ঢাকা শুক্রবার, ০৩ অক্টোবর, ২০২৫

জামায়াত নেতা জবরের কব্জায় এতিমের সম্পদ 

সিলেট ব্যুরো
প্রকাশিত: অক্টোবর ২, ২০২৫, ১১:৪৮ পিএম

মৃত ভাইয়ের সম্পদের প্রতি জামায়াত নেতা আপ্তাবুল ইসলাম জবরের লোভ দীর্ঘদিনের। স্বপ্ন দেখতেন, একদিন ভাইয়ের সব সম্পদ নিজের কবজায় আসবে। সেই ভাইয়ের পুরো পরিবার ইমেগ্র্যান্ট ভিসায় আমেরিকায় যাওয়ার প্রস্তুতি নেওয়ার পর থেকে তার মনের সুপ্ত বাসনা নতুন করে উঁকি দেয়। আপন বড় ভাই নুরুল ইসলামের (ইছন মিয়া) স্ত্রী রাহেনা বেগম গত ২৭ আগস্ট নিউইয়র্কের বিমান ধরার এতিম ভাতিজাদের সম্পত্তি কুক্ষিগত করার স্বপ্ন পূরণে থাকে না কোনো বাধা। লাজ-শরমের বালাই ভুলে তিনি হামলে পড়েন ভাইয়ের সম্পত্তি দখলে। যদিও এর আগে প্রথম দফায় দখলের চেষ্টায় ব্যর্থ হন তিনি। তবে সফল হন সর্বশেষ ১২ সেপ্টেম্বরের অভিযানে। সেদিন দলবল নিয়ে নিজ ভাইয়ের ৭৭ শতক জমি দখল করেন। এ জামায়াত নেতা নিজের নাম ‘জবর’-এর প্রতি সুবিচার করে জবরদখল করেন এতিমের অন্তত অর্ধকোটি টাকার সম্পদ। দখলের পর আবাদী জমিতে ধানও লাগিয়ে দেন লোক দিয়ে। এখন তার চোখ তাদের ঘর ও বাড়ির দিকে। শুধু মরহুম নুরুল ইসলামের পরিবার নয়, জমি ও সম্পদ হারানোর আতঙ্কে আছেন তার বাকি ভাইয়েরাও। ইতিমধ্যে তিনি ফারায়েজ সম্পত্তি নিয়ে ভাইদের বিরুদ্ধে করেছেন একাধিক মামলা। 

দখলবাজ আপ্তাবুল ইসলাম জবর, সিলেটের দক্ষিণ সুরমা উপজেলার দাউদপুর ইউনিয়ন জামায়াতের সভাপতি। নিজের পদের জোরে প্রভাব খাটাচ্ছেন সবখানে। দমিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন সবাইকে। তোয়াক্কা করছেন না কোনো কিছুরই। তদন্তের স্বার্থে দুইবার কাগজপত্রসহ তাকে থানায় ডাকা হলেও তিনি হাজির না হয়ে দেখিয়েছেন বুড়ো আঙুল। এদিকে তার এহেন কর্মকা- ‘অন্যায়’ ও ‘জবর দখল’ হওয়ায় সমর্থন করতে পারেনরি তার অপর দুই ভাই সাইফুল ইসলাম এবং নাজমুল ইসলাম (চান মিয়া)। তারা মরহুম ভাইয়ের পরিবারের পাশে দাঁড়ালে তাদের মামলায় ফাঁসানোর হুমকি দিয়ে নিবৃত্তের চেষ্টা করছেন। ঘটনাটি দক্ষিণ সুরমা উপজেলার দাউদপুর ইউনিয়নের দৌলতপুর গ্রামের। তবে যে ৭৭ শতক জমি দখলে নিয়েছেন জবর, তা পড়েছে গোলাপগঞ্জ উপজেলায়। তাদের গ্রামের বাড়ি দুই উপজেলার সীমান্ত বরাবর।

প্রভাবশালী চাচা কর্তৃক নিজেদের জমি দখলের পর আমেরিকা থেকে নিজের খালা রোমনা বেগম মারফত গোলাপগঞ্জ থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন নুরুল ইসলামের বড় ছেলে আবদুল মুমিন ফয়েজ। এ ছাড়া বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসেও লিখিত অভিযোগ করেছেন তিনি। অভিযোগ পেয়ে তদন্তে নামে পুলিশ। গোলাপগঞ্জ থানার এসআই আনন্দ চন্দ্র সরেজমিনে গিয়ে জামায়াত নেতা জবরের জমি দখলের সত্যতা পান।

