ঢাকা শুক্রবার, ০৮ আগস্ট, ২০২৫

প্রত্যাশার চাপ, হাঁটি হাঁটি অগ্রগতি

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ১ বছর

সেলিম আহমেদ
প্রকাশিত: আগস্ট ৮, ২০২৫, ০১:৫২ এএম

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের বছর ঘুরে গেল। ১৬ বছরের ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়েছিল ৩৬ দিনের রক্তক্ষয়ী ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে। এরপর গত বছরের আজকের দিনে নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে দায়িত্ব নেয় বর্তমান সরকার। নানা কারণে সরকারের প্রতি গণমানুষের প্রত্যাশা ছিল অনেক। রাষ্ট্রীয়, প্রশাসনিক ও বিচারব্যবস্থার সংস্কার, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনা, দ্রব্যমূল্যের দাম নিয়ন্ত্রণ, প্রশাসনিক স্বচ্ছতা রক্ষা এবং জনগণের আস্থার জায়গা তৈরি করার পাশাপাশি নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু এবং গ্রহণযোগ্য ত্রয়োদশ সরকার নির্বাচন ছিল এ সরকারের অন্যতম অঙ্গীকার। সরকার গঠনের এক বছরের মাথায় এসে মানুষের এসব প্রত্যাশা কতটা পূরণ হলো সেই প্রশ্ন সামনে এসেছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সিন্ডিকেট ভেঙে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আনা, আইনশৃঙ্খলার উন্নয়ন, অনিয়ম-দুর্নীতি রোধসহ জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সরকার খুব একটা কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারেনি। তবে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার, শান্তি ও স্থিতিশীলতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা, জুলাই হত্যাযজ্ঞের বিচার এবং গণতান্ত্রিক সংস্কারকাজ শুরু করাসহ সরকারের কিছু সাফল্য রয়েছে। সর্বোপরি আগামী সংসদ নির্বাচনের সময়ক্ষণ ঘোষণা করায় জনমনে কিছু স্বস্তি এসেছে। সবমিলিয়ে যেসব সংস্কারকাজ হাতে নিয়েছে তার মধ্যে মৌলিক বিষয়গুলো সংস্কারের পাশাপাশি একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন দিতে পারলে এই সরকারকে মানুষ মনে রাখবে দীর্ঘদিন। 

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে গত বছরের পহেলা জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে আন্দোলনে নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। সেই আন্দোলনকে থামাতে বলপ্রয়োগ শুরু করে তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার। সরকারের এই নিপীড়ন দেখে রাস্তায় নামতে শুরু করেন সাধারণ মানুষও। একপর্যায়ে সেই আন্দোলন রূপ নেয় গণআন্দোলনে। ৩৬ দিনের সেই আন্দোলনের তোপের মুখে ওই বছরের ৩৬ আগস্ট ক্ষমতা থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালান তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জাতিসংঘের প্রতিবেদন অনুযায়ী, জুলাই আন্দোলনে মৃতের সংখ্যা অন্তত ১৪০০। আহত হয়েছেন বিশ হাজারেরও বেশি মানুষ। বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম কোনো আন্দোলনে এত কম সময়ে এত মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। 

শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ৮ আগস্ট অধ্যাপক ড. ইউনূসের নেতৃত্বে দুই ছাত্র প্রতিনিধিসহ শপথ নেয় নতুন অন্তর্বর্তী সরকার। দায়িত্ব নেওয়ার দুই সপ্তাহ পর ২৫ আগস্ট জাতীর উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমরা এমন একটি দেশ গড়তে চাই যেখানে প্রতিটি নাগরিকের মানবাধিকার থাকবে পুরোপুরি সুরক্ষিত। আমাদের লক্ষ্য একটিইÑ উদার, গণতান্ত্রিক, বৈষম্যহীন, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ। 

ওইদিন তিনি ব্যাংকিং খাতে সুশাসন, আগেই বিচার করে ফেলার যে প্রবণতা থেকে বের হওয়া, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও জবাবদিহিতা এবং তথ্যের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত করা, শিক্ষাক্ষেত্রে সংস্কার, জুলাই গণহত্যা স্মৃতি ফাউন্ডেশন, পুলিশ কমিশন গঠন, গণতন্ত্র সুসংহত, কৃষি-স্বাস্থ্য-পরিবেশের উন্নয়ন, ১৫ বছরের দুর্নীতির শ্বেতপত্র প্রণয়ন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কলঙ্কমুক্ত করাসহ একগুচ্ছ পরিকল্পনার কথা জানান। 

