ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০৯ অক্টোবর, ২০২৫

রুচির রেখায় রঙিন সময়

আরশি প্রতিবেদক
প্রকাশিত: অক্টোবর ৯, ২০২৫, ০১:২২ এএম

বাঙালি নারীর ঐতিহ্যবাহী ও অতি জনপ্রিয় পোশাক শাড়ি, আর শাড়ির প্রসঙ্গ এলেই যে পোশাকটি অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়ে তা, ব্লাউজ। শাড়ির শালীনতা বজায় রাখতে এই ঢলঢলে পোশাকটির প্রচলন শুরু হয় উনিশ শতকের মাঝামাঝি। তখন ব্রিটিশ সংস্কৃতির প্রভাবে ভারতীয় নারীরা শালীনতা বজায় রাখতে শুরু করে। বিশ্বের অনেক দেশে এটি বহির্বাস হিসেবে ব্যবহৃত হলেও ভারতীয় উপমহাদেশ তথা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে ব্লাউজ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অন্তর্বাস হিসেবে প্রচলিত। প্রথমে এ পোশাকটি শুধুই সাদামাটা হতো, পরবর্তীতে রাজবাড়ি ও নবাবদের প্রভাবে ব্লাউজে সোনা-রুপার সুতা ও অ্যাম্ব্রয়ডারি যুক্ত হয়। যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন ট্রেন্ডে পরিবর্তিত হয়। চলুন জেনে নেওয়া যাক প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান অবধি ব্লাউজের ট্রেন্ডগুলো সম্পর্কে-

প্রাচীনরূপ:

প্রাচীন ভারতীয় সমাজে নারীরা আলাদা করে ব্লাউজ পরতেন না। তাদের পোশাক ছিল একখ- কাপড়, শাড়ি বা আচ্ছাদনের মাধ্যমে শরীর ঢাকার উপায়। চীন ও ভারত উভয় দেশেই নারীরা শরীরের উপরের অংশ কাপড়ের ভাঁজে আড়াল করতেন, আলাদা ব্লাউজ ছিল অচেনা। ব্লাউজের প্রচলন শুরু হয় মূলত ঔপনিবেশিক যুগে, যখন ব্রিটিশ শাসনের প্রভাবে বাঙালি সমাজে পোশাকে নতুন মাত্রা আসে। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে, শালীনতা রক্ষার জন্য নারীরা শরীর ঢাকার উপযুক্ত পোশাক হিসেবে ব্লাউজ পরা শুরু করেন। সেই সময় ব্লাউজ ছিল একেবারেই সাদা ও সাদামাটা, গলার কাছে ও হাতে সম্পূর্ণ ঢাকা। সমাজ তখন খোলা গলার ধারণা মেনে নিতে প্রস্তুত ছিল না। তবে ধীরে ধীরে রাজবাড়ি ও অভিজাত নারীদের প্রভাবে ব্লাউজে যুক্ত হয় সোনার সুতা, রুপার অ্যাম্ব্রয়ডারি, মখমল ও সিল্ক কাপড়। এতে শালীনতার পাশাপাশি রুচির প্রকাশও ঘটতে শুরু করে।

রুচি পরিবর্তন:

সময়ের সঙ্গে নারীর পোশাকেও শুরু হয় নান্দনিক পরিবর্তন। আগে ব্লাউজ কেবল শাড়ির প্রয়োজনীয় অংশ ছিল, এখন তা হয়ে ওঠে সৌন্দর্যের এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। বিংশ শতকের শুরুতে সাহসী আবির্ভাব ঘটে স্লিভলেস ব্লাউজের। যা প্রকাশের পর নানা বিতর্ক শুরু হয়। সমাজে তখনো এটি নিয়ে নানা বিতর্ক থাকলে, সময় প্রমাণ করেছে এই পরিবর্তনই ব্লাউজকে করেছে বহুমাত্রিক। ব্লাউজে রং ও নকশার বৈচিত্র্য আসতে থাকে। রাজপরিবারের নারীরা পরতে শুরু করেন জরি, মুক্তা, অ্যাম্ব্রয়ডারি ও লেসের কাজ করা ব্লাউজ। দর্জির তৈরি ব্লাউজের কাট, গলার নকশা ও হাতার দৈর্ঘ্যে শুরু হয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা। এভাবে ধীরে ধীরে ব্লাউজের মধ্য দিয়ে নারীরা প্রকাশ করতে থাকেন তাদের রুচি, শ্রেণি ও সামাজিক অবস্থান। পোশাক হয়ে ওঠে পরিচয়ের অংশ।

