অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ২০২৪ সালের আজকের দিনে বাংলাদেশের শাসনভার গ্রহণ করে। এই সময়ের মধ্যে সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের পথে কমবেশি এগিয়ে গেলেও প্রশাসনিক অঙ্গনে গুণগত কোনো পরিবর্তন দৃশ্যমান হয়নি।
সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন এবং নিয়োগ, বদলি, পদায়ন, শাস্তি প্রদানের মতো প্রশাসনিক কার্যক্রমে দেখা গেছে ধীরগতি ও বিশৃঙ্খলা। নেতৃত্বের দুর্বলতা, সিদ্ধান্তহীনতা, নানামুখী তদবির, পদোন্নতি বঞ্চিতদের হতাশা ও ক্ষোভ, আন্তঃক্যাডার দ্বন্দ্ব এবং বিগত সরকারের আশীর্বাদপুষ্টদের অসহযোগিতার কারণে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। বিশেষ করে অবসর থেকে ফিরে আসা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের দুর্বলতা ও প্রযুক্তিগত অদক্ষতায় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে।
তবে এই সরকার মূলত দেশকে একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দেওয়ার মতো বড় দায়িত্ব নিয়েই এসেছে। এরই মধ্যে সংস্কারের যে দায়িত্ব পালন করছে তা তাদের অতিরিক্ত দায়িত্ব। কারণ এসব সংস্কার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমেই অনুমোদন ও বাস্তবায়ন করতে হবে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশের জনগণ এখন এমন একটি সরকার চায়, যা জবাবদিহিমূলক, অংশগ্রহণমূলক এবং জনআস্থার ভিত্তিতে গঠিত। এই লক্ষ্য অর্জনে নির্বাচন হবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এবং সম্ভাবনাÑ দুয়েরই মুখোমুখি।
যদিও ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এক বছর ছিল ঘটনাবহুল, নীতিনির্ধারণে আগ্রাসী কিন্তু বাস্তবায়নে বিভ্রান্তিকর। কিছু সাহসী পদক্ষেপ যেমন প্রশংসনীয়, তেমনি প্রশাসনের অব্যবস্থাপনা, এনবিআরের সংকটসহ প্রশাসনকেন্দ্রিক কিছু বিষয় নিয়ে উদ্বেগও কম নয়। তাই নির্বাচনের মাধ্যমে একটি গ্রহণযোগ্য গণতান্ত্রিক সরকার গঠনের সুযোগ করতে পারলে তা হবে অন্তর্বর্তী সরকারের সবচেয়ে বড় অর্জন। অন্যথায়, শুদ্ধি অভিযানের নামে কর্মকর্তাদের চাকরিচ্যুত, ওএসডি ও গণবদলি নিয়ে অস্থিরতা দেখা দিতে পারে বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
সচিবালয়ের ভেতর প্রশাসনিক মেরূকরণ
সচিবালয়ে বর্তমানে দুই ধরনের কর্মকর্তা চিহ্নিত: একদল সরাসরি অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার নীতির পক্ষে কাজ করছেন; অন্য দল প্রশাসনের দলনিরপেক্ষ ঐতিহ্য রক্ষার চেষ্টা করছেন।
অনেকে মনে করছেন, সরকারের অতিরিক্ত ‘শুদ্ধি অভিযান’ এবং উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের একের পর এক ওএসডি করার সিদ্ধান্তের ফলে নিরাপত্তাহীনতা ও আস্থা সংকট তৈরি হয়েছে। দীর্ঘদিনের মেধাবী ও অভিজ্ঞ ক্যাডারদের প্রশাসন থেকে ছাঁটাই বা কোণঠাসা করে দেওয়ায় অনেকেই নিজের অবস্থান বাঁচাতে নীরব ভূমিকা পালন করছেন।
এদিকে, সচিবালয়ের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে সহস্রাধিক কর্মকর্তার পদ শূন্য রয়েছে কিন্তু বদলির ভয়ে কেউই সেই পদে যেতে আগ্রহী নন। যার ফলে প্রশাসনের ব্যাকবোন দুর্বল হয়ে পড়েছে, দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণের জায়গায় ‘পলিসি প্যারালাইসিস’ দেখা দিয়েছে।
প্রশাসনিক অস্থিরতা ও দুর্বলতা
সরকারের আমলাতান্ত্রিক কাঠামোতে ধারাবাহিকতা ও স্থিতিশীলতা না থাকায় প্রশাসনিক কার্যকারিতা বাধাগ্রস্ত হয়েছে। পদোন্নতি ও বদলির ক্ষেত্রে স্বচ্ছতার অভাব, দক্ষতা বিবেচনায় না এনে রাজনৈতিক আনুগত্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্তÑ এসব কারণে অনেক অভিজ্ঞ কর্মকর্তা অবসরপ্রাপ্ত বা প্রান্তিক হয়ে পড়েছেন।
এ ছাড়াও উন্নয়ন প্রকল্পগুলো পরিকল্পনা অনুযায়ী এগোচ্ছে না। সময়মতো বরাদ্দ না পাওয়া, টেন্ডার প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতা এবং প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জনবল না থাকার কারণে অনেক প্রকল্প স্থগিত বা বিলম্বিত হয়েছে। এতে দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন গতি মন্থর হয়ে পড়েছে।