ক্ষমতা পাওয়ার এক মাসের মধ্যেই সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, পুলিশ, বিচারবিভাগ, দুর্নীতি দমন ও জনপ্রশাসন সংস্কার সব মিলিয়ে ছয়টি আলাদা কমিশন গঠন করে সরকার। পরবর্তী সময়ে আরও চারটি সংস্কার কমিশন (স্বাস্থ্যবিষয়ক, গণমাধ্যম, শ্রমিক অধিকারিক, নারীবিষয়ক) যুক্ত করা হয়েছিল। এই দশটি কমিশনের কোথায় কী সংস্কার হওয়া প্রয়োজন সেই নিয়ে কাজও শুরু হয়েছিল। এরপর রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত নিয়ে চূড়ান্ত সংস্কারকাজের সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে জানিয়েছিল সরকার কর্তৃপক্ষ। এরইমধ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐক্যমত কমিশনের সংলাপ শেষের পথে। সংলাপ শেষে সব সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে একটি জাতীয় সনদ তৈরি করা হবে বলেও জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে এই সংস্কারকাজ কবে শেষ হবে তা এখনো জানানো হয়নি। 

এদিকে অন্তর্বর্তী সরকারের হিসাব মতে, জুলাই-আগস্টের গণহত্যায় বেশির ভাগ মানুষই গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন। এই নিয়ে ১৭৩০ মামলা করা হয়েছে। পুলিশ সদস্যদের পাশাপাশি অভিযুক্ত করা হয়েছে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের একাধিক নেতাকর্মীদের। এ ছাড়াও আওয়ামী লীগের অনুসারী বিভিন্ন পেশাজীবী, আমলাদেরও এসব মামলায় আসামি করা হয়েছে। অভিযুক্ত অনেকের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও জারি করা হয়েছে। মামালাগুলোর বিচার শুরু হয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। ট্রাইব্যুনালের প্রধান কৌঁসুলির কার্যালয়, আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের কাছে অনুরোধ জানিয়েছে, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তারের রেড অ্যালার্ট জারির জন্য।

সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নানা সীমাবদ্ধতা, প্রতিকূল পরিবেশে অন্তর্বর্তী সরকারের নানা অর্জনের মধ্যে অপ্রাপ্তির সংখ্যা কম। আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে সরকার খুব একটা কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারেনি। এখনো দেশের বিভিন্ন স্থানে গুম-খুন, নির্যাতন, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, ছিনতাই অহরহ হচ্ছে। বিশেষ করে অভ্যুত্থানের পরবর্তী সময়ে যে মব সংস্কৃতির উদয় হয়েছিল তা বন্ধ করতে পারেনি সরকার। আইনশৃঙ্খলার উন্নতি করতে না পারার পাশাপাশি সরকার সিন্ডিকেট ভেঙে দ্রবমূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে খুব একটা কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারেনি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে এখনো কিছু চক্র দুর্নীতিতে সক্রিয়। শিল্প খাতে বিদেশি বিনিয়োগে আশানুরূপ গতি আনতে না পারার পাশাপাশি দেড় দশকের লুটপাটের পরও ব্যাংকগুলোকে সরকার সচল রাখতে পেরেছে, কিন্তু কাঠামোগত সংস্কারে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ এখনো নিতে পারেনি। 

এ ছাড়াও ফ্যাসিবাদী শাসন যাতে বারবার ফিরে আসতে না পারে তার জন্য শাসন ব্যবস্থায় কার্যকর কিছু পরিবর্তন করার দাবি ছিল সব মহলেই। কিন্তু এখনো প্রশাসনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ফ্যাসিবাদের দোসররা রয়ে গেছেন বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের। স্বাস্থ্য খাতে সংস্কারের জন্য সরকার উদ্যোগ নিলেও শিক্ষা খাতে সংস্কারের কোনো উদ্যোগ ছিল না সরকারের। প্রাথমিক শিক্ষা সংস্কারের জন্য একটি কমিটি করলেও উচ্চ শিক্ষা নিয়ে ছিল না কোনো চিন্তা। ফলে গতানুগতিক শিক্ষা ধারা থেকে বের হতে না পারলেও দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। 

