চলতি পথে আমরা অনেকেই হয়তো নজর দিই না রাস্তায় শুয়ে থাকা মানুষটির দিকে। শহুরে জীবনে ব্যক্তিগত ব্যস্ততায় এসব মানুষের উপস্থিতি যেন এক অনাহূত বাস্তবতা। এদের অনেকেরই মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকু পর্যন্ত নেই।
বস্তি কিংবা ফুট ওভারব্রিজ অথবা রাস্তার পাশেই পার করেন তারা দিন-রাত্রি। এক শহরে বাস করেও এসব মানুষকে আমরা নিত্যই দেখি কিংবা এড়িয়ে যাই সচেতনভাবে। অথচ পরিসংখ্যানের দিকে চোখ রাখলে অবাক হতে হয় বিশ্বজুড়ে এমন মানুষের সংখ্যা কয়েক কোটি।
যারা ‘বাসস্থানের’ মতো মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। থাকার মতো একটা ঘর নেই এ সংকট আজ আর শুধু দরিদ্র মানুষের নয়; বরং সর্বজনীনভাবে এটি বৈশ্বিক মানবিক সংকট হিসেবে দেখা দিয়েছে। যার পেছনে রয়েছে যুদ্ধ, দারিদ্র্য, দুর্যোগ, অব্যবস্থাপনা এবং অনেক ক্ষেত্রে নিছক অমানবিকতা।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এ বাস্তবতাও কম করুণ নয়। দেশে প্রতি ১০ হাজার মানুষের মধ্যে ৩০৭ জনের নিজের কোনো মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই। বিশেষ করে ঢাকাসহ প্রধান শহরগুলোতে গ্রাম থেকে আসা দরিদ্র মানুষদের বিশাল অংশ ফুটপাত, রেলস্টেশন বা বস্তিতে আশ্রয় নেয়।
শহরায়ণের চাপে প্রান্তিক মানুষদের নিজস্ব জমি বা ঘর করার সামর্থ্য ক্রমেই কমছে। একটি সমাজ কতটা মানবিক, তা বোঝা যায় তার সবচেয়ে প্রান্তিক মানুষদের অবস্থা দেখে। আজ যখন আমরা চাঁদে ঘর বানানোর স্বপ্ন দেখি, তখন পৃথিবীরই কোটি কোটি মানুষ ঘরহীন অবস্থায় বেঁচে থাকে এই বৈপরীত্যই আমাদের বিবেককে নাড়া দেওয়ার কথা। ঘরহীনতা শুধু একটি পরিসংখ্যান নয়, এটি হাজার হাজার ভাঙা জীবন, বঞ্চিত শিশুকাল এবং বিপন্ন ভবিষ্যতের নাম।
জাতিসংঘের ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বের ১৪৬ সুখী দেশের তালিকায় অস্ট্রেলিয়ার অবস্থান ১২। তবে অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, পৃথিবীর অন্যতম সুখী এই দেশে এক লাখ ২২ হাজারের বেশি গৃহহীন মানুষ আছেন, যাদের বেশির ভাগ যুবক।
অস্ট্রেলিয়ান ইনস্টিটিউট অব হেলথ অ্যান্ড ওয়েলফেয়ারের এক প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে। বিশ্বের সর্ববৃহৎ দুটি দেশের মধ্যে, চীনে গৃহহীন মানুষের সংখ্যা ২৫ দশমিক ৮ লাখ, তবে প্রতি ১০ হাজারে হার খুবই কম মাত্র ১৯ দশমিক ২ জন।
এর মানে, সংখ্যাটি যতটা বিশাল মনে হয়, অনুপাতে তা অনেকটাই কম। ভারতে ১ দশমিক ১৭ লাখ মানুষ গৃহহীন বলে গণ্য হলেও প্রতি ১০ হাজারে এ হার মাত্র ১২ দশমিক ৬ জন। তবে প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, কারণ শহরের বস্তিগুলোকে অনেক সময় সরকারিভাবে গৃহনির্ভর বলে বিবেচনা করা হয়।
বিশ্বে একদিকে যেমন যুদ্ধ-সংঘাত, আবার অন্যদিকে জলবায়ু সংকটসহ নানা কারণে বিশ্বে বাড়ছে গৃহহীন মানুষের সংখ্যা। জাতিসংঘের তথ্য মতে, বর্তমানে গৃহহীনদের সংখ্যা ৩০ কোটি ছাড়িয়েছে। আর জনাকীর্ণ স্থানে বসবাস করা জনসংখ্যা অন্তত ২৮০ কোটি।
