মঙ্গলবার, ১৫ জুলাই, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


মো. সেলিম রেজা, নকলা

প্রকাশিত: জুলাই ১৫, ২০২৫, ১২:২২ এএম

বাস্তবায়নের অভাবে বিফল ৭২৮ কোটি টাকার প্রকল্প

মো. সেলিম রেজা, নকলা

প্রকাশিত: জুলাই ১৫, ২০২৫, ১২:২২ এএম

বাস্তবায়নের অভাবে বিফল ৭২৮ কোটি টাকার প্রকল্প

‘কাজীর গরু কিতাবে আছে, গোয়ালে নেই’ বহুল শ্রুত এই প্রবাদ আবারও প্রমাণিত হলো মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের পাঠাভ্যাস তৈরিতে নেওয়া ‘স্ট্রেংদেনিং রিডিং হ্যাবিট অ্যান্ড রিডিং স্কিলস অ্যামাং সেকেন্ডারি স্টুডেন্ট’ প্রকল্পে। পাঁচ বছর মেয়াদি এই প্রকল্পের জন্য পরিকল্পনা, বরাদ্দ, জনবলÑ ঘাটতি ছিল না কোনো কিছুরই। শুধু বাস্তবায়নের অভাবে ফলশূন্য ৭২৮ কোটি টাকারও বেশি এ প্রকল্প। শুধু শিক্ষার্থীদের মধ্যে বই বিতরণ, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন দেওয়া ছাড়া এ প্রকল্পের আর কোনো অর্জন নেই। ইতোমধ্যে মেয়াদ শেষ হয়েছে প্রকল্পটি। ফের তোড়জোড় শুরু হয়েছে দুই বছর মেয়াদ বাড়ানোর। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য খুবই ভালো ছিল। কিন্তু সীমাহীন অনিয়ম-দুর্নীতি, প্রকল্প পরিচালনায় সংশ্লিষ্টদের অদক্ষতা ও গাফিলতির কারণে প্রকল্পটি সফলতার মুখ দেখেনি। 
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, শিক্ষার গুনগত মান উন্নয়নে ২০১৯ সালের ১ জানুয়ারি ৭২৮ কোটি ৭ লাখ ৩১ হাজার টাকা ব্যয়ের এই প্রকল্পের বাস্তবায়ন শুরু হয়। প্রথম দফায় ৩০ জুন ২০২৩ পর্যান্ত মেয়াদ ছিল। পরবর্তীতে মেয়াদ আরও দুই বছর ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়। এই প্রকল্পের মাধ্যমে দেশের ৩০০ উপজেলার ১৫ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ২৫ লাখ শিক্ষার্থীর মন ও মনন সমৃদ্ধ হবে এমন ২৮টি করে ৩০ লাখ ৮০ হাজার বই বিতরণের পরিকল্পনা ছিল। শিক্ষার্থীরা এসব বই পড়ার পর তাদের নিয়ে একটি পরীক্ষা নিয়ে প্রণোদনামূলক পুরস্কার দেওয়ারও কথা ছিল। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) আওতাধীন এই প্রকল্পটির পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ছিল বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র। ২০২১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে দুই বছর চুক্তিতে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র কাজ করে। এ ছাড়াও মাঠ পর্যায়ে যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এই কর্মসূচি চলবে সেই প্রতিষ্ঠানের একজন শিক্ষক সংগঠক হিসেবে কাজ করবেন। 
সূত্র জানায়, এই প্রকল্পের মাধ্যমে ৪৭ কোটি ২১ লাখ টাকা খরচ করে নির্বাচিত ২৮টি বইও বিতরণ করা হয়েছিল শিক্ষার্থীদের মাঝে। কিন্তু বই বিতরণের পর থমকে যায় পুরো প্রকল্প। প্রকল্প পরিচালকদের গাফিলতি আর অদক্ষতাসহ নানাবিধ কারণে শিক্ষার্থীদের বইগুলো পড়া শেষে পরীক্ষা নেওয়া কিংবা তাদের পুরস্কৃত করা হয়নি। এমনকি যেসব শিক্ষকরা এই কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন তাদের সম্মানিও দেওয়া হয়নি। অর্থাৎ শিক্ষার্থীদের মাঝে বই বিতরণ ছাড়া প্রকল্পের আর কোনো কাজ হয়নি। 
সূত্রমতে, চলতি বছরের ৩০ জুন এই প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়। এই পাঁচ বছরে বরাদ্দকৃত ৭২৮ কোটি ৭ লাখ ৩১ হাজার টাকার মধ্যে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা ব্যয় করেছেন মাত্র ১০১ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। যা মোট বরাদ্দের ১২ দশমিক ৮৭ শতাংশ। ৪৭ কোটি ২১ লাখ টাকা বই কেনার বাইরে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রকে দেওয়া হয় ৪৮ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। বাকি ৫ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে প্রকল্পের কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতা ও অফিসের সরঞ্জামসহ আনুষঙ্গিক খাতে। সর্বশেষ গত অর্থবছরেও এই প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ ছিল ৯০ কোটি ১ লাখ ৯১ হাজার টাকা। কিন্তু জুন পর্যন্ত খরচ হয়েছে মাত্র ১ কোটি ৯৯ লাখ ৮৬ হাজার টাকা। যা প্রকল্পের কর্মকর্তাদের পেছনেই ব্যয় হয়েছে। বিশেষজ্ঞ প্যানেল গঠন করতে না পারায় ওই বরাদ্দ ফেরত গেছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। 
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সারা দেশে কাজ করা কয়েকজন সংগঠক বলেন, প্রকল্পের কিছু বই ভালো ছিল। সেগুলো আমরা শিক্ষার্থীদের পড়তে উৎসাহ দিয়েছি। কিন্তু পরবর্তীতে পরীক্ষা নেওয়াসহ অন্য কাজ করা হয়নি। এমনকি আমাদের সঙ্গে যোগাযোগও রাখা হয়নি। আমাদের কিছু সম্মানি দেওয়ার কথা থাকলেও সেই টাকাও পাইনি। 
এদিকে প্রকল্পের মাধ্যমে দেশ-বিদেশের সেরা লেখকের বই কেনার কথা থাকলেও তা করা হয়নি। তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের তোষামোদি করতে ২৮টি বইয়ের মধ্যে অন্তত ১০টি বই কেনা হয়েছে দলটির বন্দনা আর অনুসারী বিভিন্ন লেখকের। পাশাপাশি তিনটি বিদেশি লেখকের বই তালিকাভুক্ত হলেও এগুলোর লেখক ও প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ নেই।
এ ছাড়াও বই কেনার তালিকায় প্রধান্য দেওয়া হয়েছে আওয়ামী লীগ অনুসারী প্রকাশকদের। এর পেছনে লেনদেন হয়েছে কোটি টাকারও বেশি। এরমধ্যে ওসমান গনির আগামী প্রকাশনীর চারটি, ফরিদ আহমেদের সময় প্রকাশনীর চারটি, সহযোগী প্রতিষ্ঠান ‘অধুনা’ থেকে একটি, আফজাল হোসেনের আনিন্দ্য প্রকাশনা থেকে দুটি, তারই সহযোগী প্রতিষ্ঠান আদিত্য প্রকাশনের নামে দুটি, এ.কে.এম নাসির আহমেদ সেলিমের কাকলি প্রকাশনী থেকে দুটি, তারই সহযোগী প্রতিষ্ঠান ‘প্রচলন’ থেকে একটি এবং আলো ভুবন থেকে একটি। এ ছাড়াও দীব্য এবং তার সহযোগী প্রকাশনী প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে তিনটি, তাম্রলিপি থেকে দুটি, সিদ্দিকীয়া প্রকাশনী থেকে দুটি, নওরোজ কিতাবিস্তান থেকে দুটি এবং জাগৃতি থেকে দুটি বই কেনা হয়েছে। 
এসব বই কেনায় সীমাহীন দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছিলেন অন্যান্য মূলধারার প্রকাশকরা। অবশ্য সম্প্রতি এই অভিযোগ খতিয়ে দেখা শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক। প্রকল্পটির প্রধান কার্যালয়ে দুদক অভিযান চালিয়ে অধিকতর যাচাইয়ের জন্য সংশ্লিষ্ট রেকর্ডপত্র সংগ্রহ করেছে। এসব তথ্য ও নথি বিশ্লেষণের পর কমিশনের কাছে বিস্তারিত প্রতিবেদন দাখিল করা হবে বলে জানা গেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, এই প্রকল্পটির যে চিন্তা থেকে করা হয়েছিল তা খুবই ভালো ছিল। প্রকল্পটি সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়িত হলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে পাঠাভ্যাস তৈরি হতো। কিন্তু ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের উচ্চ পর্যায়ের অনৈতিক হস্তক্ষেপে প্রকল্প থেকে শুধু লুটপাটই হয়েছে। ব্যায়ের সিংহভাগই পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের পেছনে ব্যয় হয়েছে। কিন্তু পরামর্শক প্রতিষ্ঠান কোনো কাজই করেনি। এমনকি প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়েছে। মূলত একজন বিশেষ ব্যক্তিকে খুশি করতেই ওই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করা হয়েছিল। এ ছাড়াও দেশে-বিদেশের বিখ্যাত লেখকদের বই কেনার কথা থাকলেও আওয়ামী লীগ সরকারকে খুশি করতে ওই ঘরানার লেখকদের বই কেনা হয়েছে। 
সূত্র আরও জানায়, শীর্ষ কর্মকর্তারা প্রকল্প বাস্তবায়নে কোনো কাজই করেননি। বরং তারা প্রকল্পের দায়িত্ব নিয়ে নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত ছিলেন। প্রকল্পের এক শীর্ষ কর্মকর্তা নিজেকে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের বান্ধবী পরিচয় দিয়ে সব জায়গায় তদবিরসহ প্রভাব বিস্তার করেছেন। 
এ বিষয়ে জানতে প্রকল্প পরিচালক অধ্যাপক সালমা বেগমের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। তার অফিসে গিয়ে জানা যায় তিনি চিকিৎসা সংক্রান্ত কাজে দেশের বাইরে রয়েছেন। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংশ্লিষ্ট এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, কোন বই কেনা হবে সেই তালিকা মন্ত্রণালয় থেকে করা হয়েছে। করোনাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ও জুলাই গণভ্যুত্থানে পর নানা অস্থিরতার কারণে প্রকল্পের কাজ শেষ করা যায়নি। তবে এখন এ প্রকল্পের মেয়াদ আরও দুই বছর বাড়ানোর জন্য মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। যদি মেয়াদ বাড়ানো হয়, তাহলে আশা করি বাকি মেয়াদে প্রকল্পের সব কাজ শেষ করা যাবে। 
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (পরিকল্পনা) সৈয়দ মামুনুল আলম বলেন, প্রকল্পটি রাখা হবে কি নাÑ সরকার এখনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। শিগগিরই এ বিষয়ে বৈঠক হবে। সেখানে বিষয়টি চূড়ান্ত হবে। 

রূপালী বাংলাদেশ

Shera Lather
Link copied!