গত শতাব্দীর ষাটের দশক থেকেই যে ইসরায়েলের নিজস্ব পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে, যা কারোরই অজানা নয়। যদিও দেশটিকে এখন পর্যন্ত প্রকাশ্যে বিষয়টি স্বীকার করতে দেখা যায়নি। উল্টো ‘ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির কাছাকাছি রয়েছে’ দাবি করে শুক্রবার (১৩ জুন) দেশটির ওপর হামলা চালায় ইসরায়েল। জবাবে ইরানও পাল্টা ক্ষেপণাস্ত্র হামলা অব্যাহত রেখেছে। এ অবস্থায় দেশ দু'টি মধ্যে সংঘাত ক্রমেই বেড়েই চলছে।
শান্তি ও নিরাপত্তা বিষষক স্পেনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ডেলাস সেন্টার ফর পিস স্টাডিজের গবেষক ও পদার্থবিজ্ঞানী হাভিয়ের বোহিগাস বিবিসিকে বলেছিলেন, মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলই একমাত্র দেশ, যার কাছে পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে।
আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা (আইএইএ) গত মার্চ মাসে জানিয়েছিল যে, ইরান এখন পর্যন্ত ৬০ শতাংশ বিশুদ্ধ ইউরেনিয়াম অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।
এদিকে, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ইরান সহ অন্যান্য দেশগুলো পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তিতে (এনপিটি) স্বাক্ষর করলেও ইসরায়েল এখন পর্যন্ত সই করেনি। ফলে চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী দেশগুলোর মতো একটি নির্দিষ্ট সময় পর পর আইএইএ-কে তাদের সম্ভাব্য পারমাণবিক স্থাপনাগুলো পরিদর্শন করতে দিতে তারা বাধ্য নয়। যদিও ইসরায়েল নিজে আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা'র একজন সদস্য।
পারমাণবিক কর্মসূচির বিষয়ে তথ্য প্রকাশিত হলেও ইসরায়েলের নেতারা নিজ মুখে কখনও সেটি স্বীকার করেননি, আবার অস্বীকারও করতে দেখা যায়নি। এক্ষেত্রে তারা বরং অস্পষ্টতা রাখার নীতি মেনে চলেন।
ইসরায়েলের পারমাণবিক কর্মসূচি সম্পর্কে প্রথমবার তথ্য জানা যায় মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের ১৯৬২ সালের একটি নথি থেকে। গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে দক্ষিণ ইসরায়েলে একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের লক্ষ্যে ফ্রান্স ও ইসরায়েলের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল বলে ওই নথিতে বলা হয়।
ডেলাস সেন্টার ফর পিস স্টাডিজের গবেষক জেভিয়ার বোহিগাস বলেন, ফ্রান্সের সঙ্গে ওই চুক্তির লক্ষ্য ছিল প্লুটোনিয়াম অর্জনের জন্য একটি চুল্লি তৈরি করা হয়।
গুগল ম্যাপে শহরটির অনুসন্ধান করলে দেখা যায়, নেগেভ নিউক্লিয়ার রিসার্চ সেন্টার নামের ওই পরমাণু গবেষক কেন্দ্রটি ডিমোনা শহর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে একটি মরুভূমির মাঝখানে অবস্থিত। প্রথমদিকে ওই স্থাপনাটিকে বস্ত্রশিল্পের কারখানা এবং কৃষি ও ধাতুবিদ্যা সংক্রান্ত গবেষণা কেন্দ্র হিসাবে বর্ণনা করেছিল ইসরায়েল।
পরবর্তীতে ষাটের দশকে এসে ইসরায়েলের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেন-গুরিয়ন তাদের পারমাণবিক কর্মসূচির বিষয়টি প্রথমবার স্বীকার করেন।