ফয়েজের পিতা নুরুল ইসলাম মৃত্যুবরণ করেন ২০২০ সালে। তিনি ছিলেন সিলেট জেলা পরিষদের সদস্য। তার ২ ছেলে ও ১ মেয়ে। সবাই বর্তমানে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন যুক্তরাষ্ট্রে। বাড়ির পাশে থাকা সেই জমি নরুল ইসলাম ১৭ বছর আগে কেনেন। পারিবারিক সূত্র জানায়, জবর দীর্ঘদিন ধরে তার মৃত ভাইয়ের সম্পত্তি দখলের মতলবে ছিলেন। নুরুল ইসলামের পুরো পরিবার যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ী হওয়ার সুযোগ তৈরি হলে তিনি তাদের বাড়ি-ঘর ও সম্পদ দখলের স্বপ্ন দেখেন। কিন্তু এত দিন তার স্ত্রী রাহেনা বেগম দেশে অবস্থান করায় এ চেষ্টা চালাননি জবর। আগস্টের শেষে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে চলে গেলে সেই সুযোগে আপ্তাবুল ইসলাম জবর দখলের চেষ্টা শুরু করেন। শুধু জমি নয়, প্রায় কোটি টাকার ঘর-বাড়িও দখল করতে চান তিনি।

দখল হওয়া জমি ছিল বর্গা চাষে। গ্রামের কামিল মিয়া নামের এক কৃষক সেই জমি চাষ করেন। এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে কামিল মিয়া জানান, যে জমি জবর দখলে নিয়েছেন তার মালিক নুরুল ইসলাম বলেই জানতাম। নুরুল ইসলাম ওই জমি তিনি কেনার পর আমি গত ১৫ থেকে ১৬ বছর ধরে চাষ করছি। ফয়েজের আম্মা আমেরিকা চলে যাওয়ার পর তার চাচা জবর এসে জমি চাষ না দিতে বলেন। কিন্তু ফয়েজ ও তার ভাইদের কথায় জমিতে চাষ দিতে গেলে জবর লোকজন নিয়ে আমাদের তাড়িয়ে দেন এবং জমিতে ধান লাগিয়ে যান। তারা দেশে থাকতে কখনোই তিনি জমির মালিকানা চাইতে আসেননি, ধানও চাননি। বরং পাশের আধাকিয়ার জমির ধান আমিই তাদের ভাগ করে বুঝিয়ে দিতাম। কয়েক দিন আগে আপ্তাবুল ইসলাম বাড়িতে এসে আমাকে শাসিয়ে বলে গেছেন, ‘জমি আমার, ধান আমার। ধান আমিই কেটে নেব। আমার ধানে যেন কেউ হাত না দেয়।’ বিষয়টি আমি জমির মালিক আব্দুল মুমিন ফয়েজদের জানিয়েছি। তিনি জানান, আমি গরীব বর্গা চাষি। ঝামেলা দেখে আমি আর সেই জমি করবো না বলে জানিয়ে দিয়েছি। আমার বউ বাচ্চা নিয়ে বাঁচতে হবে। মামলা মোকদ্দমায় জড়াতে চাই না।

পরিবারের সদস্যদের মাধ্যমে এ প্রতিবেদকের হাতে জমির যে দলিল এসেছে, তাতে দেখা যায়, দখল হওয়া জমি নরুল ইসলামের নামে। বর্গা চাষির কাছ থেকে এত দিন ধরে এই জমিগুলোর ধান নুরুল ইসলামের পরিবার পাচ্ছিলেন। পুরো পরিবার প্রবাসে যাওয়ার আগে পর্যন্ত তিনি কোনো দাবিও করেননি।

যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী আব্দুল মুমিন ফয়েজ মোবাইলে দৈনিক রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমার চাচা জবর অপেক্ষায় ছিলেন, কবে আমার মা আমেরিকা যাবেন। তিনি চলে আসার পর আর অপেক্ষা করেননি। চাচা সঙ্গেই সঙ্গেই আমাদের সম্পদ দখলে নেমেছেন। শুধু জমি নয়, আমাদের বাড়ি-ঘরও তিনি দখলে নিতে চান। আমরা আমেরিকায় সেটেলড হয়ে গেলে কোনো দিন ফিরব না। আমাদের জায়গা-জমির দরকার নেইÑ এসব কথা বলছেন। তিনি জোরজবরদস্তি করে আমাদের সম্পত্তি ভোগ করতে চান।’ ফয়েজ আরও বলেন, ‘রাজনৈতিক পরিচয়ই এখন তার শক্তি। দলীয় প্রভাব ও ক্ষমতা ব্যবহার করে তিনি আমাদের সম্পত্তি দখল করতে চান। তিনি আগে থেকেই চেয়েছিলেন তাকে যেন আমাদের সম্পদ দেখভালের দায়িত্ব দিই। কিন্তু তার মতিগতি ভালো না ঠেকায় আমরা আমাদের অবর্তমানে সব সহায়-সম্পত্তি দেখাশোনার ভার খালা রোমানা বেগমকে দিই। এতে তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে আমাদের জায়গা দখল করে নেন।’ তিনি বলেন, ‘আমরা এখন বাড়ি-ঘর নিয়ে ভয়ে আছি। এরই মধ্যে আমাদের ফুফুতো ভাই কবির আহমদের কাছে তিনি আমাদের ঘরে ওঠার আগ্রহ দেখিয়ে নাকি বলেছেন, তাদের ঘর তো খালি। সেখানে আমি পরিবার নিয়ে থাকতেই পারি।’

