দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে জনজীবনে উদ্বেগ ক্রমেই বাড়ছে। দেশজুড়ে ডাকাতি, ছিনতাই, লুটপাট, রাহাজানি, চাঁদাবাজি, মব-সন্ত্রাস, খুন, ধর্ষণসহ নানাবিধ অপরাধের ঘটনা প্রতিদিনই ঘটছে। পাশাপাশি চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়েও দেশের মানুষের মধ্যে রয়েছে হতাশা। এর মধ্যে চলতি আগস্ট মাস ঘিরে জনমনে যোগ হয়েছে নতুন আতঙ্ক, চাপা উত্তেজনা আর নৈরাজ্যের আশঙ্কা।
প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, নির্বাচন বানচাল করতে একটি মহল অরাজকতা চালাতে পারে। খোদ পুলিশের গোয়েন্দা সংস্থাও শঙ্কা প্রকাশ করেছে, এই সময়ে নাশকতা হতে পারে। এরই মধ্যে বিশেষ শাখা থেকে চিঠি দিয়ে দেশের সব পুলিশ ইউনিটকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।
সেনাবাহিনীর মিলিটারি অপারেশনসের পরিচালক বলছেন, একটা বিপৎসঙ্কুল সময় চলছে। অন্যদিকে পুলিশপ্রধান বলছেন, তিনি এ ব্যাপারে কিছুই জানেন না বা বলবেন না। যদিও স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলছেন, ৫ আগস্ট ঘিরে কোনো ধরনের নিরাপত্তার শঙ্কা নেই। অথচ আগামী কয়েক দিন অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মন্তব্য করেছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম।
গত বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় এ মন্তব্য করেন তিনি। প্রেস সচিব বলেন, আগামী পাঁচ-ছয় দিন সরকারের জন্য খুবই ক্রুশিয়াল (গুরুত্বপূর্ণ) টাইম। পাঁচ-সাত দিনে বোঝা যাবে, আমরা কোথায় যাচ্ছি। এ ধরনের পরস্পরবিরোধী বক্তব্যে জনমনে আশঙ্কা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে বলে মনে করছেন অনেকে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের বিশেষ শাখার রাজনৈতিক উইংসের একজন কর্মকর্তা টেলিফোনে রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘দেশে অস্থিতিশীল অবস্থা তৈরি করতে পরাজিত রাজনৈতিক শক্তির পক্ষ থেকে ভয়াবহ নাশকতার ছক তৈরি করা হয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে। বিভিন্ন দেশে পলাতক বিগত সরকারদলীয় কিছু নেতাকর্মী, আমলা, সশস্ত্র ও পুলিশের সাবেক কর্মকর্তাদের নিয়ে আঁটা হচ্ছে নানান অপকৌশল।
আর সেই অপকৌশলের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে আত্মগোপনে থেকে নীলনকশা প্রস্তুত করছেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং পলাতক অতিরিক্ত আইজিপি মনিরুল ইসলাম। বর্তমানে তারা দুজনই ভারতে পলাতক আছেন। জুলাই বিপ্লবের বর্ষপূর্তি ঘিরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোই তাদের প্রধান টার্গেট।’
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, গণঅভ্যুত্থানের এক বছর পূর্ণ হচ্ছে আগামী ৫ আগস্ট। নানান রাজনৈতিক কর্মসূচি পালিত হবে এই দিনকে ঘিরে। ফলে সেদিনই দেশ দখলের স্বপ্ন দেখছে আওয়ামী লীগ। অস্থিরতা তৈরি করতে ঢাকা ও দিল্লিতে চালানো হয়েছে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম। এরই মধ্যে রাজধানীর ভাটারা থানা এলাকায় চার শতাধিক আওয়ামী ক্যাডারকে কর্মশালার নামে ট্রেনিং দেওয়া হয়েছে।
এ ছাড়া গোপালগঞ্জকে সন্ত্রাসীদের অভয়াশ্রম ধরে সেখানে প্রস্তুত করা হচ্ছে প্রশিক্ষণের ক্ষেত্র। দেশের বাইরেও পুরোদমে কার্যক্রম চালাচ্ছে আওয়ামী ক্যাডাররা। ভারতের বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী জেলাগুলোয় জড়ো হচ্ছে পলাতক ও গা-ঢাকা দেওয়া এই চক্রের সদস্যরা।
গত বৃহস্পতিবার রাতে রাজধানীর একটি রেস্টুরেন্টে সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ের সচেতন কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। এই কয়েকজনের মধ্যে রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, শিল্পপতি, সাধারণ ব্যবসায়ী এবং দুজন শীর্ষস্থানীয় পুলিশ কর্মকর্তাও ছিলেন। নানান বিষয় নিয়ে আলোচনার একপর্যায়ে উঠে আসে আগস্ট ঘিরে সৃষ্ট আশঙ্কার কথাও।