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. আবদুস সালাম তার বক্তব্যে বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থান অনেক স্বপ্নের বীজ বপন করেছিল। তারমধ্যে অন্যতম একটি ছিল শিক্ষার মানোন্নয়ন করা। কিন্তু দুঃখের বিষয় বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার সেই শিক্ষা সংস্কার কমিশন গঠন করতে ব্যর্থ হয়েছে। আমরা আশা রেখেছিলাম নতুন একটা শিক্ষানীতি প্রণয়ন হবে, কিন্তু তারা সেখানে এখন পর্যন্ত হাত দেয়নি। সর্বশেষ যে বাজেট হয়েছিল সেখানে শিক্ষার বাজেট বৃদ্ধি করা হয়নি। এত স্বল্প বাজেট দিয়ে শিক্ষার মান কখনো বৃদ্ধি করা সম্ভব না। এমনকি শিক্ষকদের মর্যাদার বিষয়ে অনেকদিন থেকে আমরা ফাইট করছি। শিক্ষকদের পরিপূর্ণ মর্যাদা ছাড়া শিক্ষার মান উন্নয়ন কল্পনা করা যায় না।

অন্যদিকে সরকার দায়িত্ব নেওয়ার ১২ মাসে দেশে শান্তি ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা, ধ্বংসপ্রাপ্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধার, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সফল শুল্ক আলোচনা সম্পন্ন করা, ঐতিহাসিক জুলাই সনদ চূড়ান্ত করাসহ অন্তর্বর্তী সরকারের ১২টি বড় সাফল্যের তথ্য জানান প্রধান উপদেষ্টার প্রেসসচিব শফিকুল আলম। গতকাল বৃহস্পতিবার নিজের ফেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এক পোস্টে তিনি সাফল্যের বিষয়গুলো উল্লেখ করেন। এই সাফল্যগুলো হলোÑ শান্তি ও স্থিতিশীলতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা, অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার, বাণিজ্য ও বিনিয়োগে অগ্রগতি, গণতান্ত্রিক সংস্কার ও জুলাই সনদ, জুলাই হত্যাযজ্ঞের বিচার, নির্বাচন পরিকল্পনা ও সংস্কার, প্রাতিষ্ঠানিক ও আইনগত সংস্কার, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও ইন্টারনেট অধিকার, পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তন, প্রবাসী ও শ্রমিক অধিকার, শহিদ ও আহত বিপ্লবীদের সহায়তা ও সামুদ্রিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন। 

সার্বিক বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, গণঅভ্যুত্থানের প্রধান সফলতা হলো আমরা একটি কর্তৃত্ববাদী সরকারকে হটাতে পেরেছি। গণতন্ত্রে উত্তরণের জন্য এটি সহায়ক হবে। আরেকটি বড় ব্যাপার হলো রাষ্ট্রে জবাবদিহিমূলক সরকার তৈরির জন্য কিছু সংস্কার প্রয়োজন। সেগুলোর ব্যাপারে সংস্কার কমিশনগুলোর মাধ্যমে এখন আলোচনা করতে পারছি। ‘রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে পরিবর্তন দরকার, সংস্কার আনা দরকার, সেটাও আমরা এখন বুঝতে পারছি। এটি কিন্তু আলোচনায় আছে, রাজনৈতিক দলগুলো অনেক বিষয়ে একমত হয়েছে। এই যে ঐকমত্য এবং আমরা যে এটাকে মেনে নিতে পারি, সংস্কার আমাদের প্রয়োজনÑ এটা কিন্তু আমাদের একটি অগ্রগতি, যা আগে ছিল না।’ 

তিনি আরও বলেন, জুলাই বিপ্লবে যারা কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে, যারা আহত হয়েছে, শহীদ হয়েছে, তাদের সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে সঠিক সম্মান করা এবং হাসপাতালে যারা চিকিৎসাধীন ছিল বা এখনো আছে, তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করাÑ এসব নানা ক্ষেত্রে প্রত্যাশিত সিদ্ধান্ত ও নীতিমালা গ্রহণ করা হয়নি। এটি এই সরকারের ব্যর্থতা।

অর্থনীতিবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহ বলেন, এ মুহূর্তে সবচেয়ে বড় সংস্কার হচ্ছে নির্বাচন। নির্বাচন হলে হয়তো অনেক কাজকর্ম করা যাবে। দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে, আমলাতন্ত্রে কোনো পরিবর্তন আসেনি, পুলিশবাহিনীতে কোনো পরিবর্তন আসেনি, অনেক জায়গায় কোনো পরিবর্তন আসেনি। এ পরিবর্তন ছাড়া খুব একটা এগোনো যাবে না। নির্বাচিত সরকারও কতদূর সেটা পারবে, এ নিয়েও আমার সন্দেহ আছে। কারণ, গত ১৬ বছরে ফ্যাসিস্ট হাসিনা সেই কাঠামো তৈরি করে গেছে, তা উচ্ছেদ করা এবং সেখানে একটা নতুন কিছু দিয়ে পুনঃস্থাপন করা মোটেও সহজ কাজ না।