আধুনিক রূপ:

বর্তমান যুগে ব্লাউজ আর শুধু ঐতিহ্যের ধারক নয়, এটি এক ফ্যাশন স্টেটমেন্ট। বাজারে এখন পাওয়া যায় নানা ধরনের রেডিমেড ও ডিজাইনার ব্লাউজ, যা একদিকে সুবিধাজনক, অন্যদিকে নান্দনিকও বটে। আজকের ব্লাউজের ধরন ও স্টাইল রীতিমতো বৈচিত্র্যময় কটি ব্লাউজ, ক্রপটপ ব্লাউজ, কেপ ব্লাউজ, জ্যাকেট ব্লাউজ, প্রিন্সেস কাট ব্লাউজ, সবই আজ ফ্যাশন জগতে জায়গা করে নিয়েছে। নারীরা এখন নিজেদের গড়ন, অনুষ্ঠান ও রুচি অনুযায়ী বেছে নিচ্ছেন ডিজাইন ও ফেব্রিক। দেশে গরম আবহাওয়া হওয়ায় স্লিভলেস, অফ-শোল্ডার ও সুইটহার্ট নেকলাইন ব্লাউজ বিশেষ জনপ্রিয়। নুডলস স্ট্র্যাপ কিংবা কাঁধে চওড়া স্লিভলেস ব্লাউজ নারীর আত্মপ্রকাশকে আরও সাবলীল করে তুলেছে। এ ছাড়া রাফল, ফ্রিল ও লেস-ওয়ার্ক ব্লাউজ এনে দিচ্ছে ক্লাসি ও রোমান্টিক লুক। বিশেষ অনুষ্ঠান বা পার্টিতে এ ধরনের ব্লাউজ এখন অপরিহার্য। ফেব্রিকের ক্ষেত্রেও এসেছে বৈচিত্র্য সুতি, কাতান, শিফন, সাটিন, সিল্কসহ সব ধরনের কাপড়েই তৈরি হচ্ছে মনোমুগ্ধকর ব্লাউজ।

ট্রেন্ড:

ফ্যাশন সবসময়ই পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে নতুন রূপ নেয়। বর্তমানে ব্লাউজ ডিজাইনে চলছে পুরোনো ও আধুনিক ধারার মেলবন্ধন, এক কথায় ফিউশন ফ্যাশন। রেট্রো ধারার ব্যাকলেস, পিঠখোলা বা ফিতা বাঁধা ব্লাউজ যেমন- ফিরে এসেছে, তেমনি যোগ হয়েছে আধুনিক ভাবনার ছোঁয়া। এক সময়ের কোমরখোলা বা হাকোবা ব্লাউজের ধারাই আজ আবার ফিরে এসেছে নতুন ঢঙে। তবে  সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় হলো, আজকাল টি-শার্ট, ব্রালেট বা মাইক্রো টপ পর্যন্ত ব্লাউজ হিসেবে পরা হচ্ছে। ডিজাইনে যুক্ত হচ্ছে নকশিকাঁথা, ব্লক প্রিন্ট, অ্যাপ্লিক, টাই-ডাই, মিরর ও হ্যান্ড অ্যাম্ব্রয়ডারি।

ফলে ব্লাউজ এখন হয়ে উঠছে একখ- শিল্পকর্ম। নারীরা এক ব্লাউজ এমনভাবে তৈরি করছেন যাতে তা একাধিক শাড়ির সঙ্গে পরা যায় এবং একইসঙ্গে ব্যবহারিক ও ফ্যাশনেবল। এখনকার ট্রেন্ডে মনোক্রোম বা একরঙা ব্লাউজও দারুণ জনপ্রিয়। এই সরলতার মধ্যেই আছে সৌন্দর্য ও গাম্ভীর্যের এক অনন্য প্রকাশ। অন্যদিকে কনট্রাস্ট ব্লাউজ দিচ্ছে উজ্জ্বলতা ও প্রাণবন্ততা (এক শাড়ির সঙ্গে অন্য রঙের ব্লাউজ পরা এখন ফ্যাশনের স্বীকৃত ধারা)। আজকের নারী তার ব্লাউজে নিজের ব্যক্তিত্ব ফুটিয়ে তুলছেন। কেউ রঙে, কেউ কাটে, কেউ আবার নকশায় যোগ করছেন নিজের ছোঁয়া।