যুক্তরাষ্ট্র সরকারের প্রকাশিত গোপন নথি থেকে জানা যায়, ১৯৭৫ সালের মধ্যেই দেশটির সরকার নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল যে, ইসরায়েলের কাছে পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে।
এরপর আশির দশকে এসে পরমাণু প্রকৌশলী মোর্দেচাই ভানুনু ইসরায়েল সরকারের পারমাণবিক কর্মসূচির বিষয় আবারও সামনে আনেন।
ইসরায়েলের পারমাণবিক কর্মসূচি বিষয়ক বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক অ্যাভনার কোহেন এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, পারমাণবিক অস্ত্রের বিষয়ে অস্বচ্ছতার এই নীতি দেশটির ‘সর্বশ্রেষ্ঠ কৌশলগত এবং কূটনৈতিক অর্জন’। এই অস্পষ্টতাই ইসরায়েলকে অস্তিত্বগত হুমকির বিরুদ্ধে নিজেকে রক্ষা করার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে।
নেতানিয়াহু সমর্থন যোগানো ইসরায়েলি গণমাধ্যম ইসরায়েল হায়োম, যা দেশটিতে সবচেয়ে বেশি প্রচারিত সংবাদপত্র, দেশটির পারমাণবিক ক্ষমতা সম্পর্কে ‘গোপনীয়তা’র নীতির বিষয়ে একটি দীর্ঘ নিবন্ধ প্রকাশ করেছে।
সেখানে বলা হয়েছে, ‘ইসরায়েলের প্রাথমিক লক্ষ্য হলো যেকোনো মূল্যে (মধ্যপ্রাচ্যে) পারমাণবিক অস্ত্রের বিস্তার ঠেকানো।কারণ ইসরায়েল তার অস্পষ্টতার নীতি থেকে সরে আসলে মধ্যপ্রাচ্যে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির প্রতিযোগিতা শুরু হতে পারে।’
যদিও পারমাণবিক অস্ত্রের বিস্তার নিয়ন্ত্রণে কাজ করা প্রতিষ্ঠান ‘সেন্টার ফর আর্মস কন্ট্রোল অ্যান্ড নন-প্রলিফারেশন’ জানায়, ইসরায়েলের এই ‘অস্পষ্টতার নীতিই’ বরং মধ্যপ্রাচ্যকে গণবিধ্বংসী অস্ত্রমুক্ত অঞ্চল হিসেবে প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ‘অন্যতম প্রধান বাধা’।
১৯৮৬ সালের পরমাণু প্রকৌশলী মোর্দেচাই ভানুনু জানিয়েছিলেন , ওই সময় ইসরায়েলের কাছে আনুমানিক ১০০ থেকে ২০০টি পারমাণবিক ওয়ারহেড ছিল।
মোর্দেচাই ভানুনু কয়েক শ' ওয়ারহেড থাকার দাবি করলেও পরমাণু অস্ত্র পর্যবেক্ষণকারী সংস্থাগুলো অবশ্য তা বলছে না।
সুইডেনভিত্তিক পরমাণু অস্ত্র পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের মতে, বর্তমানে ইসরায়েলের কাছে ৯০টির মতো ওয়ারহেড থাকতে পারে।
এসব ওয়ারহেড তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় প্লুটোনিয়াম দক্ষিণ ইসরায়েলের ডিমোনা শহরের কাছে অবস্থিত নেগেভ পারমাণবিক গবেষণা কেন্দ্রের চুল্লিতে উৎপাদিত হয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
যদিও ইসরায়েলের সরকার দাবি করে আসছে যে, পরমাণু চুল্লিটির উৎপাদন সক্ষমতা মাত্র ২৬ মেগাওয়াট। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ মনে করেন যে, চুল্লিটির উৎপাদন সক্ষমতা আরও অনেক বেশি।
ইসরায়েলের অন্যান্য পারমাণবিক স্থাপনার মতো এই চুল্লিটিরও আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা'র (আইএইএ) নজরদারির বাইরে রয়েছে। ফলে সেটির অপব্যবহার হচ্ছে কী না এবং পারমাণবিক কর্মসূচি কতটা শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হচ্ছে, সেটি স্বাধীনভাবে যাচাই করার সুযোগ নেই।
আপনার মতামত লিখুন :