ঢাকা বুধবার, ১৬ জুলাই, ২০২৫

স্যানিটারি ইন্সপেক্টর শামসুলের হাতে আলাদিনের চেরাগ

রূপালী প্রতিবেদক
প্রকাশিত: জুলাই ১৬, ২০২৫, ০৩:২৩ এএম

ময়মনসিংহের জেলা স্যানিটারি ইন্সপেক্টর এ কে এম শামসুল আলমের হাতে যেন আলাদিনের চেরাগ। দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জন করেছেন কোটি কোটি টাকার সম্পদ। তার এক ব্যাংকেই রয়েছে ছয়টি একাউন্ট, যাতে বিপুল পরিমাণ লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী থেকে মাত্র আট বছরে কোটি কোটি টাকার মালিক বনে যাওয়া এই স্যানিটারি ইন্সপেক্টরের স্ত্রী-মেয়ের নামেও রয়েছে বিপুল সম্পদ। অভিযোগ রয়েছে, ভ্রাম্যমাণ আদালতের ভয় দেখিয়ে জেলার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ভোগ্যপণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান থেকে নিয়মিত মাসোহারা আদায় করেন তিনি। তার বিরুদ্ধে চলতি বছরের জুন মাসে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) অভিযোগ জমা পড়েছে বলে দুদক সূত্রে জানা গেছে। 
জানা গেছে, ময়মনসিংহ সদরের দাপুনিয়ায় শামসুল আলম ১৯৮৮ সালে স্বাস্থ্য সহকারী হিসেবে চাকরিতে যোগদান করেন। প্রমোশন পেয়ে স্যানিটারি ইন্সপেক্টর ও জেলা স্যানিটারি ইন্সপেক্টর হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন। ২০১৬-২০১৭ সালের হিসাব অনুযায়ী তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী হিসেবে তার মাসিক বেতন ছিল সাকল্যে ৩৫ হাজার ২৯৫ টাকা। ৩৫ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করে মাত্র আট বছরে কোটিপতি বনে গেছেন তিনি। 
দুদকে অভিযোগ ও বিভিন্নভাবে অনুসন্ধানে জানা গেছে, স্যানিটারি ইন্সপেক্টর এ কে এম শামসুল আলমের ময়মনসিংহ শহরের বাইপাস ময়নার মোড়ে কেওয়াটখালী মৌজায় ৩ শতাংশ জমির ওপর পাঁচতলা একটি বাড়ি  রয়েছে, যার ক্রয়মূল্যসহ নির্মাণ খরচ প্রায় ৫ কোটি টাকা। এ ছাড়া একই মৌজায় তার ১৪৩ দশমিক ৭৫ অযুতাংশ জমি রয়েছে, যার দাম প্রায় ২৫ লাখ টাকা। ময়নার মোড়ের পাঁচতলা বাড়িসংলগ্ন পাকা রাস্তার উত্তর পাশে ৫ দশমিক ৭৫ শতাংশ জমি রয়েছে, যার দলিল নম্বর ৮২৫২। এই জমির দাম প্রায় ১ কোটি টাকা, যা এ কে এম শামসুল আলমের আয়কর নথিতে দেখানো হয়নি। 
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, শামসুল আলমসহ ১৩ জন যৌথভাবে মাসকান্দা মৌজায় ১৩ শতাংশ জমির ওপর একটি ১০ তলা ভবন নির্মাণ করেন। ওই ভবনে ৩৬টি ফ্ল্যাট রয়েছে। এতে স্যানিটারি ইন্সপেক্টর শামসুল আলম ভাগে পেয়েছেন তিনটি ফ্ল্যাট। ওই তিন ফ্ল্যাটের নির্মাণ খরচ আনুমানিক দেড় কোটি টাকা। এ ছাড়া শহরের নতুন বাজার সাহেব আলী রোডে যৌথ মালিকানায় একটি বহুতল ভবনে তার দুটি ফ্ল্যাট রয়েছে, যার বাজারমূল্য আনুমানিক ৮০ লাখ টাকা। 
জানা গেছে, শামসুল আলম তার আয়কর নথিতে ব্যাংকে গচ্ছিত ও অন্যান্যভাবে ১৫ লাখ ৫৪ হাজার ৬১৩ টাকা উল্লেখ করেছেন, যা তিনি নিজে গচ্ছিত রাখেন বলে বিশ^স্ত সূত্রে জানা গেছে।
ময়মনসিংহ শহরের টাউন হল মৌজার নতুন বাজার সাহেব আলী রোডে যৌথভাবে ৫৭ অযুতাংশ জমির ওপর নির্মাণাধীন একটি ভবনে শামসুল আলমের দুটি ফ্ল্যাট রয়েছে, যার আনুমানিক দাম ৮০ লাখ টাকা। কোটি কোটি টাকার সম্পদ ও নগদ টাকা থাকা সত্ত্বেও তিনি ব্যাংক, নগদ গচ্ছিত ও অন্যান্যভাবে ১৫ লাখ ৫৪ হাজার ৬১৩ টাকা

আয়কর নথিতে উল্লেখ করেছেন। 
স্থানীয় একটি সূত্র জানায়, স্যানিটারি ইন্সপেক্টর শামসুল আলমের স্ত্রী শামছুন নাহার রুমা ও তার মেয়ে নাফি তাসনিম প্রভার নামেও রয়েছে বিপুল সম্পদ। সূত্র জানায়, রুমা একজন গৃহিণী এবং মেয়ে প্রভা একজন ছাত্রী। তাদের কোনো উপার্জন নেই। তবে তাদের নামেও ট্যাক্স আয়কর ফাইল খোলা হয়েছে, যা ময়মনসিংহ আয়কর অফিসে সংরক্ষিত আছে। একজন গৃহিণী ও একজন ছাত্রীর নামে আয়কর নথি খোলা মানে তাদের নামে সম্পদ আছে। 
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শামসুলের এক সহকর্মী জানান, শুধু শামসুলের নিজের নামেই নয়, তার স্ত্রী ও মেয়ের নামেও জমিজমা, সঞ্চয়পত্র, বিমা, ডিপিএস, সঞ্চয়ী হিসাবসহ আরও ব্যাংক হিসাব থাকতে পারে, যা বাংলাদেশ ব্যাংকের বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) মাধ্যমে উদঘাটন করা সম্ভব বলে মন্তব্য করেন তিনি। 

অনুসন্ধানে জানা গেছে, স্যানিটারি ইন্সপেক্টর শামসুল আলম তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী হিসেবে ২০১৬-১৭ সালের হিসাব অনুযায়ী মাসিক বেতন পেতেন ৩৫ হাজার ২৯৫ টাকা। ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরের আগে ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলনের পরও তার স্থিতি ছিল ৭ লাখ ৩৯ হাজার ৬৭২ টাকা। জানা গেছে, তার ওই বেতন থেকে প্রতি মাসে জিপিএফে ৫ হাজার টাকা কাটা হয়। এ ছাড়া একটি ডিপিএসে জামা দেন ১০ হাজার টাকা এবং অপর এক ডিপিএসে জমা দেন ১০ হাজার টাকা। কল্যাণ ফান্ডে ৫০ টাকা করে জমা দেন। তাহলে এসব নিয়ে তার মাসে ২৫ হাজার ৫০ টাকা জমা দেওয়ার পর বেতনের অবশিষ্ট থাকে মাত্র ১০ হাজার ২৪৫ টাকা। এই টাকা দিয়ে বাড়িভাড়াসহ সংসার

চালানো খুবই দুষ্কর এবং অসম্ভব। 
জানা গেছে, একজন সরকারি চাকরিজীবীর চাকরির পাশাপাশি কোনো প্রকার ব্যবসা করার সুযোগ নেই। তাই তার সহকর্মীরা প্রশ্ন তুলেছেন, মাত্র ১০ হাজার টাকায় স্ত্রী ও এক কন্যাসন্তানসহ তিনজনের ভরণ-পোষণ, লেখাপড়ার খরচ ও নিজের হাতখরচ এবং প্রথম দিকে ভাড়া বাসায় বাস করে কী এমন আলাদিনের চেরাগ পেলেন যে মাত্র আট বছরেই আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে গেলেন তিনি। 

এ ছাড়া স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ময়মনসিংহ শাখায় তার নিজ নামেই রয়েছে ছয়টি অ্যাকাউন্ট, যাতে বিপুল পরিমাণ টাকা লেনদেনের প্রমাণ রয়েছে। এর হিসাব নম্বরসমূহÑ সঞ্চয়ী হিসাব নং-০৫৩৭১৫০০২৬২, ০৫৩৭১৫০০২২৫, ০৫৩৬৮০০০০১৪, ০৫৩৩৪০০০৭৬৭, ০৫৩৩৪০০১২৬৭ এবং ০৫৩৩৪০০১৬৭০। এ ছাড়া তার স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক ময়মনসিংহ শাখায় হিসাব নং-০৫৩৫৫০০১০৪১তে ১০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র কেনা আছে।
স্যানিটারি ইন্সপেক্টরের বিরুদ্ধে প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগও রয়েছে। জানা গেছে, ২০১২ সালে মাসকান্দা মৌজার লাশকাটা ঘরের বিপরীতে ১৩ জন মিলে ১৩ শতাংশ জমি কিনে সৌহার্দ্য টাওয়ার নির্মাণ করেন, যার মধ্যে অন্যতম শেয়ারহোল্ডার শামসুল আলম। অভিযোগ রয়েছে, ওই জমি ১ কোটি ৫৬ লাখ টাকায় কেনা হয়েছে। প্রতি শেয়ারে (শতাংশে) ১২ লাখ টাকা দেন শেয়ারহোল্ডাররা। কিন্তু শামসুল আলম প্রতি শতাংশে ১ লাখ করে মোট ১৩ লাখ টাকা প্রতারণা করে আত্মসাৎ করেছেন। বিষয়টি শেয়ার মালিকগণ জানতে পারলেও শামসুল আলম স্থানীয় ও প্রভাবশালী হওয়ায় তারা নীরবে হজম করেন। কিন্তু একজন শেয়ার মালিক মেজর (অব.) সৈয়দ সাখাওয়াত শামসুল আলমের বিরুদ্ধে প্রতারণা ও ভবনের মালামাল কেনায় অস্বচ্ছতা ও অসৌজন্যমূলক আচরণ উল্লেখ করে লিখিত অভিযোগ দেন। 

এতে ক্ষিপ্ত হয়ে তার শেয়ার বিক্রি করতে বাধ্য করেন স্যানিটারি ইন্সপেক্ট। ওই শেয়ার অপর একজনের কাছে ৩০ লাখ টাকায় বিক্রি করে সৈয়দ সাখাওয়াতকে ১৮ লাখ টাকা দিয়ে বাকি ১২ লাখ টাকা প্রজেক্টের লাভ বলে নিজে আত্মসাৎ করেন। এর কিছুদিন পর অপর এক শেয়ারহোল্ডার প্রতিবাদ করলে পেশিশক্তির জোর দেখিয়ে তার শেয়ারও বিক্রি করতে বাধ্য করান শামসুল আলম। এভাবেই তার দুর্নীতি বা প্রতারণার প্রতিবাদ করলেই তাকে পেশিশক্তিতে সায়েস্তা করেন তিনি। এ ছাড়া ওই ভবনের ফ্ল্যাট দখল ও বেশ কয়েকজন শেয়ারহোল্ডারের মোটা অঙ্কের টাকা প্রতারণার মাধ্যমে আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। 

অভিযোগ রয়েছে, তিনি অফিস করেন না নিয়মিত। কিন্তু প্রভাব খাটিয়ে বেতন-ভাতা উত্তোলন করেন। 
এসব অভিযোগের বিষয়ে স্যানিটারি ইন্সপেক্টর শামসুল আলম রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমি ছোট একটা চাকরি করি। সম্পদের মধ্যে একটা মেয়ে আছে, সে মেডিকেলের শিক্ষার্থী। পৈতৃক সম্পত্তি বিক্রি করে আমি একটা বাড়ি করার প্ল্যান করছি। এটা কি আমার অপরাধ হয়ে গেছে? আমার কোটি কোটি টাকার সম্পদ নেই। একটি শত্রুপক্ষ প্রতিহিংসামূলক আমাকে হয়রানি ও হেয় করার জন্য বিভিন্ন স্থানে অভিযোগ করছে।

আমার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের পুরোটাই মিথ্যা।’ এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘আমি ব্যক্তিজীবনে কয়েকজনের উপকার করেছিলাম। সেই উপকারের উপহার হিসেবে আমার অপকার করার চেষ্টা করছে একটি পক্ষ। তারা আমাকে বিপদে ফেলতে, কষ্ট দিতে আমার নামে প্রোপাগান্ডা চালাচ্ছে।