রাজনীতিবিদ আর পুলিশ কর্মকর্তাদের ভাষ্য, ওপার বাংলা থেকে প্রচার হওয়া কিছু গণমাধ্যমের অতিরঞ্জিত আর উসকানিমূলক বার্তা, সরকারের ভেতরে উপদেষ্টা পর্যায় থেকে যেসব কথা বলা হয়, সেগুলোর মধ্যে কোনো সামঞ্জস্য খুঁজে না পাওয়া এবং অপরাধ দমনে পুলিশের অনেকটা নিষ্ক্রিয়ভাবের কারণেই এই আশঙ্কাগুলো খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে।
তবে সম্প্রতি পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) সতর্কবার্তা, আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগের একটির অংশকে ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় গোপনে গেরিলা হামলা চালানোর প্রশিক্ষণ দেওয়ার কথা এবং এই প্রশিক্ষণ ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত একজন সেনা কর্মকর্তাকে সেনা হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার ঘটনা প্রচার পাওয়ায় এই জন-আতঙ্ক আরও বেড়ে গেছে। রেস্টুরেন্টের বৈঠকে অবশ্য কেউ কেউ মন্তব্য করেনÑ পুরো বিষয়টাই একটা রাজনৈতিক নাটক। পরাজিত রাজনৈতিক শক্তি যাতে করে নতুনভাবে মাথাচড়া দিয়ে উঠতে না পারে, সেটা ঠেকাতে বা তাদের দমনের জন্য এই প্রচারণাও একটা কৌশল।
অপরাধ বিশ্লেষকদের মতে, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়েছে প্রায় এক বছর। এর মধ্যে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির প্রত্যাশিত উন্নতি হয়নি। বলা চলে, প্রতিদিনই পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। পুলিশ তাদের মনোবল পুরোদমে এখনো ফিরে পায়নি। রাজনৈতিক অস্থিরতা, ঘনঘন বদলি, সঠিক নির্দেশের দুর্বলতা তাদের দমিয়ে রাখছে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় দেশের ১৭টি কারাগারের পাশাপাশি বহু থানা ও পুলিশ ফাঁড়িতে হামলা চালিয়ে অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুট হয়। অনেক সাজাপ্রাপ্ত বন্দি ও সন্ত্রাসী পালিয়ে যায়।
এখনো ৭০০ বন্দি পলাতক, অনেক অস্ত্র উদ্ধার হয়নি। এসব অস্ত্র অপরাধীদের হাতে চলে গেছে। সে রাজনৈতিক অপরাধী হোক কিংবা পেশাদার অপরাধী। সন্ত্রাসমূলক কর্মকা-েই এসব অস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে এবং হবে। নেতারা টকশোতে মঞ্চে বড় বড় কথা বলেন, কিন্তু এদের গ্রেপ্তার আর অস্ত্র উদ্ধারে দৃশ্যমান কোনো তৎপরতা নেই বললেই চলে। জনমনে বর্তমানে যে আশঙ্কা বিরাজ করছে, এসবও তার একটা বড় কারণ। একই কারণে সামাজিক অস্থিরতাও নতুন করে গতি পাচ্ছে।
বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, হামলা-নাশকতার আশঙ্কায় মানুষের মধ্যে চাপা আতঙ্ক কাজ করছে। গোয়েন্দা সূত্র থেকে প্রচার পাওয়া গণমাধ্যম থেকে জানা সংবাদেই তারা ভাবছেন, ৫ আগস্ট সামনে রেখে দেশে যেকোনো সময় অঘটন ঘটতে পারে। এসবির প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২৯ জুলাই থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত সময়কে কেন্দ্র করে অনলাইন ও অফলাইনে সংঘবদ্ধ প্রচারণার মাধ্যমে দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টির চেষ্টা করা হতে পারে।
এদিকে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ ওঠা মেজর পদমর্যাদার এক সেনা কর্মকর্তাকে রাজধানীর উত্তরা থেকে আটক করে সেনা হেফাজতে নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর)। গত ১৭ জুলাই তাকে আটক করা হয়। এ ঘটনায় তদন্ত আদালত গঠন করা হয়েছে এবং প্রাথমিক তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে।
গতকাল শুক্রবার এক বিজ্ঞপ্তিতে আইএসপিআর এ খবর জানিয়েছে। আইএসপিআর বলেছে, সম্প্রতি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাধ্যমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জনৈক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ পাওয়া যায়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেছে।