এনবিআর বিভাজন বিতর্ক এবং সংঘাত
অন্তর্বর্তী সরকার জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে দুই ভাগে ভাগ করার সিদ্ধন্ত নিয়েছে। সরকার দাবি করেছে, এর ফলে দক্ষতা বাড়বে এবং কর ব্যবস্থাপনা আধুনিক হবে। তবে এই প্রস্তাব রাজস্ব প্রশাসনের ভেতরে ভয়াবহ প্রতিক্রিয়া তৈরি করবে বলে মত কর্মকর্তাদের। তাদের মতে, এনবিআরকে ভাগ করলে কর্তৃত্ব কমবে, প্রশাসনিক জটিলতা বাড়বে এবং কোর কাঠামো ভেঙে পড়বে। অনেকেই এটাকে রাজনৈতিকভাবে একটি প্রতিষ্ঠানকে দুর্বল করার কৌশল হিসেবে দেখেছেন।
এই বিভাজনের বিরুদ্ধে এনবিআর কর্মকর্তা-কর্মচারী ঐক্য পরিষদ কর্মবিরতি, বিক্ষোভ, গণবিবৃতি ও ‘কালো ব্যাজ’ কর্মসূচি পালন করেন। আন্দোলন দমন করতে গিয়ে সরকার এনবিআরের ১৫০ জনেরও বেশি কর্মকর্তাকে ওএসডি করে, অনেককে চাকরিচ্যুত বা জোরপূর্বক অবসর দেয়। শুল্ক ও ভ্যাট বিভাগে ব্যাপক বদলি হয়। এতে প্রশাসনের ভেতরে এক ধরনের আতঙ্ক ও চাপা ক্ষোভ সৃষ্টি হয়।
গণআন্দোলন ও নাগরিক চেতনার জাগরণ
সরকারের বিভিন্ন নীতির বিরোধিতায় শিক্ষার্থী, নাগরিক সমাজ এবং বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠন রাজপথে নেমেছে। জুলাই সনদ ঘোষণার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা একটি নতুন রাজনৈতিক ও সামাজিক দাবির মঞ্চ তৈরি করে। এতে ন্যায্য কর্মসংস্থান, শিক্ষা সংস্কার, দুর্নীতিবিরোধী অভিযান, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, ডিজিটাল অধিকার ও সরকারি স্বচ্ছতা নিয়ে জোরালো দাবি জানানো হয়। এতে ১০ দফা দাবি উত্থাপন করা হয়, যার মধ্যে নির্বাচনের সময় নিরপেক্ষ প্রশাসন, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং রাজনৈতিক দলের আর্থিক স্বচ্ছতা অন্যতম ছিল।
সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই এসব আন্দোলন অনেক ক্ষেত্রেই শান্তিপূর্ণ থাকলেও, সরকারের পক্ষ থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাধ্যমে কিছু জায়গায় দমনপীড়নের অভিযোগ উঠেছে। এর ফলে নাগরিক অধিকার প্রশ্নে এক ধরনের উত্তেজনা ও অবিশ্বাস ছড়িয়ে পড়েছে।সরকার বিরোধীদের দাবির প্রতি শুরুতে উদাসীন থাকলেও আন্দোলনের ব্যাপকতায় কিছু সিদ্ধান্তে পরিবর্তন আনতে বাধ্য হয়।
এক বছরের কাজের ফিরিস্তি
গত বছরের ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত সময়কালে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উল্লেখযোগ্য কার্যক্রম নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা মানসুর হোসেন স্বাক্ষরিত প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ০৮ আগস্ট থেকে বর্তমান পর্যন্ত এক বছরে উপসচিব পদে ১৪১ জন, যুগ্ম সচিব পদে ৪২৪ জন, অতিরিক্ত সচিব পদে ১৪৯ জন, গ্রেড-১ পদে ২৬ জন এবং সচিব/সিনিয়র সচিব পদে ৪৫ জনসহ সর্বমোট ৭৮৫ জন কর্মকর্তাকে নিয়মিত পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়াও, অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের মধ্যে থেকে উপসচিব পদে ০৪ জন, যুগ্ম সচিব পদে ৭২ জন, অতিরিক্ত সচিব পদে ৫২৮ জন, গ্রেড-১ পদে ৪১ জন এবং সচিব পদে ১১৯ জনসহ সর্বমোট ৭৬৪ জন কর্মকর্তাকে ভূতাপেক্ষভাবে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে।
এক বছরে উপসচিব পদের ১৬ জন, যুগ্ম সচিব পদের ১৫ জন, অতিরিক্ত সচিব পদের ৭৫ জন, গ্রেড-১ পদের ৩৪ জন এবং সচিব/সিনিয়র সচিব পদের ২৪ জনসহ সর্বমোট ১৬৪ জন কর্মকর্তা কর্মকাল শেষে স্বাভাবিক অবসরে গেছেন। অতিরিক্ত সচিব পদের ১৯ জন, গ্রেড-১ পদের ০১ জন এবং সচিব/সিনিয়র সচিব পদের ০৯ জনসহ সর্বমোট ২১ জন কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়েছে।
পাশাপশি এক বছরে ০৩টি অধ্যাদেশ প্রণয়ন, ০৩টি বিধিমালা সংশোধন, ০১টি বিশেষ বিধিমালা প্রণয়ন এবং ২২টি নিয়োগ বিধিমালা/প্রবিধানমালা প্রণয়ন/সংশোধনে সুপারিশ করা হয়েছে। এ ছাড়াও এক বছরে ২৪টি বিভাগীয় মামলা করা হয়। পাশাপাশি ৮টি বিভাগীয় মামলা নিষ্পত্তি হয়। এ ছাড়াও ১৬টি বিভাগীয় মামলা চলমান।