জবরের বড় ভাই নাজমুল ইসলাম বলেন, জবর আমাদের পরিবারের আতঙ্ক। তাকে আমরা লন্ডন পাঠিয়েছিলাম। সে সেখান থেকে চলে এসেছে, থাকতে পারেনি। দেশে এসে বিয়ের পর পারিবারিক জমি-জমা নিজের করে নিতে মরিয়া হয়ে ওঠে। আমাদের বাবা সব সম্পদ সমান ভাগ-ভাটোয়ারা হলেও সে খুশি নয়। আমাদের নামে আদালতে মামলা করেছে। যে জমি সে দখল করেছে, সেই ৩ কিয়ার জায়গা আমার ভাই নুরুল ইসলামের। পাশে আধা কিয়ার জায়গা আমাদের সবার। ফয়েজের মা বাড়ি থেকে যেতেই সে সব জমি নিজের দাবি করে বর্গা চাষিদের তাড়িয়ে দিয়েছে। তাদের বলেছে, জমি তার, ধানও সে নেবে।’

তিনি জানান, গত রোববার গোলাপগঞ্জ থানা পুলিশ দুই পক্ষকে কাগজ নিয়ে যেতে বলে। স্পটে গোলাপগঞ্জ থানা পুলিশও এসেছিল। তারা বিস্তারিত জেনে যান। সেদিন ফয়েজের খালা গেলেও জবর যায়নি বলে শুনেছি। তার কাছে প্রমাণ থাকলে না যাবে। সে এখন দাবি করছে, ওই জমি নাকি আমাদের ভাই নুরুল ইসলাম তাকে মৌখিকভাবে দিয়েছেন। এ রকম কিছু হলে আমরাও জানতাম। এসব নিয়ে বেশি কথা বলতে আমাদের বারণও করেছে জবর।

গোলাপগঞ্জ থানার এসআই চন্দ্র বলেন, প্রাথমিক তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। অভিযোগকারীর কাগজপত্র সঠিক হিসেবেই আমরা পেয়েছি। সেই আলোকে প্রতিবেদন দু’সপ্তাহ আগে আদালতে জমা দেওয়া হয়েছে। তিনি জানান, অভিযুক্ত আপ্তাবুল ইসলাম জবরকে দুইবার কাগজপত্রসহ থানায় ডাকা হলেও তিনি হাজির হননি। আপ্তাবকে আমরা একাধিকার দলিল ও প্রমাণ নিয়ে আসতে বলেছিলাম। তিনি কিছুই জমা দিতে পারেননি।

এদিকে অভিযুক্ত আপ্তাবুল ইসলাম জবরের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলতে তার মোবাইলে ফোন দিলে তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে বলেন, ‘দখল করেছি, তো কী করবেন? রিপোর্ট করবেন? করেন। আমিও ২০ বছর সাংবাদিকতা করেছি। এটা কোনো নিউজ নয়।’ তবে তার দাবি, ‘এই জমি আমার। জমির পর্চায় আমার নামে রয়েছে। আমিই এই জমির মালিক।’ এর চেয়ে বেশি কিছু বলতে রাজি হননি তিনি। পরে কথা বলবেন বলে লাইন কেটে দেন।

এ বিষয়ে জেলা জামায়াতের দক্ষিণ সুরমা উপজেলার আমির ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান লোকমান আহমদ বলেন, ‘এরকম অভিযোগ আমরা শুনেছি। পরিবার থেকেও আমাদের কিছুই বলা হয়নি। আমরা খোঁজ নিচ্ছি। তবে এটি তাদের পারিবারিক বিষয়। দলের নয়। জবর দলীয় পরিচয় ব্যবহার করে অন্যায় করলে তার দায় দল নেবে না। তাকেও ছাড় দেওয়া হবে না। আমরা কোনো অন্যায়, অবিচার সহ্য করব না।’