেখানে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক রপ্তানিকারক তাদের উদ্ভাবনী পণ্য প্রদর্শন করেন। এতে তারা নতুন ক্রেতাদের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে ভালো পরিমাণ অর্ডার পেয়েছেন, যা রপ্তানিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।’
অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘নেদারল্যান্ডসে বাংলাদেশের রপ্তানি পরিধি আরও বিস্তৃত করতে হলে তৈরি পোশাক খাতের ওপর নির্ভরতা কমাতে হবে। বিকল্প হিসেবে সম্ভাবনাময় একটি খাত হচ্ছে চামড়াশিল্প। তবে এই খাতে উন্নতি করতে হলে পরিবেশ ও শ্রমসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে ট্যানারি খাতকে শৃঙ্খলায় আনতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিয়মাবলি পূরণ না করলে বাজারে প্রবেশ সীমিত থাকবে। একই সঙ্গে তৈরি পোশাকের বাইরে বৈচিত্র্যময় রপ্তানি খাতে কৌশলগতভাবে প্রবেশ করাও জরুরি, যাতে বাজারে স্থিতিশীলতা আসে এবং নতুন চাহিদার খাতে প্রবেশ করা যায়। এখন সময় এসেছে বাংলাদেশকে ভলিউম-ভিত্তিক রপ্তানি থেকে সরে এসে মূল্য সংযোজিত, মানসম্পন্ন ও বৈচিত্র্যময় রপ্তানির দিকে এগিয়ে যাওয়ার।’
জাহিদ হোসেন আরও বলেন, ‘নেদারল্যান্ডসে বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান রপ্তানি প্রবণতা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য একটি সম্ভাবনাময় দিক নির্দেশ করে। বিদ্যমান শক্তির যথাযথ ব্যবহার এবং নতুন খাতের অনুসন্ধানের মাধ্যমে বাংলাদেশ এই বাজারে ও তার বাইরেও শক্ত অবস্থান তৈরি করতে পারে।’
জানতে চাইলে ডাচ-বাংলা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির প্রেসিডেন্ট শাখাওয়াত হোসেন মামুন বলেন, নেদারল্যান্ডস বাংলাদেশের অন্যতম বড় রপ্তানি বাজার। তৈরি পোশাক, চামড়াজাত পণ্য ও কৃষিপণ্য ডাচ বাজারে জনপ্রিয়। অন্যদিকে, নেদারল্যান্ডস বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ বিনিয়োগকারী দেশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে নেদারল্যান্ডসের সরাসরি বিনিয়োগ ছিল প্রায় ৩০৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা মোট বিদেশি বিনিয়োগের প্রায় ৮.৭ শতাংশ। এ ছাড়া, দুই দেশের মধ্যে নতুন কর চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়েছে, যার মাধ্যমে বাংলাদেশ এখন নেদারল্যান্ডস থেকে প্রাপ্ত প্রযুক্তি ও সেবার ওপর ১০ শতাংশ উৎস কর নিতে পারবে।

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন