অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর স্বাস্থ্য খাতের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাঁড়ায় জুলাই আন্দোলনে আহতদের যথাযথ চিকিৎসা নিশ্চিত করা।
এ বিষয়ে সর্বোচ্চ চেষ্টার পরও অনেকটাই ব্যর্থতার চিত্র ফুটে ওঠে বছরজুড়ে। কারণ সুচিকিৎসার দাবিতে বছরের বিভিন্ন সময় রাজপথে আন্দোলন করেন আহতরা।
অনেকে আবার বিদেশে চিকিৎসা নেওয়ার জন্যও সরকারকে চাপ দিতে থাকেন। এতে করে সরকার আর আহতদের মধ্যে বৈরী সম্পর্ক তৈরি হয়। যদিও সরকার গুরুতর আহতদের জন্য বিদেশ থেকে চিকিৎসক আনা থেকে শুরু করে বিদেশে পাঠিয়ে চিকিৎসা করানোরও ব্যবস্থা করে। কিন্তু সরকারের বর্ষপূর্তির কিছুদিন আগেও রাজপথ সরব ছিল আন্দোলনে আহতদের বিক্ষোভে। শুধু তাই নয়, এই সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বাস্তবায়ন হয়নি একটিও অপারেশন প্ল্যান। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির জন্য মোট বরাদ্দের মাত্র ২ শতাংশ খরচ করতে সক্ষম হয় সরকার। যা এর আগে কখনো স্বাস্থ্য খাতে হয়নি। সর্বশেষ মাইলস্টোন দুর্ঘটনায় আহতদের চিকিৎসাও সরকারের সামনে আরেকটি চ্যালেঞ্জ দাঁড় করায়। এসব বিষয় নিয়ে বছরের পুরোটা সময়েই নীরব ভূমিকায় ছিলেন খাতটিতে নিয়োজিত উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম। তবে সরকারের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে বেশকিছু পরিকল্পনার কথা তিনি জানিয়েছেন।
সরকারি গেজেট অনুযায়ী, জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে এখন পর্যন্ত শহিদ হয়েছেন ৮৩৬ জন। তবে শহিদের সংখ্যা আরও বেশি। এক রায়েরবাজার কবরস্থানে বেওয়ারিশ ১১৪ জনকে গণকবর দেওয়া হয়েছে। রাজধানীর বাইরে সাভার, টঙ্গী, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রামে আরও বেশ কয়েকজন শহিদকে বেওয়ারিশ হিসেবে আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলাম দাফন করেছে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত জাতিসংঘ মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের (ওএইচসিএইচআর) ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং রিপোর্টে বলা হয়, জুলাই-আগস্ট সংঘটিত ঘটনায় ১ হাজার ৪০০ জনকে নির্বিচারে হত্যা করা হয়। এর মধ্যে ১১৮ জনই শিশু। জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে সারা দেশে অন্তত ১৪ হাজার ব্যক্তি আহত হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমের (এমআইএস) মতে, আহত ১৩ হাজার ৮১১ জন। তবে ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থানের শহিদ পরিবার এবং জুলাই যোদ্ধাদের কল্যাণ ও পুনর্বাসন অধ্যাদেশ, ২০২৫’-এ বলা হয়েছে, আহত হয়েছে ১২ হাজার ৮৮৭ জন। এ ছাড়া, রায়েরবাজার কবরস্থানে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম গত বছরের ২২ জুলাই থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত ১১৪টি বেওয়ারিশ লাশ দাফন করেছে।
আহতদের ঢাকা সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল (সিএমএইচ) জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট, জাতীয় অর্থপেডিক্স ও পুনর্বাসন হাসপাতাল (পঙ্গু হাসপাতাল), ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, শহিদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় নিউরোসায়েন্স ইনস্টিটিউট ও জাতীয় নাক-কান-গলা ইনস্টিটিউটে আহতদের চিকিৎসা দেওয়া হলেও এখনো কিছুসংখ্যক আহত বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি রয়েছে। জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে আহত ১ হাজার ৪০১ জনকে ‘জুলাই যোদ্ধা’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে গেজেট প্রকাশ করে সরকার। তাদের বেশির ভাগই বিদেশে গিয়ে সুচিকিৎসা নিশ্চিতসহ পুনর্বাসনের জন্য বছরের বিভিন্ন সময় প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ কর্মসূচি করেন। সবচেয়ে আলোচিত ছিল চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে চিকিৎসারত আহতদের বিক্ষোভ কর্মসূচি। আন্দোলনের একপর্যায়ে তারা হাসপাতালটি নিজেদের দখলে পর্যন্ত নিয়ে নেয়। হাসপাতাল থেকে সাধারণ রোগীসহ চিকিৎসকরাও চলে যেতে বাধ্য হন। সম্প্রতি আবার মাইলস্টোন দুর্ঘটনায় আহতদের বেশির ভাগেরই চিকিৎসা দেওয়া হয় রাজধানীর জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে। সরকারের বিভিন্ন উপদেষ্টারা আহতদের পাশে দাঁড়ালেও নীরব ভূমিকায় ছিলেন স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম।
তবে অন্তর্বর্তী সরকারের বর্ষপূতিতে তিনি এক সংবাদ সম্মেলনে নানা বিষয়ে কথা বলেন। গতকাল বৃহস্পতিবার আয়োজিত ওই সংবাদ সম্মেলনে অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছরে স্বাস্থ্য খাতের সাফল্য, চ্যালেঞ্জ এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা তুলে ধরেন স্বাস্থ্য উপদেষ্টা।
সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনে আহতদের চিকিৎসায় সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে দাবি করে নূরজাহান বেগম বলেন, আন্দোলনে আহতদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করা এবং শহিদ পরিবারের পাশে দাঁড়ানো ছিল অন্তর্বর্তী সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। ২০২৪ সালের আগস্টে ১৩ সদস্যবিশিষ্ট একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি গঠন করা হয়। যার মাধ্যমে ১৪ হাজারের বেশি আহতদের তালিকা তৈরি এবং যাচাই-বাছাই করে ১২ হাজার ৪২ জনকে সরকারি গেজেটভুক্ত করা হয়। এদের সবাইকে সরকারি হাসপাতালে সম্পূর্ণ বিনা মূল্যে চিকিৎসা প্রদান করা হয়েছে। পাশাপাশি বিদেশে উন্নত চিকিৎসার জন্য এখন পর্যন্ত ৭৮ জন আহতকে থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর ও রাশিয়ায় পাঠানো হয়েছে। আরও অনেকের বিদেশে চিকিৎসার প্রক্রিয়া চলমান।
নূরজাহান বেগম বলেন, বিশ্বের সাতটি দেশ থেকে ২৬ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বাংলাদেশে এসেছেন আন্দোলনে আহতদের চিকিৎসায় সহায়তা করতে। ইউকে, নেপাল, চীন, সিঙ্গাপুর, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও থাইল্যান্ডের এই চিকিৎসকরা চোখ, অঙ্গহানি ও স্পাইনাল ইনজুরির মতো জটিল ক্ষেত্রে অপারেশন সম্পন্ন করেছেন। নেপালের সহায়তায় আনা হয়েছে ৪০টি কর্নিয়া টিস্যু, যার মধ্যে ইতোমধ্যে ২ জনের কর্নিয়া ট্রান্সপ্লান্ট সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। তিনি জানান, চীনের সহযোগিতায় বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু করা হয়েছে দেশের প্রথম রোবটিক ফিজিওথেরাপি সেন্টার, যেখানে প্রতিদিন ৩০০ রোগী চিকিৎসা নিতে পারবেন। এখানে ৬২টি উন্নত রোবটিক ইউনিট রয়েছে যার মধ্যে ২২টি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) দিয়ে পরিচালিত। এই সেবা শুধু আহতদের জন্য নয় বরং ভবিষ্যতে সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে।
তিনি আরও জানান, সরকার স্বাস্থ্য খাতের প্রশাসনিক কাঠামো ঢেলে সাজিয়েছে। মহাপরিচালক, বিভাগীয় পরিচালক, সিভিল সার্জন, মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ-উপাধ্যক্ষ ও ইনস্টিটিউট পরিচালকের পদায়ন পুনর্গঠন করা হয়েছে। সুপার নিউমারারি পদ সৃষ্টি করে ৭ হাজার চিকিৎসককে পদোন্নতি প্রদান করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে ৮৬টি বিষয়ে ৮০০ জন চিকিৎসক অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পেয়েছেন। চিকিৎসক সংকট নিরসনে ৪৮তম বিশেষ বিসিএসের মাধ্যমে ৩ হাজার চিকিৎসক নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে। এ ছাড়া আরও সাড়ে ৩ হাজার চিকিৎসক নিয়োগ কার্যক্রমও চলমান। নূরজাহান বেগম জানান, ৩ হাজার ৫১২ জন সিনিয়র স্টাফ নার্সের নিয়োগ সম্পন্ন হয়েছে এবং পদায়ন প্রক্রিয়াধীন। পাশাপাশি ৫ হাজার নার্স ও ৪ হাজার মিডওয়াইফের জন্য পদ সৃষ্টির প্রস্তাব অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।
এ সময় তিনি স্বাস্থ্য খাতে টেকসই সংস্কার আনতে নতুন আইন ও নীতিমালা অত্যন্ত জরুরি উল্লেখ করে বলেন, ‘মানবদেহে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন অধ্যাদেশ, ২০২৫’ উপদেষ্টা সভার অনুমোদন পেরিয়ে আইন মন্ত্রণালয়ে ভেটিংয়ের জন্য পাঠানো হয়েছে। গত ২১ জুলাই মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য সরকার জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে হটলাইন, আউটডোর সাইকিয়াট্রিক সেল ও আউটরিচ প্রোগ্রাম চালু করেছে। ইতিমধ্যে অনেকে সরাসরি ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন। চিকিৎসায় সহায়তা করছে সিঙ্গাপুর, ভারত, চীন ও যুক্তরাজ্যের বিশেষজ্ঞ দল। নূরজাহান বেগম বলেন, বিপুল সীমাবদ্ধতার মধ্যেও আমরা চেষ্টা করেছি মানুষের পাশে দাঁড়াতে। যা করেছি সেটা দায়িত্ববোধ থেকেই। তবে এসব বক্তব্যকে অনেকটাই ফাঁকা বুলি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ লেনিন চৌধুরী রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, যে উপদেষ্টা গত এক বছরে স্বাস্থ্য খাতের মোট প্রকল্পের মাত্র ৩৭ দশমিক ১ শতাংশ বাস্তবায়িত করতে পেরেছেন, সেখানে নির্বাচনের আগ মুহূর্তে বর্ষপূর্তির এ সময় এতসব বিশ্লেষণ অযাচিত। বিশেষত স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের প্রকল্প বাস্তবায়ন হতাশাজনকভাবে নেমে এসেছে ১৫ দশমিক ৩৬ শতাংশে। গত অর্থবছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ ছিল ১৬ হাজার ৮৯ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। এডিপির বাজেট বরাদ্দ দেওয়া হয়, বিভিন্ন হাসপাতাল, ক্লিনিক নির্মাণ, সিটিস্ক্যান, এমআরআই মেশিনসহ সব ধরনের চিকিৎসা সরঞ্জাম কেনার জন্য। কিন্তু গত অর্থবছরে ব্যয় হয়েছে মাত্র ১ হাজার ৫৯৪ কোটি ১৯ লাখ টাকা। ফলে ১৪ হাজার ৪৯৫ কোটি ৪৬ লাখ টাকা খরচ করতে পারেনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এই দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণে প্রতিবছর ৮ লাখ রোগী উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। চিকিৎসা খাতে দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা এতটাই প্রকট যে, সরকারি সেবা নিতে গিয়ে ৪৮.৭ শতাংশ পরিবার দুর্নীতির শিকার হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। তা ছাড়া স্বাস্থ্য খাতে ব্যয়ের ৭৩ শতাংশ জনগণকে নিজেই বহন করতে হয়, যা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও কার্যকর পরিকল্পনা ছাড়া এ খাতে উন্নয়ন সম্ভব নয় বলে মত তার।