ঢাকা সোমবার, ১৮ আগস্ট, ২০২৫

নজর সাদাপাথর-জাফলংয়ে এবার লুটপাট রাংপানিতে 

আব্দুল আহাদ, সিলেট
প্রকাশিত: আগস্ট ১৮, ২০২৫, ১২:১১ এএম
  • পাথর লুটে একাট্টা বিএনপি-আওয়ামী লীগ
  • প্রকাশ্যেই লুট হচ্ছে পাথর, তোয়াক্কা করছে না বিজিবির টহল 
  • প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই চলছে লুটপাট, এরই মধ্যে পাথরশূন্য রাংপানি 
  • পাথর লুটের বিষয়টি নজরে এসেছে। নিয়ন্ত্রণে নিয়মিত মনিটরিং ও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে: মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ, সিলেট জেলা প্রশাসক 

নজিরবিহীন পাথর লুটপাটের পর প্রশাসনের নজর যখন সাদাপাথর আর জাফলংয়ে, তখন সিলেটের আরেক জনপ্রিয় পর্যটন স্পট জৈন্তাপুরের শ্রীপুর মোকামপুঞ্জি এলাকার রাংপানিতে চলছে পাথর লুট। এতে ঐতিহ্যবাহী এই পর্যটনকেন্দ্র রাংপানির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ভয়াবহ হুমকির মধ্যে পড়েছে। সীমাহীন লুটপাটের কারণে এরই মধ্যে পাথরশূন্য হয়ে পড়েছে রাংপানি।

হুমকির মুখে পড়েছে স্থানীয় পরিবেশ ও পর্যটন শিল্প। রাংপানিতেও পাথর লুটে সাদাপাথর আর জাফলংয়ের মতো স্থানীয় বিএনপি ও আওয়ামী লীগের রয়েছে ঐকমত্য। প্রশাসনকে ম্যানেজ করে বিজিবির টহল উপেক্ষা করে জৈন্তাপুর উপজেলা বিএনপির সিনিয়র সহ-সভাপতি আব্দুল আহাদের নেতৃত্বে তার শালা জৈন্তাপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক রাজা, দিলাদার হোসেনসহ অনেকেই এই সিন্ডিকেটের সাথে সক্রিয় বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় বাসিন্দা, পর্যটক ও পরিবেশকর্মীরা প্রশাসনের প্রতি ক্ষোভ ও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, পাথর লুটের পদ্ধতি বেশ সংগঠিত এবং পেশাদারিত্বপূর্ণ। অবৈধ দমকল পাম্প এবং ছোট আকারের খনন যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে রাতের অন্ধকারে, অনেক সময় দিনের বেলায় পাথর উত্তোলন করা হচ্ছে। সাধারণত ছোট ছোট নৌকা দিয়ে পাথর তুলে স্থলভূমিতে জমা করা হয়। পরে ট্রাক দিয়ে দ্রুত পাথরগুলো সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে নিরাপদ স্থানে। দমকল পাম্প আর যন্ত্রপাতি দিয়ে পাথর উত্তোলনের ফলে দ্রুত ও বড় পরিমাণে পাথর তোলা সম্ভব হচ্ছে বলেও জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলার শ্রীপুরের রাংপানি এলাকার স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, প্রকাশ্যেই শত শত শ্রমিক পাহাড় কেটে নৌকার মাধ্যমে লুট করছে পাথর। এমনকি তোয়াক্কা করছে না বিজিবির টহলও। এরই মধ্যে পর্যটন এলাকাটি পাথরবিহীন হয়ে পড়েছে অনেকটাই। কয়েকজন স্থানীয় প্রভাবশালী এবং পাথর ব্যবসায়ী এই অবৈধ কাজের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত রয়েছেন। তারা স্থানীয় শ্রমিক ও যুবকদের দিয়ে এই কাজ করাচ্ছেন এবং প্রশাসনের নজর এড়ানোর জন্য পরিবহন শ্রমিকদের ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে দিচ্ছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন স্থানীয় শ্রমিক জানান, প্রতিদিন কয়েকটি দল রাতে এসে কাজ করে। তারা প্রশাসনের কিছু কিছু কর্মকর্তাদের ‘রশিদ’ দিয়ে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। আবার আরেক দল দিনের বেলা পাথর উত্তোলন করছে। সবাই প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই পাথর-বালু লুটপাট করছে। জৈন্তাপুর উপজেলা বিএনপির সিনিয়র সহ-সভাপতি আব্দুল আহাদের নেতৃত্বে তার শালা জৈন্তাপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক রাজা, দিলাদার হোসেনসহ অনেকেই এই সিন্ডিকেটের সাথে সক্রিয়। আপনারা লেখালেখি করে কিছুই করতে পারবেন না।

জৈন্তাপুর উপজেলার ২নং ইউনিয়নের মোকামপুঞ্জি এলাকার স্থানীয় আবু বকর সিদ্দিক (৫০) বলেন, ‘আমাদের জীবিকার অন্যতম উৎস হলো রাংপানির ট্যুরিজম। এখন পাথর লুটের কারণে নদীর তীরবিন্দু ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, পরিবেশ ধ্বংসের পাশাপাশি পর্যটক কমে যাচ্ছে। এই অবস্থা চলতে থাকলে আমাদের জীবিকা ধ্বংস হয়ে যাবে।’

আরেক স্থানীয় নারী রেহানা খাতুন বলেন, ‘আমরা চাই প্রশাসন কড়া আইন প্রয়োগ করুক। পাথর লুট বন্ধ করতে না পারলে এই অঞ্চল হারিয়ে যাবে, পরিবেশের সঙ্গে আমাদের সংস্কৃতিও বিলীন হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘পর্যটক আসলে আমাদের রোজগার বেড়ে যায়। তারা স্থানীয় খাবার পছন্দ করেন। আমরা দেশি হাঁস-মুরগি রান্না করে বিক্রি করি। এতে পর্যটকরা আনন্দ পান।’

সিলেটের পরিবেশ আন্দোলনের সংগঠক ও ‘ধরিত্রী রক্ষায় আমরা’র সদস্য সচিব আব্দুল করিম কিম বলেন, ‘প্রশাসনের নজর যখন সাদাপাথর আর জাফলংয়ে, তখন আরেক জনপ্রিয় পর্যটন স্পট জৈন্তাপুরের শ্রীপুর এলাকার রাংপানিতে চলছে পাথর লুট। রাংপানি নদীর পাথর লুট শুধু প্রকৃতির ক্ষতি করছে না, এটি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবও বাড়াচ্ছে। পাথর লুটের ফলে নদীর পানির প্রবাহে পরিবর্তন আসছে, যা ভবিষ্যতে বন্যা ও ক্ষয় হতে পারে।’

সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. আনোয়ার উজ জামান বলেন, ‘পাথর লুটের বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। ইতোমধ্যে আমরা বিভিন্ন রেঞ্জ অফিসারদের দায়িত্ব দিয়েছি এ বিষয়ে নিয়মিত মনিটরিং করার জন্য। তবে বিষয়টি নিয়ন্ত্রণে আনতে আমাদের আরও শক্তিশালী পদক্ষেপ নিতে হবে।’

সিলেট বন বিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক মোহাম্মদ নাজমুল আলম বলেন, ‘আমরা পরিবেশ রক্ষায় সচেতনতা বৃদ্ধি ও আইন প্রয়োগের মাধ্যমে এই অবৈধ কার্যকলাপ বন্ধ করার চেষ্টা করছি। তবে জনগণের সহযোগিতা না থাকলে একা এটি রক্ষা কঠিন।’

পর্যটন এলাকা থেকে পাথর উত্তোলন থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কঠোর আইন প্রয়োগ, অবৈধ পাথর উত্তোলনকারীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা জরুরি। পাশাপাশি স্থানীয় জনগণ ও পর্যটকদের মধ্যে পরিবেশ সংরক্ষণের গুরুত্ব প্রচার করা। প্রশাসন ও বন বিভাগকে নিয়মিত নজরদারি বৃদ্ধি করতে হবে। 

তারা আরও বলেন, রাংপানির এই প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষায় সরকার, প্রশাসন, স্থানীয় জনগণ ও পর্যটকদের একযোগে কাজ করা না হলে এই এলাকায় পরিবেশ ও অর্থনৈতিক ক্ষতি অস্বীকার করার উপায় থাকবে না। তাই অবিলম্বে পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি, যাতে রাংপানি তার প্রকৃত সৌন্দর্য ও গুরুত্ব ধরে রাখতে পারে।

সিলেটের জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ বলেন, পাথর লুটের বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। ইতোমধ্যে আমরা বিভিন্ন অফিসারদের দায়িত্ব দিয়েছি এ বিষয়ে নিয়মিত মনিটরিং করার জন্য। তবে বিষয়টি নিয়ন্ত্রণে আনতে নিয়মিত মনিটরিং ও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।