** একনেকে অনুমোদন হলেও পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নিয়ে অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ শুরু করতে হবে: ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, পরিকল্পনা উপদেষ্টা
- ৯ হাজার ৩৬১ কোটি টাকার ১১ প্রকল্প অনুমোদন
উপদেষ্টা রিজওয়ানার আপত্তি সত্ত্বেও পরিবেশ ছাড়পত্র নেওয়ার শর্তে সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ স্থাপনের প্রকল্পের অনুমোদন দিয়েছে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। একনেকে অনুমোদন হলেও পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নিয়ে অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ শুরু করতে হবে। মূলত পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয়ের আপত্তিতে এই শর্ত দেওয়া হয়।
গতকাল রোববার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের এনইসি সম্মেলন কক্ষে প্রধান উপদেষ্টা এবং একনেকের চেয়ারপারসন ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে এই প্রকল্পসহ ৯ হাজার ৩৬১ কোটি টাকার ১১ প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়। একনেক সভা শেষে পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ প্রকল্পটি সম্পর্কে সাংবাদিকদের এসব তথ্য জানান।
একনেক সভার কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করেন পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ; আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক এবং প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল; স্বরাষ্ট্র এবং কৃষি উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী (অব.); শিল্প এবং গৃহায়ন ও গণপূর্ত উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান; বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু এবং রেলপথ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান; পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানিসম্পদ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামো নির্মাণে খরচ ধরা হয়েছে ৫১৯ কোটি টাকা। প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৫ সালের মে মাস থেকে শুরু হয়ে ২০২৯ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত। সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের বুড়ি পোতাজিয়ায় ১০০ একর জমিতে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণে এই প্রকল্প নেওয়া হয়। এর আগে গত মে মাসে প্রকল্পটি পাসের জন্য একনেকে উঠেছিল, তখন তা আবার পর্যালোচনার জন্য ফেরত পাঠানো হয়।
৯ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণে উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) দ্রুত অনুমোদনের দাবিতে গত কয়েকদিন থেকে আন্দোলন করছিলেন বিশ^বিদ্যালয়টি শিক্ষার্থীসহ স্থানীয়রা। আন্দোলনের পাশাপাশি গত শনিবার দুপুর ১২টা থেকে শিক্ষার্থীরা আমরণ অনশনও শুরু করেন। অনশন চলাকালে অন্তত ২০ শিক্ষার্থী অসুস্থ হয়ে পড়েন। সেখানে তাদের চিকিৎসা নিতে দেখা গেছে। গতকাল দুপুরে একনেক সভায় প্রকল্পটি অনুমোদনের খবর পাওয়ার পর শিক্ষার্থীসহ সংশ্লিষ্টদের মধ্যে স্বস্তি ফেরে। উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়েন শিক্ষার্থীরা।
তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় প্রক্টর (ভারপ্রাপ্ত) নজরুল ইসলাম রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাসের ৫১৯ কোটি টাকার ডিপিপি অনুমোদন হওয়ায় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টাসহ সংশ্লিষ্ট উপদেষ্টাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। সেই সঙ্গে দ্রুত প্রকল্পটি বাস্তবায়নের দাবি জানান তিনি। উচ্ছ্বসিত শিক্ষার্থীরা বলেন, অনেক আন্দোলন সংগ্রামের ফল এই ডিপিপি। এই ডিপিপি অনুমোদনের মধ্যদিয়ে ষড়যন্ত্রকারীরা পরাজিত হয়েছে। সবার আশা, দ্রুত সময়ের মধ্যে এ প্রকল্পের কাজ শুরু হবে। এ সময় তারা সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণের দাবি তোলেন।
এদিকে পরিবেশবিদ ও পানি বিশেষজ্ঞদের অভিযোগ, প্রকল্প এলাকাটি চলনবিলের শেষ অংশে অবস্থিত। এখানে মিলিত হয়েছে শতাধিক খাল, বিল, বড়াল নদসহ অর্ধশতাধিক নদীর পানি। এসব উৎস থেকে আসা পানির সম্মিলিত প্রবাহ গিয়ে মিলিত হয় যমুনা নদীর সঙ্গে। এখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস নির্মাণ করা হলে পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হবে।
পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ সাংবাদিকদের বলেন, প্রকল্প এলাকাটি চারণভূমি ছিল। ২০১৮ সালে ভূমি মন্ত্রণালয় অকৃষি জমি হিসেবে ছাড়পত্র দিয়ে ভূমি অধিগ্রহণে অনাপত্তি সনদ দেয়। তখন বলা হয়েছিল, পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের ছাড়পত্র নিতে হবে। এখন সেই শর্ত পূরণের শর্ত দিয়ে প্রকল্পটি পাস করা হয়। তিনি আরও বলেন, এ নিয়ে পরিবেশবিদদের অনেক কথা আছে। এখন পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের ব্যাপার। তারা পুরো বিষয়টি মূল্যায়ন করবে।
একনেক বৈঠক সূত্র জানিয়েছে, প্রকল্পটি একনেকের তালিকায় চার নম্বরে ছিল। প্রকল্প প্রস্তাবনা সভায় উপস্থাপন করা হলে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানিসম্পদ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান আপত্তি তোলেন। এ নিয়ে দীর্ঘক্ষণ আলোচনা হয়। পরিবেশ উপদেষ্টা নিজের অবস্থানে অনড় থাকেন। পরে কয়েকজন উপদেষ্টা বলেন, পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নেওয়ার শর্তে আপাতত একনেকে প্রকল্পটি পাস হোক। পরিবেশ ছাড়পত্র নিতে দুই মাস বেঁধে দেওয়া হয়েছে।
৯ হাজার ৩৬১ কোটি টাকার ১১ প্রকল্প অনুমোদন
রবীন্দ্র বিশ^বিদ্যালয়সহ ৯ হাজার ৩৬১ কোটি ৯২ লাখ টাকা ব্যয় সম্বলিত ১১টি প্রকল্প গতকাল অনুমোদন করেছে একনেক। অনুমোদিত প্রকল্পে সরকারি অর্থায়ন ৬ হাজার ৬৭৭ কোটি টাকা, প্রকল্প ঋণ ২ হাজার ৪২৮ কোটি ৪ লাখ টাকা এবং সংস্থার নিজস্ব অর্থায়ন ২৫৬ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। এর মধ্যে নতুন প্রকল্প ৫টি, সংশোধিত প্রকল্প ২টি এবং ব্যয় বৃদ্ধি ব্যতিরেকে মেয়াদ বৃদ্ধির ৩টি প্রকল্প রয়েছে।
অনুমোদিত ১১ প্রকল্পসমূহ হলোÑ কৃষি মন্ত্রণালয়ের ‘আধুনিক প্রযুক্তি সম্প্রসারণের মাধ্যমে রংপুর অঞ্চলে টেকসই কৃষি উন্নয়ন’ প্রকল্প, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের ‘বাপবিবোর বিদ্যমান শিল্পসমৃদ্ধ এলাকার ৩৩/১১ কেভি আউটডোর উপকেন্দ্রের আধুনিকায়ন ও ক্ষমতা বর্ধন’ প্রকল্প, শিল্প মন্ত্রণালয়ের ‘বিএমআর অব কেরু অ্যান্ড কোং (বিডি) লি. (২য় সংশোধিত)’ প্রকল্প, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ‘রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ স্থাপন’ প্রকল্প, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ‘৫টি নির্ধারিত মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (সিলেট, বরিশাল, রংপুর, রাজশাহী এবং ফরিদপুর) বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিট স্থাপন (১ম সংশোধিত)’ প্রকল্প, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের ‘ঢাকাস্থ আজিমপুর সরকারি কলোনির ভেতরে সরকারি কর্মচারীদের জন্য বহুতল আবাসিক ফ্ল্যাট নির্মাণ (জোন-সি)’ প্রকল্প, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ‘ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য ২টি বহুতল আবাসিক ভবন নির্মাণ’ প্রকল্প, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের ‘ঢাকা এনভায়রনমেন্টাল সাসটেইনেবল ওয়াটার সাপ্লাই (তৃতীয় সংশোধিত)’ প্রকল্প ও ‘বান্দরবান পৌরসভা এবং বান্দরবান জেলার ৩টি উপজেলা সদরসহ পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোতে নিরাপদ পানি সরবরাহ ও স্যানিটেশন ব্যবস্থার সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন (১ম সংশোধিত)’ প্রকল্প, ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের ‘চট্টগ্রামের মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চলে টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক স্থাপন’ প্রকল্প, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের ‘উপজেলা পর্যায়ে মিনি স্টেডিয়াম নির্মাণ (দ্বিতীয় পর্যায়) (প্রস্তাবিত প্রথম সংশোধিত)’ প্রকল্প।
সভায় পরিকল্পনা উপদেষ্টা কর্তৃক ইতোমধ্যে অনুমোদিত ৯টি প্রকল্প সম্পর্কে একনেক সদস্যদের অবহিত করা হয়। সেগুলো হলোÑ ১. হাতিয়া দ্বীপ, নিঝুম দ্বীপ ও কুতুবদিয়া দ্বীপ শতভাগ নির্ভরযোগ্য ও টেকসই বিদ্যুতায়ন (২য় সংশোধিত), ২. রাজশাহী এবং রংপুর বিভাগে নেসকোর আওতাধীন এলাকায় স্মার্ট প্রি-পেমেন্ট মিটার স্বাপন (১ম সংশোধিত) প্রকল্প, ৩. বরগুনা জেলার ২টি পৌরসভা অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প, ৪. তিন পার্বত্য জেলায় দুর্যোগ ক্ষতিগ্রস্ত পল্লী সড়ক উন্নয়ন (২য় সংশোধিত) প্রকল্প, ৫. লাঙ্গলবন্দ মহাষ্টমী পুণ্যস্নান উৎসবের অবকাঠামো উন্নয়ন (২য় সংশোধিত), ৬. তেলজাতীয় ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি (২য় সংশোধিত), ৭. সিলেট বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন (২য় সংশোধিত) প্রকল্প, ৮. কপোতাক্ষ নদ ও তৎসংলগ্ন এলাকার জলাবদ্ধতা দূরীকরণ (২য় পর্যায়) (১ম সংশোধিত), ৯. বিদ্যালয়বহির্ভূত কিশোর-কিশোরীদের জন্য দক্ষতাকেন্দ্রিক সাক্ষরতা (২য় সংশোধিত) প্রকল্প।
এক সভা শেষে পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ আরও বলেন, ঢাকা শহরে পরিশোধিত পানি সরবরাহ প্রকল্পে অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে। প্রকল্পটি চারবার সংশোধন করা হয়েছে। ঢাকা ওয়াসা সঠিকভাবে কাজ করছে না। এই প্রকল্পের অনিয়ম খুঁজে বের করা হবে। এখন থেকে প্রকল্পের কাজে ধীরগতির জন্য পেছনে কোনো অজুহাত মানবে না সরকার। সব মন্ত্রণালয়কে এই বার্তা দেওয়া হয়েছে।
এ সময় তিনি বলেন, রাজধানীতে আরও দুটি মেট্রোরেল নির্মাণ প্রকল্পে বেশি অর্থ ব্যয়ের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু এসব চুক্তি তো আগেই হয়ে গেছে। তারপরও খরচ কমাতে সরকার জাইকার সঙ্গে দরকষাকষি করছে।
তিনি আরও জানান, বিদ্যুতের সিস্টেম লস কমানোসহ সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ১০টি প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে একনেক বৈঠকে। এ ছাড়া রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাস স্থাপনে ৫১৯ কোটি টাকার প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এটা শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের জন্য ভালো হবে।
তিনি বলেন, জুলাই মাসে এক শতাংশেরও কম এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছে। এটি ইতিহাসে সর্বনি¤œ। ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, তাই ডিসেম্বর বা জানুয়ারিতেই সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনা (এডিপি) জমা দিতে হবে। নির্বাচিত সরকার আসার আগেই বাজেটের পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা চূড়ান্ত করতে হবে।