বিএসবি গ্লোবাল নেটওয়ার্কের নামে স্ত্রী খন্দকার সেলিমা রওশন ও ছেলে আরশ ইবনে বাশারকে সঙ্গে নিয়ে একটি সংঘবদ্ধ প্রতারকচক্র গড়ে তুলেছিলেন এম কে খায়রুল বাশার। স্বল্প খরচে বিদেশে উচ্চশিক্ষার সুযোগ করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে হাতিয়ে নিয়েছেন সাধারণ শিক্ষার্থীদের কোটি কোটি টাকা। এসব টাকায় রাজধানীর গুলশান, বারিধারাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিষ্ঠানটি গড়েছে বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ। চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে ছয় শতাধিক শিক্ষার্থীর সঙ্গে করেছেন প্রতারণা। শুধু তাই নয়, এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ ফাইভ কেনার হোতাও ছিলেন তিনি। বিদেশে শিক্ষার্থী পাঠানোর নামে আদম ব্যবসাও চালিয়েছেন বীরদর্পে। তার খপ্পরে পড়ে অর্থ ও স্বপ্ন খোয়ানো শিক্ষার্থীদের আন্দোলনেও কোনো কাজ হয়নি। আওয়ামী শাসনামলে টিকিটিও ছোঁয়া যায়নি তার। টাকা দিয়ে ম্যানেজ করেছেন সব। অবশেষে মানি লন্ডারিং মামলায় ক্যামব্রিয়ান কলেজ ও বিএসবি গ্লোবাল নেটওয়ার্কের চেয়ারম্যান এম কে খায়রুল বাশারকে জালে আটকেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
গতকাল মঙ্গলবার মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের মামলায় বিএসবি গ্লোবাল নেটওয়ার্কের চেয়ারম্যান খায়রুল বাশারের ১০ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালত এই রিমান্ড মঞ্জুর করেন। গতকাল দুপুরে বাশারকে আদালতে হাজির করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। তাকে ১০ দিন রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার আবেদন করা হয়। শুনানি নিয়ে আদালত রিমান্ডের আবেদন মঞ্জুর করেন।
এর আগে মানি লন্ডারিং আইনের মামলায় গত সোমবার রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকা থেকে বাশারকে গ্রেপ্তার করে সিআইডি। গত ৪ মে গুলশান থানায় সিআইডি মামলাটি করে। মামলাটি তদন্তও করছে সিআইডি। বিদেশে উচ্চশিক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে বিপুল অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে বাশারের বিরুদ্ধে।
এদিকে বাশারকে আদালতে আনার খবরে আদালত প্রাঙ্গণে মানববন্ধন করেন টাকা ফেরত না পাওয়া ভুক্তভোগীরা। মানববন্ধনের একপর্যায়ে বাশারকে আদালতে আনা হলে ভুক্তভোগীরা তাকে লক্ষ্য করে কিল-ঘুষি মারেন। এ সময় তার ওপর ডিমও নিক্ষেপ করেন তারা। জানা গেছে, দুপুরে যখন বাশারকে আদালতে হাজির করা হয়। এ সময় তাকে হেলমেট ও বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট পরিয়ে আনা হয়। প্রথমে তাকে ঢাকার সিএমএম আদালতের হাজতখানায় রাখা হয়। এ সময় বাশারের কাছে প্রতারিত হওয়া শতাধিক শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকেরা আদালতে হাজির হন। তারা বাশারের বিচারের দাবিতে বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকেন। একপর্যায়ে বাশারকে হাজতখানা থেকে আদালতে কাঠগড়ায় নেওয়ার সময় ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের গেটে ভুক্তভোগীরা বাশারকে লক্ষ্য করে ডিম নিক্ষেপ করে। সিঁড়ি দিয়ে আদালতের চারতলায় নেওয়ার সময়ও তাকে কয়েকজন কিল, ঘুষি ও লাথি মারেন।
সিআইডির তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত ৪৪৮ জন ভুক্তভোগী প্রতারিত হওয়ার কথা জানিয়েছেন। তবে প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে কয়েকজন ভুক্তভোগী প্রতারণা ও জালিয়াতির অভিযোগে বিভিন্ন থানায় মামলা করেছেন।
সিআইডি জানায়, গ্রেপ্তার খায়রুল বাশার ও তার পরিবারের সদস্যরা শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আদায় করা অর্থ বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে জমা রাখতেন এবং সেখান থেকে অর্থ উত্তোলন করে স্থাবর সম্পদ ক্রয়, ব্যবসা পরিচালনা ও অবৈধভাবে অর্থ স্থানান্তর করেছেন।
‘আপনার তো জীবন জেলেই কেটে যাবে’
বিএসবির খায়রুল বাশারকে গতকালকে ঢাকার আদালতের কাঠগড়ায় তোলার পর আদালতকক্ষে থাকা সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিরা তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চেয়ে স্লোগান দেন। বিকেল ৩টা ৩৫ মিনিটের দিকে বিচারক এজলাসে আসেন। এ সময় বাশারের বিরুদ্ধে গুলশান থানায় করা মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির উপপরিদর্শক খালিদ সাইফুল্লাহ সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়ান। আদালতের অনুমতি নেওয়ার পর তিনি বলেন, ‘মাননীয় আদালত, খায়রুল বাশারের প্রতিষ্ঠান ১৪১ শিক্ষার্থীকে উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে পাঠানোর কথা বলে ১৮ কোটি টাকা তিনি আত্মসাৎ করেছেন। এ ছাড়া এখন পর্যন্ত ৪৪৮ জন ভুক্তভোগী প্রতারিত হওয়ার কথা আমাদের জানিয়েছেন। আমাদের জানা মতে, আরও অনেক শিক্ষার্থী বিএসবি গ্লোবাল নেটওয়ার্কের কাছ থেকে প্রতারিত হয়েছেন।’
এ পর্যায়ে বাদীপক্ষের আইনজীবী জামাল উদ্দিন খন্দকার আদালতকে বলেন, ‘এই খায়রুল বাশার কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ অন্যান্য দেশে উচ্চশিক্ষার জন্য পাঠানোর নাম করে এক হাজার শিক্ষার্থীর কাছ থেকে অন্তত চার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। বিগত তিন থেকে চার বছর এসব শিক্ষার্থী তার প্রতিষ্ঠানের কাছে টাকা ফেরত চেয়েছেন। বিদেশে না পাঠাতে পারলেও তিনি কোনো শিক্ষার্থীকে টাকা ফেরত দেননি। টাকা ফেরত দেওয়ার নাম
করে যেসব চেক তিনি দিয়েছিলেন, সেগুলো ব্যাংক থেকে বারবারই প্রত্যাখ্যাত হয়েছে।’
খায়রুল বাশারের লোকজনের হাতে মারধরের শিকার ব্যক্তিদের ছবিও আদালতের সামনে উপস্থাপন করেন এই আইনজীবী। একই সঙ্গে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা ও তার মন্ত্রিসভার সদস্যদের সঙ্গে খায়রুল বাশারের ছবিও আদালতের কাছে তুলে ধরেন তিনি। এ সময় উপস্থিত এক আইনজীবী আদালতকে বলেন, ‘মাননীয় আদালত, আমি খায়রুল বাশারের দ্বারা প্রতারিত হয়েছি। এই আদালতে বিচার চেয়ে মামলাও করেছি। আমার মতো আরও ৭০ থেকে ৮০ জন এই আদালতে খায়রুল মাশারের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। আমার ১৭ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি।’
এ পর্যায়ে ঢাকার সিএমএম আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) মুহাম্মদ শামছুদ্দোহা আদালতকে বলেন, ‘মাননীয় আদালত, সমাজে যে ব্যক্তি শিক্ষায় অবদান রাখেন, তিনি একজন সম্মানিত মানুষ। বিএসবি গ্লোবাল নেটওয়ার্কের খায়রুল বাসার শিক্ষাকে ব্যবসায় রূপান্তর করেছেন। তিনি মানুষকে প্রতারিত করেছেন। শত শত শিক্ষার্থীর স্বপ্ন ভেঙে দিয়েছেন। তিনি কয়েক শ শিক্ষার্থীর কাছ থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন।’
রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলির বক্তব্যের পর ঢাকার সিএমএম আদালতের অ্যাডিশনাল সিএমএম সানাউল্লাহ বিএসবি গ্লোবাল নেটওয়ার্কের খায়রুল বাশারকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘আপনি কীভাবে এত শিক্ষার্থীকে প্রতারিত করলেন?’
আদালত বলেন, ‘আপনি উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে পাঠানোর নাম করে শত শত শিক্ষার্থীকে বিদেশে না পাঠিয়ে তাদের টাকা আত্মসাৎ করেছেন। তারা তো আপনার সন্তানতুল্য। আপনি কীভাবে আপনার সন্তানতুল্য এত শিক্ষার্থীকে প্রতারিত করলেন? আপনি এতগুলো মানুষকে এমন বিপদের মুখে ঠেলে দিলেন!’
আদালত খায়রুল বাশারের উদ্দেশে আরও বলেন, ‘আপনার নামে কতটি মামলা রয়েছে, আপনি জানেন?’ জবাবে খায়রুল বাশার বলেন, ‘মাননীয় আদালত, আমার জানামতে ৭০টি মামলা রয়েছে।’ তখন আদালত তার উদ্দেশে বলেন, ‘আপনার বিরুদ্ধে যত মামলা, যত গ্রেপ্তারি পরোয়ানা, আপনার তো জীবন জেলেই কেটে যাবে।’ এ সময় মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকেন খায়রুল বাশার।