ঢাকা শনিবার, ১৬ আগস্ট, ২০২৫

বাংলাদেশে বিপ্লবের এক বছর পর আশা হতাশায় পরিণত

রূপালী প্রতিবেদক
প্রকাশিত: আগস্ট ১৫, ২০২৫, ১১:৩৭ পিএম

এক বছর আগে বাংলাদেশে তীব্র ছাত্র আন্দোলন ও গণঅভ্যুত্থানের ঢেউ স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার দীর্ঘ ১৫ বছরের শাসনের পতন ঘটায়। সেই সময় রংপুর শহরে সশস্ত্র পুলিশের সামনে হাত প্রসারিত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকা আবু সাঈদের ছবি সারা দেশে প্রতিরোধের প্রতীক হয়ে ওঠে। মুহূর্তের মধ্যে পুলিশের গুলিতে তিনি আহত হন, পরে শহিদ হন। প্রায় ১ হাজার ৪০০ প্রাণহানি মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন তিনি।

এই আন্দোলনের মাধ্যমে শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান। দেশ তখন অরাজকতার চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছালেও মানুষের মনে ছিল এক নতুন আশার আলো। ছাত্ররা ঘোষণা দিয়েছিলেনÑ তারা গড়বেন বৈষম্যহীন, দুর্নীতিমুক্ত এক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ। এই প্রত্যাশা থেকেই তারা নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব দেন।

কিন্তু এক বছর পেরিয়ে গেলেও মানুষের মধ্যে হতাশার সুর স্পষ্ট হয়ে উঠছে। নিহত আবু সাঈদের বড় ভাই রমজান আলী বলেন, ‘আমরা ভেবেছিলাম দেশ নৈতিকভাবে উন্নত হবে, বৈষম্য দূর হবে, সুষ্ঠু নির্বাচন হবে, হত্যাকারীরা শাস্তি পাবে। কিন্তু এখনো সেসব বাস্তব হয়নি।’ তার মতে, ড. ইউনূস না থাকলে হয়তো পরিস্থিতি আরও খারাপ হতো।

অস্থায়ী সরকারের চ্যালেঞ্জ ও সংস্কার উদ্যোগ :

ড. ইউনূস দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথম লক্ষ্য স্থির করেন আইনশৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা। বিপ্লব-পরবর্তী লুটপাট, দাঙ্গা এবং সংখ্যালঘুদের ওপর হামলায় দেশ ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছিল। যদিও কিছুটা স্থিতিশীলতা ফিরেছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো অভিযোগ করছেÑ সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায় ও শেখ হাসিনার সমর্থকদের ওপর সহিংসতা ঠেকাতে সরকার যথেষ্ট পদক্ষেপ নেয়নি। একই সঙ্গে ইসলামি উগ্রবাদীদের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টাও বেড়েছে।

সংস্কারের অংশ হিসেবে অন্তর্বর্তী সরকার ১১টি কমিশন গঠন করে নির্বাচনব্যবস্থা, বিচারব্যবস্থা, পুলিশ সংস্কারসহ বিভিন্ন খাতে প্রস্তাব দিতে। তবে এই সংস্কারের অল্প কিছুই বাস্তবায়িত হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আহত শিক্ষার্থী আব্দুল্লাহ সালেহীন অয়ন বলেন, সবকিছু যেন বিশৃঙ্খল মনে হচ্ছে। আমাদের স্বপ্নগুলো পূরণ হয়নি। আন্দোলনের প্রেরণাও এখন ফিকে হয়ে আসছে।

নির্বাচন ঘিরে টানাপোড়েন :

ড. ইউনূস ঘোষণা দিয়েছেন, পুনর্গঠিত ভোটিং সিস্টেমের অধীনে আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এখনো মতবিরোধ রয়েই গেছে। বিএনপি দাবি করছে, অন্তর্বর্তী সরকারের কাজ শুধু মুক্ত ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনেই সীমিত থাকা উচিত। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী ও আরও কিছু দল বলছে, নির্বাচনের আগে ব্যাপক সংস্কার জরুরি।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ জানিয়েছেন, প্রায় ৩০টি রাজনৈতিক দল দুই মাস ধরে আলোচনায় বসেছে। স্বাধীন বিচারব্যবস্থা ও প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদসীমার মতো বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে। এটি কিছুটা হলেও আশাব্যঞ্জক অগ্রগতি।

পুরোনো দ্বন্দ্ব, নতুন প্রজন্মের প্রশ্ন :

বাংলাদেশের রাজনীতি স্বাধীনতার পর থেকেই দুই বংশপরম্পরার প্রভাবাধীনÑ শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগ ও জিয়াউর রহমানের বিএনপি। ২০২৪ সালের জানুয়ারির নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি, তারা সেটিকে জালিয়াতিপূর্ণ আখ্যা দেয়। কিন্তু এবার নির্বাচন হবে আওয়ামী লীগ ছাড়া, যেহেতু তাদের কার্যক্রম নিষিদ্ধ।

নতুন রাজনৈতিক দলগুলো মাঠে সক্রিয় হয়েছে। ছাত্র আন্দোলনের নেতা নাহিদ ইসলাম গঠন করেছেন জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), যারা দেশব্যাপী পদযাত্রা করে তরুণদের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করছে। বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর গড় বয়স ২৬ হওয়ায় তরুণ ভোটাররা আগামী নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবেন।

চলচ্চিত্র নির্মাতা সাঈদ খান সাগর বলেন, ‘আমরা এই প্রজন্ম গণতন্ত্রকে ভালোভাবে বুঝি না, কারণ কখনো দেখিনি। রাষ্ট্রের দায়িত্ব হবে ভয়হীন সমাজ গড়া। অন্যদিকে বাংলাদেশি-আমেরিকান থাহিতুন মারিয়াম আশঙ্কা প্রকাশ করেন, নারীদের অধিকার এখনো উপেক্ষিত হতে পারে।

মানবাধিকার ও ন্যায়বিচার প্রশ্নে বিতর্ক :

গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের প্রথম বার্ষিকীতে রাজধানীতে হাজারো মানুষ ইউনূসের ভাষণ শুনতে জমায়েত হয়। তিনি ঘোষণা দেন, নিহত আন্দোলনকারীদের জাতীয় নায়ক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হবে এবং শহিদ পরিবার ও আহতদের আইনি সুরক্ষা দেওয়া হবে।

তবু ক্ষোভ থামছে না। বিশেষত, আবু সাঈদ হত্যার মতো মামলায় অগ্রগতি নেই। তার ভাই রমজান আলী অভিযোগ করেছেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা হলেও তা কার্যত অচল হয়ে আছে। আদালত অনুপস্থিত অবস্থায় শেখ হাসিনার বিচার চালাচ্ছেন। শেখ হাসিনা ভারত থেকে এক বিবৃতিতে ছাত্র আন্দোলনকে ‘সহিংস ব্যাঘাত’ আখ্যা দিয়েছেন।

মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ অভিযোগ করেছে, নতুন সরকার নিরাপত্তাব্যবস্থা ও রাজনৈতিক প্রতিশোধের দিকেই বেশি মনোযোগ দিচ্ছে, নাগরিক অধিকার রক্ষায় নয়।

অর্থনৈতিক ধীরগতি ও সাধারণ মানুষের হতাশা :

গণঅভ্যুত্থানের পর অর্থনীতি ধীরগতিতে চলছে। বিশ্বব্যাংকের তথ্য বলছে, প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ৮ শতাংশ থেকে নেমে ৪ দশমিক ২ শতাংশে এসেছে। এতে মানুষের দৈনন্দিন জীবনে প্রভাব পড়ছে। ঢাকার যন্ত্রপাতি মেরামতের দোকানদার আবদুল কাদের জানান, তার আয়ে ১০ শতাংশ হ্রাস ঘটেছে। তিনি বলেন, মানুষের হাতে টাকা নেই, আর যারা আছে তারাও খরচ করছেন না।

এক বছর পর বাংলাদেশ অর্ধেক পথে :

এক বছর পর বাংলাদেশ দাঁড়িয়ে আছে এক সন্ধিক্ষণে। শেখ হাসিনার পতনের মাধ্যমে গণতন্ত্রের নতুন অধ্যায় শুরু হলেও সংস্কারের ধীরগতি, ন্যায়বিচারহীনতা ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা মানুষের মনে প্রশ্ন জাগাচ্ছেÑ আবু সাঈদের মতো শহিদদের ত্যাগ কি বৃথা হয়ে যাবে?

ড. ইউনূসের সরকার এখনো নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবে বাস্তবতা হলো, দেশ এখনো বিভক্ত, সংস্কার অসম্পূর্ণ এবং ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত।