পুরান ঢাকার মিটফোর্ডে ভাঙারি ব্যবসায়ী লাল চাঁদ ওরফে সোহাগ হত্যার কিলিং মিশনের ১০ আসামি এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৭ জন গ্রেপ্তার হলেও কিলিং মিশনে অংশ নেওয়া আরও ১০ আসামি এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে। তবে তাদের ধরতে অভিযান চলমান রয়েছে।
সূত্র মতে, দুর্বৃত্তদের সঙ্গে আগে থেকেই সোহাগের ভাঙারি ব্যবসা নিয়ে দ্বন্দ্ব ছিল। তা ছাড়া তারা দীর্ঘদিন একসঙ্গে রাজনীতি করলেও কয়েকজন পরে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যুক্ত হন। গত ৫ আগস্ট দেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর ফের যুবদলের রাজনীতি শুরু করেন ব্যবসায়ী সোহাগসহ অন্যরা। চাঁদাবাজি বা রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব নয়, ব্যাবসায়িক দ্বন্দ্বের কারণে সোহাগ নৃশংসভাবে হত্যাকা-ের শিকার হন।
এই মামলায় ইতিমধ্যে গ্রেপ্তার হওয়া ৭ আসামি হলেনÑ মাহমুদুল হাসান মহিন, তারেক রহমান রবিন, আলমগীর, মনির ওরফে ছোট মনির, মো. টিটন গাজী, রাজিব ও সজিব। এই ঘটনায় ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকা ১০ জনকে অবিলম্বে গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়েছেন ভুক্তভোগীর পরিবারের সদস্যরা।
সূত্র মতে, আসামি মহিনসহ হত্যাকারীরা আওয়ামী লীগ সরকার পতনের আগে থেকেই একচেটিয়া ভাঙারি ব্যবসা করে আসছিলেন। সে সময় তারা সবাই হাজী সেলিমের লোক ছিলেন। সরকার পতনের পর মহিনসহ অন্যরা যুবদলে যোগদান করে তাদের একচেটিয়া ব্যবসা ও সিন্ডিকেট ধরে রাখেন। তা ছাড়া নিহত সোহাগ ভাঙারি ব্যবসার পাশাপাশি আগে থেকেই যুবদলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ৫ আগস্টের পর সোহাগ এই ভাঙারি ব্যবসার সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা করেন। যার ফলে মহিনদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। সোহাগের নামেও বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে। মূলত এসব দ্বন্দ্বের সূত্র ধরেই সোহাগকে হত্যা করা হয়। এ হত্যাকা-ে ১৭ জনের মতো অংশগ্রহণ করে বলে জানা গেছে।
এদিকে ব্যবসায়ী ও যুবদলকর্মী লাল চাঁদ ওরফে সোহাগ হত্যার ঘটনায় গ্রেপ্তার তারেক রহমান রবিন অস্ত্র মামলায় আদালতে দোষ স্বীকার করে জবানবন্দিতে জানান, ভাঙারি ব্যবসায়ী সোহাগ চাঁদাবাজির কারণে নয়, ব্যাবসায়িক দ্বন্দ্বে খুন হয়েছে। গত বুধবার সন্ধ্যায় রাজধানীর পুরান ঢাকায় সোহাগকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। আদালত ও পুলিশ সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। দুদিনের রিমান্ড শেষে রবিন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে সম্মত হওয়ায় তা রেকর্ড করার আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কোতোয়ালি থানার এসআই মনির হোসেন জীবন। পরে তিনি ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট হাসিব উল্লাহ পিয়াসের কাছে তার জবানবন্দি রেকর্ড করেন। জবানবন্দিতে তিনি জানান, সোহাগ হত্যার সঙ্গে তিনি জড়িত নন। হত্যাকা-ের সময় তিনি ঘটনাস্থলে ছিলেন না। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর থেকে মহিনসহ অন্যদের সঙ্গে নিহত সোহাগের ভাঙারি ব্যবসা নিয়ে দ্বন্দ্ব চলছিল। যার সূত্র ধরেই সোহাগকে খুন করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
নৃশংসভাবে এই হত্যাকা- নিয়ে ‘মব’ সাজাতে চেয়েছিল খুনিরা:
মিটফোর্ড চত্বরে ব্যবসায়ী সোহাগকে নৃশংসভাবে হত্যার তদন্তে বেরিয়ে আসছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, মহিন মাসে ফিক্সড চাঁদা চাওয়াতেই বেঁকে বসেন সোহাগ। আর এই বিষয় নিয়েই দীর্ঘদিনের দুই বন্ধু শত্রুতে পরিণত হয়। মূলত মহিন ও টিটন গাজী পরিকল্পনা করেন সোহাগকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে ফেলার। তাদের ধারণা ছিল- ভাঙারি দোকানে অনেক লাভ। সোহাগকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিলে ‘সোহানা মেটাল’ নামে দোকানটি তাদের হয়ে যাবে এবং পুরো এলাকার ভাঙারি ব্যবসা তারা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, রজনী বোস লেনের কিছুটা ভেতরে সোহাগের দোকান। গত ৭ জুলাই চাঁদা নেওয়ার বিষয়ে সোহাগ ও মহিনের মধ্যে বাগবিত-া ও হাতাহাতির মতো ঘটনা ঘটে। বিষয়টি জানতে পেরে সোহাগের সাথে যোগাযোগও করেছিল পুলিশ। তখন সোহাগ জানান, মহিনের সাথে ঝামেলা মিটে গেছে। কিন্তু মহিন চুপচাপ বসে থাকেনি। ওই দিনই হত্যার পরিকল্পনা করে টিটনের সাথে। রিমান্ডের জিজ্ঞাসাবাদে মহিন তদন্ত সংশ্লিষ্টদের জানিয়েছেন, সোহাগ খুবই একরোখা স্বভাবের ছিল। এ জন্য তাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে ফেলার পরিকল্পনা করা হয়। শুরুতে তাকে দোকানেই হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। এ জন্য অস্ত্রও সংগ্রহ করা হয় ছোট মনিরের মাধ্যমে। কিন্তু তারা সম্প্রতি সময়ে মবের ঘটনাগুলো দেখে উৎসাহিত হয়। তাদের ধারণা ছিল- সোহাগকে যদি মিটফোর্ডের ৩ নম্বর গেটের সামনে নিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে অনেকে মিলে উল্লাস করা যায়, তাহলে ঘটনা অন্যদিকে মোড় নেবে। আর ওই অত্র এলাকার ভাঙারি ব্যবসায়ী, অন্যান্য ব্যবসায়ী, অ্যাম্বুলেন্সচালক, রেস্টুরেন্ট, ফার্মেসি ও ফুটপাতের দোকানগুলোতে বার্তা চলে যাবে মহিন গ্রুপের কথা না শুনলে পরিণতি হবে এর চেয়ে ভয়াবহ। এই চিন্তা থেকেই গত বুধবার সোহাগ দোকানে আসার পরেই ৭টি বাইকে করে ১৯ জন মিলে রজনী বোস লেনে প্রবেশ করে। এরপর সোহাগকে মারধর করতে করতে মিডফোর্ট হাসপাতালের সামনে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে ইট-বালু-সিমেন্টের তৈরি পাথরসদৃশ কনক্রিট দিয়ে বার বার আঘাত হত্যা করা হয়। এরপর ব্যবসায়ীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়াতে মরদেহ টেনেহিঁচড়ে গেটের বাইরে এনে উল্লাস করা হয়। এদিকে খুনিদের মধ্যে পুরোনো ক্ষোভ ছিল দুইজনের। এদের মধ্যে একজনের কপালে একটি কাটা দাগ রয়েছে। ওই দুই খুনি পুলিশকে জানিয়েছে, সোহাগ রগচটা ও একরোখা মানুষ ছিল। মতের অমিল হলেই গায়ে হাত দিয়ে বসত। কয়েক বছর আগে সোহাগ তাদের মারধর করে। কপালের কাটা দাগটি সোহাগের মারের কারণেই। পুরনো পুঞ্জীভূত এই ক্ষোভ থেকেই তারা সোহাগকে মারধর করে। তারা ভেবেছিলÑ উপস্থিত খুনিদের মধ্যে প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলের লোকজন থাকায়- হত্যাকা- অন্যভাবে ধামাচাপা পড়ে যাবে।
অন্যদিকে- গ্রেপ্তারদের কাছ থেকে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা এমন তথ্যও পেয়েছেন- মহিন, টিটন ও রবিন ‘গেঞ্জাম’ লাগছে বলে গ্রুপের সদস্যদের ঘটনার আগে ডেকে এনেছিল। ভাঙারি দোকান থেকে সোহাগকে মিটফোর্ডে ধরে আনার পর মহিন সবাইকে বলতে থাকে- ‘ও (সোহাগ) বেঁচে থাকলে আমরা সবাই শেষ।’ এরপরই সবাই সোহাগকে মেরে ফেলতে হামলা চালাতে থাকে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কোতোয়ালি থানার এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, দীর্ঘদিন ধরে বন্ধুর মতো পথ চলা নিহত সোহাগ এবং খুনিদের অন্যতম হোতা মহিন ও টিটনের সম্প্রতি সময়ের সম্পর্ক ছিল যুদ্ধ চলার মতো। অতীতে বিভিন্ন সভাবেশ উপলক্ষে সোহাগ অর্থনৈতিক সহযোগিতাসহ লোকজনকে মিছিলে পাঠাত। অনেক সভা-সমাবেশে সোহাগ সক্রিয় ভূমিকা রেখে মহিনকে সহযোগিতা করত। কিন্তু সম্প্রতি সময়ে মহিন ফিক্সট টাকা দাবি করে বসে। অর্থাৎ প্রতি মাসে একটি নির্দিষ্ট হারে চাঁদা দিতে হবে।
সবশেষ ৭ জুলাই অনুসারীদের নিয়ে সোহাগকে হুমকি দিতে যায় মহিন। এ সময় তাদের মধ্যে ঝামেলা হলে সংবাদ পায় চকবাজার থানা পুলিশ। তখন সোহাগ পুলিশকে জানিয়েছিল- তাদের ব্যক্তিগত সমস্যা মিটমাট হয়ে গেছে।
আলোচিত এ ঘটনার তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে কোতোয়ালি থানার ইন্সপেক্টর (তদন্ত) নাসির উদ্দিন বলেন, এ ঘটনায় হত্যা ও অস্ত্র আইনে পৃথক দুটি মামলা হয়েছে। এখন পর্যন্ত ৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাকিদের ধরতে বিভিন্ন সংস্থার অভিযান চলছে। একজন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। অন্য আসামিদের গ্রেপ্তার করতে পারলে সর্বোচ্চ জানা যাবে। আশা করি, দ্রুত সময়ের মধ্যে এ ঘটনায় জড়িত সবাইকেই আইনের আওতায় আনা সম্ভব হবে।
অস্ত্র মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা কোতোয়ালি থানার এসআই মনির হোসেন জীবন বলেন, অন্ত্রসহ রবিনকে গ্রেপ্তারের পর সে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, রবিনের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে আমরা কাজ করছি।
যদিও অস্ত্র আইনে দায়ের করা মামলার এজহারে উল্লেখ করা হয়েছে, সোহাগকে হত্যা করতে রবিন অস্ত্রটি ছোট মনিরের কাছ থেকে সংগ্রহ করেছিল। অস্ত্র দেওয়ার সময় ছোট মনির বলেছিল কাজ শেষ হলে সেটি ফেরত দিয়ে আসতে। সূত্র জানিয়েছে, রবিন হত্যা মামলারও আসামি হওয়ায় তাকে শ্যোন অ্যারেস্ট দেখানো হবে। মহিন-রবিন ও টিটনকে মুখোমুখি করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হতে পারে বলেও জানা গেছে।
আতঙ্কে ভাঙারি ব্যবসায়ীরা:
রজনী বোস লেনের পুরোটাজুড়েই ভাঙারি দোকান। যে স্টাইলে সোহাগকে ধরে এনে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে, এতে অনেকটাই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে অন্য ব্যবসায়ীদের মধ্যে। তাদের দাবি- এলাকাটিতে মহিনের মতো আরও ৫-৬টি গ্রুপ রয়েছে। মহিন গ্রেপ্তার হলেও তার অনুসারীরা ওঁত পেতে আছে। গ্রুপগুলো তাদের জন্য হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ভাঙারি দোকানের মালিক বলেন, ৩ মাস আগে সোহাগ এই দোকানটি ভাড়া নিয়েছিল। আগে পাশেই অন্য গলিতে দোকান ছিল। গত বুধবার দোকানে আসার ৫ মিনিটের মধ্যে মহিন গ্রুপ মোটরসাইকেলে এসে তাকে ধরে নিয়ে যায়। ভবিষ্যতে মহিন গ্রুপের অন্যরা এ ধরনের ঘটনা ঘটাবে নাÑ এর নিশ্চয়তা কে দেবে?
হত্যার তদন্তে বিচারিক কমিশন চেয়ে রিট:
এই নৃশংস হত্যার ঘটনা তদন্তে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন বিচারিক কমিশন গঠনের নির্দেশনা চেয়ে রিট করা হয়েছে। গতকাল সোমবার সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইউনুছ আলী আকন্দ এই রিট করেন। হত্যাকা-ে সরাসরি জড়িত প্রকৃত অপরাধীদের গ্রেপ্তার করতে নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে রিটে। বিচারপতি কাজী জিনাত হক ও বিচারপতি আইনুন নাহার সিদ্দিকার বেঞ্চে রিটটি শুনানির জন্য উপস্থাপন করা হবে বলে জানান রিটকারী আইনজীবী।
আপনার মতামত লিখুন :