এদের মধ্যে গাজার বাসিন্দাদের অবস্থা সবচেয়ে নাজুক। এসব জায়গায় রয়েছে খাবার, সুপেয় পানি, স্যানিটেশন, চিকিৎসা ও জ্বালানির মতো মৌলিক পরিষেবাগুলোর তীব্র সংকট। গাজায় এখন পর্যন্ত অন্তত ১ লাখ ২৫ হাজার টন বিস্ফোরক দিয়ে আগ্রাসন চালিয়েছে ইসরায়েল।
এতে উপত্যকার প্রায় ৯০ শতাংশ বাড়িঘরই পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। যার কারণ ৬ হাজার ২০০ কোটি ডলারের আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি তো হয়েছেই, বাস্তুচ্যুত হয়েছেন ২০ লাখেরও বেশি ফিলিস্তিনি।
যুদ্ধ, আগ্রাসন, হানাহানি ছাড়াও মানুষের গৃহহীন হওয়ার বড় কারণ প্রাকৃতিক দুর্যোগ। জলবায়ুর ক্ষতিকর প্রভাবে একদিকে দাবানলের আগুনে পুড়ে তছনছ হচ্ছে, অন্যদিকে আকস্মিক বন্যা-ভূমিধসেও ঘরবাড়ি হারাচ্ছে মানুষ। এর বাইরেও দরিদ্রতার কারণে বসবাসের অযোগ্য জায়গায় জীবন পার করছেন বিশ্বের লাখ লাখ মানুষ।
এভাবেই বিশ্বে গৃহহীন মানুষের সংখ্যা ৩০ কোটি ছাড়িয়েছে বলে জানিয়েছেন জাতিসংঘের হিউম্যান সেটেলমেন্ট প্রোগ্রামের পরিচালক। বস্তিসহ অনেক ঘরবাড়িতে গাদাগাদি করে বসবাস করায় অনেকের গৃহ সংকটের দৃশ্য খুব একটা সামনে আসে না।
সেই হিসেবে বিশ্বব্যাপী জনাকীর্ণ স্থানে বসবাস করা জনসংখ্যা ২৮০ কোটির বেশি। আর ১১০ কোটির বেশি মানুষ বস্তি বা অনানুষ্ঠানিক বসতিতে বাস করে বলে তথ্য তুলে ধরেছে জাতিসংঘ। জাতিসংঘের হিউম্যান সেটেলমেন্ট প্রোগ্রামের নির্বাহী পরিচালক আনাক্লাউডিয়া রসবাখ বলেন, ‘অনেক মানুষ আছেন জনাকীর্ণ অ্যাপার্টমেন্ট বা বাড়িতে বসবাস করে।
অর্থাৎ অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস করা এসব মানুষের বিষয়গুলো অনেক সময় সামনে আসে না। আজকাল সর্বত্র রাস্তায়ও অনেক মানুষকে বসবাস করতে দেখা যায়। সে হিসেবে আমাদের কাছে বর্তমানে থাকা তথ্য অনুযায়ী ৩০ কোটি মানুষ গৃহহীন। সংখ্যাটি আরও বেশি হবে, কারণ অনেক তদন্ত এখনো শেষ হয়নি।’
জাতিসংঘের হিউম্যান সেটেলমেন্ট প্রোগ্রামের নির্বাহী পরিচালক আনাক্লাউডিয়া রসবাখ বলেন, ‘আপনি বস্তি কিংবা ভাসমান বসতিগুলোতে দেখতে পাবেন, সেখানকার মানুষ সুপেয় পানি, স্যানিটেশন, বিদ্যুতের অভাবসহ চরম মৌলিক পরিষেবাগুলোর অভাবে খুবই অনিশ্চিত জীবনযাপন করেন।’
বিশ্বব্যাপী এভাবে গৃহহীন ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস করা মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধিকে উদ্বেগজনক বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। এমন বিপর্যয়কর পরিস্থিতির মধ্যেও তহবিল সংকটে বিশ্বজুড়ে মানবিক সহায়তা বঞ্চিতের ঝুঁকিতে ১ কোটি ১৬ লাখের বেশি শরণার্থী। এমন তথ্য তুলে ধরেছে জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর। যুদ্ধ, সংঘাত, জলবায়ু সংকটসহ নানা কারণে বিশ্বে বাড়ছে গৃহহীন মানুষের সংখ্যা।
বিশ্বে গৃহহীনের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে পাকিস্তান, যেখানে গৃহহীন মানুষের সংখ্যা প্রায় ৮০ লাখ। প্রতি ১০ হাজার মানুষের মধ্যে প্রায় ৩৩১ জন ঘরহীন। দেশটিতে রাজনৈতিক অস্থিরতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং নাগরিক সেবার ঘাটতি সব মিলিয়ে পরিস্থিতি ভয়াবহ।