উল্লেখ, রাজধানীর ভাটারা থানা এলাকার একটি কনভেনশন সেন্টারে ‘গোপন বৈঠক’ ঘিরে কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকা আওয়ামী লীগ, নিষিদ্ধ ছাত্রলীগসহ অন্যান্য সহযোগী সংগঠনের ২২ নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। ওই বৈঠকে মেজর পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তার সংশ্লিষ্ট থাকার অভিযোগ ওঠে।
এ ঘটনায় রাজধানীর ভাটারা থানায় একটি মামলা করেছে পুলিশ। ভাটারা থানা সূত্র মামলার এজাহারের উদ্ধৃতি দিয়ে জানায়, গত ৮ জুলাই ভাটারা থানা এলাকার কেবি কনভেনশন সেন্টারে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ একটি গোপন বৈঠকের আয়োজন করে। সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অনুষ্ঠিত বৈঠকে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগ ও অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারীরা মিলে প্রায় ৪০০ জন অংশ নেন।
বৈঠকে পরিকল্পনা হয়, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশ পাওয়ার পর সারা দেশ থেকে লোকজন ঢাকায় সমবেত হবে। তারা ঢাকার শাহবাগ মোড় দখল করে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি এবং জনগণের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করে দেশে শেখ হাসিনার প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করবে।
সারা দেশে সতর্ক অবস্থানের বিষয়ে ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি রেজাউল করিম মল্লিক রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘যে কোনো অপতৎপরতা ঠেকাতে আমরা প্রস্তুত এবং সব সময়ই সতর্ক। জনগণের জানমালের নিরাপত্তা রক্ষায় আমরা সদা সজাগ।’
ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার শেখ সাজ্জাত আলী রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, পুলিশ কোনো রাজনীতি করে না। ফলে যে কেউ, যে কোনো অসৎ বা নাশকতার পরিকল্পনা নিয়েই আসুক না কেন, রেহাই পাবে না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় প্রস্তুত বলে তিনি জানান।
আলোচিত এ বিষয়ে পুলিশপ্রধান ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ (আইজিপি) বাহারুল আলম গতকাল শুক্রবার টেলিফোনে রূপালী বাংলাদেশকে জানান, অপতৎপরতা ঠেকাতে পুলিশের কৌশল সম্পর্কে তিনি কোনো কথা বলতে ইচ্ছুক নন। উল্টো তিনি গণমাধ্যমকে এ ব্যাপারে আরও সংবেদনশীল হওয়ার আহ্বান জানান।
আইজিপি কথা বলতে না চাইলেও এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশ সদর দপ্তরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার। তিনি বলেন, পুলিশের বিশেষ শাখা সারা দেশে যে সতর্কবার্তা দিয়েছে, সেটা একটা রুটিন ওয়ার্ক। পুলিশের রাজনৈতিক শাখা অনেক গুজবকেও সতর্কতার কারণে গুরুত্ব দিয়ে থাকে।
কিন্তু এটা ঢালাওভাবে প্রচার করাটা ঠিক হয়নি। পুলিশের কৌশল যদি চক্রান্তকারীরা জেনে যায়, তবে তারা তাদের অসৎ কাজের অপকৌশলও শেষ মুহূর্তে এসে পাল্টে ফেলে, যেটা পুলিশের জন্য বুমেরাং হয়ে উঠতে পারে। ফলে পুলিশের প্রস্তুতি বা কৌশল প্রকাশ না পাওয়াটাই সঠিক।
তবে যে যাই বলুক না কেন, বিরাজমান সার্বিক পরিস্থিতিতে সামাজিক বা জন-অস্থিরতার পাশাপাশি রাজনৈতিক অস্থিরতাও বেড়েছে। জনমনে দেখা দিয়েছে আতঙ্ক। অনেক রাজনৈতিক দলের নেতারাও অশুভ কিছুর আশঙ্কা করছেন।
গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় রাজধানীর সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি মিলনায়তনে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘খুব সতর্ক থাকতে হবে, অনেকগুলো ঘটনা ঘটছে, যার আলামত ভালো না। আমি আশঙ্কা করি, যদি ঐক্যবদ্ধ না থাকি, এক-এগারোর মতো ঘটনা ঘটা অস্বাভাবিক নয়।’