ঢাকা রবিবার, ২২ জুন, ২০২৫

দুই মেরুতে বিএনপি-জামায়াত

রুবেল রহমান
প্রকাশিত: জুন ২২, ২০২৫, ১১:১১ এএম
দুই মেরুতে বিএনপি-জামায়াত। ছবি- রূপালী বাংলাদেশ

দীর্ঘ আড়াই দশকের জোট শরিক বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে দূরত্ব বেড়েছে। দীর্ঘদিনের মিত্র জামায়াতের সাথে দিনে দিনে বেড়েই চলেছে দ্বন্দ্ব। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন কেন্দ্র করে দেশের অন্যতম প্রধান দুটি দল এখন মুখোমুখি অবস্থানে। উভয় দলের শীর্ষনেতারা একে অপরের প্রতি করছেন কটাক্ষ। এ অবস্থায় আগামী নির্বাচন সামনে রেখে দল দুটির অবস্থান শেষ পর্যন্ত কোন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছায় সেটাই দেখার বিষয়।

সম্প্রতি লন্ডনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠকের পর কড়া প্রতিক্রিয়া জানায় জামায়াত। প্রতিবাদে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে প্রথম দিনের সংলাপে যোগ দেয়নি জামায়াত। পরে রাতে প্রধান উপদেষ্টার টেলিফোনে অভিমান মুখে পরদিনের বৈঠকে যোগ দেন জামায়াত নেতারা।

লন্ডনে ড. ইউনূস ও তারেক রহমানের বৈঠকের পর যৌথ বিবৃতিতে ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ইঙ্গিত মেলে। তারপরই বেকে বসে জামায়াত। ওই বৈঠকের পরের দিনই বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী অভিযোগ করে, প্রধান উপদেষ্টা একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের প্রতি পক্ষপাত দেখাচ্ছেন, যা দেশে নতুন করে রাজনৈতিক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।

রাজনৈতিক দলের নেতার সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানের যৌথ বিবৃতি তাদের মতে আপত্তির বিষয় বলেও জামায়াত জানায়। এমনকি ওই বৈঠকে নির্বাচনের সময় নির্ধারণের ঘোষণার জন্য তারা প্রতীকী প্রতিবাদ হিসেবে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে গত ১৭ জুন অনুষ্টিত মঙ্গলবারের সংলাপও বয়কট করে। জামায়াতের মতো প্রায় একই সুরে কথা বলে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। তাদের দাবি, সরকার নির্বাচন নিয়ে একটি নির্দিষ্ট দলের দাবিকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে, যা নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য অনুকূল নয়।

এনসিপি আরও বলেছে, নির্বাচনের চূড়ান্ত আলোচনার আগে ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ প্রণয়ন, ‘জুলাই সনদ’ কার্যকর করে মৌলিক সংস্কার আনা এবং একটি ‘বিচারের রোডম্যাপ’ ঘোষণা করা জরুরি। এনসিপির এই অবস্থান ইঙ্গিত দেয়, তারা বর্তমান আলোচনাকে সামগ্রিক গণতান্ত্রিক সংস্কারের পরিবর্তে কিছু দলের রাজনৈতিক এজেন্ডা হিসেবে দেখছে।

যদিও বিএনপির নেতারা জামায়াত ও এনসিপির এ ধরনের অভিযোগ এবং মূল্যায়নকে অযৌক্তিক বলছেন। দলটির নেতারা অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সবার অংশগ্রহণে আসন্ন নির্বাচনে অংশ নেওয়ার অপেক্ষায় রয়েছেন। এদিকে জামায়াত চাচ্ছে সব সংস্কার শেষ করে আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচন। আর বিএনপি চাচ্ছে প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষেই নির্বাচন।

এদিকে জামায়াত এককভাবে ৩০০ আসনে প্রার্থী দেওয়ার ঘোষণা করেছে। ইতোমধ্যে ২৯৪টি আসনে তাদের প্রার্থী চূড়ান্ত করে ফেলেছে বলে জানিয়েছে একটি বিশ্বস্ত সূত্র। এ ছাড়া জামায়াত কয়েকটি ইসলামি দল নিয়ে নির্বাচনি মোর্চা গঠনের প্রয়াস চালাচ্ছে। অন্যদিকে বিএনপিও নির্বাচন সামনে রেখে মিত্র দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করে যাচ্ছে সেখানেও নেই জামায়াত।

১৯৯৯ সালে গঠিত হওয়া চারদলীয় জোটের প্রধান দুটো দল ছিল বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী। দল দুটি ২০০১ সালের নির্বাচনে ক্ষমতায়ও আসে। এর পর আবার বিরোধী দলে যায়। চারদলীয় জোট থেকে ২০ দলীয় জোট হয়। শেখ হাসিনার শাসনের শেষদিকে দল দুটির মধ্যে দূরত্ব দেখা দেয়। গত কয়েক বছর ধরেই নানা বিষয়ে টানাপোড়েন চলছে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, সভা-সমাবেশের বক্তব্য-বিবৃতিতে মন্তব্য ছোড়াছুড়ি চলছে। জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের পর এই বিরোধ আরও প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে। ৫ আগস্টের পর থেকেই জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির দূরত্ব প্রকাশ্যে আসতে থাকে।

দেশের বিভিন্ন স্থানে বিএনপি-জামায়াত এবং ছাত্রদল-শিবিরের সঙ্গে একাধিকবার রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনায়ও ঘটেছে। জামায়াতের শীর্ষনেতারা সভা-সমাবেশ থেকে বিএনপিকে ইঙ্গিত করে দখল বাণিজ্যসহ কড়া সমালোচনা করে বক্তব্য রেখে চলেছে।

তবে জুলাই অভ্যুত্থানের পর ক্ষমতায় যাওয়াকে কেন্দ্র করে মুখোমুখি অবস্থানে এখন দুই দল। সভা সমাবেশে বিএনপি নেতারা জামায়াত নেতাদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে। অপরাধ অপকর্ম তুলে ধরে কঠোর সমালোচনা করছেন। বিপরীতে জামায়াত নেতারা এক চুলও ছাড় দিচ্ছে না বিএনপিকে। সভা-সমাবেশে করছেন তুলাধুনা। বিএনপি নেতাদের দখল চাঁদাবাজির বিষয় তুলে ধরে ভোটারদের কৌশলে কাছে টানার চেষ্টা করছেন জামায়াত নেতারা।

বিএনপির নেতারা জানান, তারা এখন এককভাবে চলতে চান। কারণ এখন দেশের সবচেয়ে বড় এবং জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল হচ্ছে বিএনপি। নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হলে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জোট করবেন কি না, তখন সিদ্ধান্ত নেবেন।  সামনে এখনো রাজনীতির অনেক হিসাব-নিকাশ আছে।

এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বীরবিক্রম রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, বিএনপি এবার এককভাবে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে।

জামায়াত আলাদা নির্বাচন করলে তাদের সাথে দ্বন্দ্ব আছে কি না তা স্পষ্ট না করে তিনি বলেন, আমাদের সঙ্গে আসলে কারো বিরোধ নেই। বিএনপি ক্ষমতায় গেলে সবাইকে নিয়ে জাতীয় সরকারের পরিকল্পনা রয়েছে। সেক্ষেত্রে জামায়াত চাইলে আমরা তাদের জাতীয় সরকারে নেব। আর যদি জামায়াত মনে করে তারা জাতীয় সরকারে থাকবে না, কিংবা তারা যদি মনে করে  তারা বিরোধী দলে থাকবে সেটা তারা করতেই পারে।

অন্যদিকে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পারোয়ার রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, আমাদের সাথে বিএনপির এখন আর জোট নেই। আমাদের সাথে তাদের রাজনৈতিক জোট হয়েছিল, এবার আমরা আলাদা নির্বাচন করব, তারাও আলাদা নির্বাচন করবে।

আমরা নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছি, তারাও নিশ্চয়ই নিচ্ছে। তাদের রাজনীতি একরকম আর আমাদের রাজনীতি একটু ভিন্ন। আমরা আসলে ইনসাফে বিশ্বাস করি। আমরা চাই দেশের সব মানুষ সমান অধিকার ভোগ করুক। লুটতরাজ, বাহুর জোরে আমরা বিশ্বাস করি না।