বিশেষত বন্যা, খরা ও বাস্তুচ্যুতির কারণে বহু মানুষ শহরের ফুটপাতেই আশ্রয় খুঁজে নেয়। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে সিরিয়া, যেখানে গৃহহীন মানুষের সংখ্যা ৫৩ লাখ। এই সংখ্যা দেশটির মোট জনসংখ্যার বিশাল একটি অংশ। গৃহযুদ্ধ, আইএসের উত্থান-পতন, আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ সব কিছু মিলিয়ে দেশের অভ্যন্তরেই লাখ লাখ মানুষ তাদের ঘর হারিয়েছেন।
মিসর, যাকে পিরামিডের দেশ বলা হয়, সেখানেও ২০ লাখ মানুষ আশ্রয়হীন। আর ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গোতে, যেটি আফ্রিকার খনিজ সম্পদে ভরপুর দেশ, ১৫ লাখ মানুষ এখনো ঘরছাড়া, যা আফ্রিকান মানবিক সংকটের প্রতীক।
অনেকেই মনে করেন, গৃহহীনতা শুধু দারিদ্র্যপ্রবণ দেশের সমস্যা। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, উন্নত দেশেও এ সমস্যাটি বিদ্যমানÑ তবে ভিন্ন রূপে। যেমন যুক্তরাষ্ট্র বা যুক্তরাজ্যের মতো দেশগুলোতেও হাজার হাজার মানুষ ফুটপাত বা আশ্রয়কেন্দ্রে রাত কাটায়। তবে এই তালিকায় তারা নেই, কারণ এ ক্ষেত্রে সংখ্যার পরিবর্তে অনুপাত গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশের জনসংখ্যা বেড়েছে। সে তুলনায় দেশে ভূমিহীনদের সংখ্যা তুলনামূলক কমেছে। সরকারি হিসাবে দেশে বর্তমানে নিজের কোনো জমি নেই এমন মানুষের সংখ্যা ৯১ লাখ। দেশের উচ্চ দারিদ্র্যসীমায় থাকা ২৫ দশমিক ৮ শতাংশের নিজের কোনো জমি নেই।
আবার হতদরিদ্রদের মধ্যে ৯ দশমিক ৫ শতাংশের কোনো জমি নেই। ২০১০ সালে ভূমিহীনদের হার ছিল ৩৫ দশমিক ৪ শতাংশ। এক যুগের ব্যবধানে ভূমিহীনদের সংখ্যা কমেছে উল্লেখযোগ্য হারে। সরকারের নেওয়া আশ্রয়ণ প্রকল্পের ফলে অনেক ভূমিহীন মানুষের আশ্রয়ণ হয়েছে।
সম্প্রতি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর খানা আয়-ব্যয় জরিপে এ তথ্য উঠে এসেছে। জরিপের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, উচ্চ দারিদ্র্যসীমায় রয়েছে দেশের ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষ। জনশুমারির হিসাব অনুযায়ী দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯৮ লাখ ২৮ হাজার ৯১১ জন। সে হিসাবে উচ্চ দারিদ্র্যের মধ্যে থাকা জনসংখ্যা দাঁড়ায় ৩ কোটি ১৭ লাখ ৫৮ হাজার ৬ জন।
২০২৩ সালে অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে সাড়ে ৭ কোটির ওপর। এর পেছনে দায়ী প্রাকৃতিক দুর্যোগ, সংঘাত ও যুদ্ধ। বিশ্লেষকরা বলছেন, নতুন করে জীবন সাজাতে বাস্তুচ্যুতদের কয়েক বছর সময় লেগে যায়।
যুদ্ধ, সংঘাতসহ নানা কারণে যারা নিজ দেশের সীমানায় এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় স্থানান্তরিত হয়, তারা অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু। নিজ দেশের সীমানা ছাড়িয়ে অন্য দেশে যেতে বাধ্য হলে, তাদের ধরা হয় শরণার্থী। বিশ্বজুড়ে প্রতিবছরই বাড়ছে অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা। গত ৫ বছরে এ সংখ্যা বেড়েছে অন্তত ৫০ শতাংশ।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন