- বন্দির সংখ্যা ধারণক্ষমতার তুলনায় বেশি ৩১ হাজার
- অতিরিক্ত ১,৫০০ পদে নিয়োগের উদ্যোগ
- জনবল সংকটে নির্বাচনকালীন সহিংসতা ও নিরাপত্তার সংকট
- মোবাইল ফোন, মাদকসহ অবৈধ সামগ্রী প্রবেশ দীর্ঘদিনের সমস্যা
- অতীতেও নির্বাচনের আগে নিরাপত্তা জোরদারের নজির রয়েছে
- গোয়েন্দা নজরদারি ও দুর্নীতি প্রতিরোধে সমন্বিত উদ্যোগ দরকার : কারা কর্তৃপক্ষ
আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে দেশের কারাগারে নিরাপত্তা ও প্রশাসনিক কার্যক্রমে স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সরকার ও কারা অধিদপ্তর অতিরিক্ত জনবল নিয়োগের প্রস্তুতি নিচ্ছে। ২০২৪ সালের জুলাই মাসে কারাগারে একাধিক সহিংস হামলা এবং পালানোর বিষয়ে প্রশাসনকে আবারও সতর্ক করা হয়েছে। বন্দির অস্বাভাবিক চাপ, নিরাপত্তা ব্যবস্থার দুর্বলতা এবং জনবল সংকট মোকাবিলায় নতুন মাত্রায় নিরাপত্তা জোরদারের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে গঠন করা হয়েছে পরিকল্পনা। নিরাপত্তা ও সংস্কারের দুই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কারা অধিদপ্তর অতিরিক্ত এক হাজার ৫০০ জনবল নিয়োগের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে অর্থ মন্ত্রণালয়ে অনুমোদনের আবেদন করেছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগ ও কারা অধিদপ্তর সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
কারা প্রশাসন মনে করছে, সময়মতো জনবল না বাড়ানো হলে নির্বাচনকালীন সহিংসতা ও নিরাপত্তা সংকট মোকাবিলা করা কঠিন হয়ে পড়বে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, বর্তমানে কারা অধিদপ্তরের আওতায় ৭৫ হাজার বন্দি রয়েছে (২৯ জুলাই পর্যন্ত হিসাব), যা ধারণক্ষমতা ৪৩,১৫৭ জনের চেয়ে প্রায় ৩১,৮৪৩ জন বেশি। এই অস্বাভাবিক চাপের কারণে দৈনন্দিন কারা কার্যক্রম ও নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। বিশেষ করে ২০২৪ সালের জুলাই মাসে ঘটে যাওয়া পরিস্থিতিÑ যখন একাধিক কারাগারে হামলা, অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুটপাট এবং বন্দি পলায়নের মতো ঘটনা ঘটেছিল। এখনো প্রশাসনের জন্য হুমকি হয়ে রয়েছে।
কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মো. মোতাহের হোসেন প্রেরিত চিঠিতে বলা হয়েছে, সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচন ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সমুন্নত রাখতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অনুমোদিত ৬,১৬৪ জনবলের মধ্যে অন্তত আরও ১,৫০০ জনবল দ্রুত নিয়োগ করা প্রয়োজন।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের উপসচিব মো. হাফিজ আল আসাদ স্বাক্ষরিত অফিস আদেশে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগকে এই বিষয়ে সম্মতি প্রদানের অনুরোধ জানানো হয়েছে। যার একটি অনুলিপি রূপালী বাংলাদেশের হাতে এসেছে।
নির্বাচনকালীন নিরাপত্তা ঝুঁকি :
প্রস্তাবে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, বিশেষ ধরনের বন্দির সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় বিদ্যমান জনবল দিয়ে নিরাপদ কারা ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে পড়েছে। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সন্ত্রাসী, দুর্ধর্ষ আসামি ও রাজনৈতিক সহিংসতায় গ্রেপ্তার বন্দির সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
২০২৪ সালের জুলাই মাসের মতো সহিংসতা এড়াতে এবং বিশেষ বন্দিদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দ্রুত জনবল বৃদ্ধি অপরিহার্য বলে বলেছে কারা কর্তৃপক্ষ।
জাতীয় নির্বাচনের আগে কারাগারের নিরাপত্তার ইতিহাস :
বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচনের আগে কারাগারগুলোতে নিরাপত্তা জোরদারের একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট রয়েছে। ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে উচ্চপ্রোফাইল কয়েদিদের পালানোর আশঙ্কায় কারাগারের ভেতরে সেনা মোতায়েনের নজির আছে। ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে সামরিক সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার সব কেন্দ্রীয় কারাগারে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ায় এবং রাজনৈতিক বন্দিদের আলাদা সেলে রাখে। ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে একাধিক কারাগারে সিসিটিভি ক্যামেরা, উন্নত স্ক্যানিং মেশিন ও অতিরিক্ত রক্ষী নিয়োগ দেওয়া হয়। এই প্রবণতা থেকে বোঝা যায়, নির্বাচনের সময় রাজনৈতিক সহিংসতা, বন্দিদের রাজনৈতিক সংযোগ এবং বাহ্যিক হামলার আশঙ্কা সব সময় কারা কর্তৃপক্ষকে বাড়তি সতর্কতা নিতে বাধ্য করেছে।
নিরাপত্তা জোরদারের প্রয়োজনীয়তা :
জুলাই মাসের হামলাগুলো প্রমাণ করেছে যে, কারাগারের নিরাপত্তা কেবল ভৌত অবকাঠামোর ওপর নির্ভর করলে চলবে না। গোয়েন্দা নজরদারি, প্রযুক্তি ব্যবহার এবং দুর্নীতি রোধের সমন্বিত পদক্ষেপ জরুরি। অতীতে যেমন নির্বাচনের আগে সাময়িক নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছিল, এবারও তা হতে পারে, তবে দীর্ঘমেয়াদে একটি স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক কারা ব্যবস্থাপনা ছাড়া স্থায়ী সমাধান সম্ভব নয়।
নিরাপত্তা ও সংস্কার-দুই চ্যালেঞ্জ :
সরকার দেশের সব কারাগারকে আধুনিক সংশোধনাগারে রূপান্তরের লক্ষ্য ঘোষণা করেছে। এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে কারাগার সংস্কার, অবকাঠামো উন্নয়ন, প্রযুক্তি ব্যবহার এবং বন্দিদের পুনর্বাসন কর্মসূচি জোরদারের পাশাপাশি জনবল বৃদ্ধির বিষয়টিও অগ্রাধিকার তালিকায় রয়েছে। কিন্তু বাস্তবতায় দেখা যাচ্ছে, প্রশাসনিক জনবল ও নিরাপত্তাকর্মীর তীব্র সংকট দীর্ঘদিন ধরে চলছে। এর ফলে বন্দিদের নিরাপদভাবে আটক রাখা, উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ আসামিদের জন্য বিশেষ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, নিয়মিত পুনর্বাসনমূলক প্রশিক্ষণ পরিচালনা এবং কারাগারের দৈনন্দিন প্রশাসনিক কার্যক্রমÑ সবই মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
বর্তমানে অনেক কারাগারে অনুমোদিত জনবলের তুলনায় কার্যকর কর্মী সংখ্যা অর্ধেক বা তারও কম, যা অতিরিক্ত ভিড় ও চাপের মধ্যে থাকা এই প্রতিষ্ঠানের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে নির্বাচন-পূর্ব উত্তেজনাপূর্ণ সময়ে রাজনৈতিক মামলায় নতুন আসামি যুক্ত হওয়ায় কারাগারের ওপর চাপ আরও বেড়ে যায়। নিরাপত্তার ঘাটতি শুধু সহিংসতা বা অরাজকতার ঝুঁকি বাড়ায় না, বরং বন্দিদের পুনর্বাসন কার্যক্রমের সাফল্যকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে। এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় নিরাপত্তা জোরদার ও সংস্কার কার্যক্রম সমান গুরুত্ব দিয়ে বাস্তবায়ন করাই এখন সংশ্লিষ্টদের দাবি।
৬১৬৪ জনবল অনুমোদন, কিন্তু ৫ বছরে ধাপে ধাপে নিয়োগ : জানা গেছে, কারা অধিদপ্তর ১৪,২২৭ জনবল সৃজনের প্রস্তাব দিলে সুরক্ষা সেবা বিভাগ ১০,৮৫৬ জনবল অনুমোদনের জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। পরে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় তিন ধাপে ৬,১৬৪ জনবল সৃজন ও ৬৪টি পদ বিলুপ্তির অনুমোদন দেয়। কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয় রাজস্ব খাতে কেবল ১,৮৯৯ জনবল (২০২৪-২০২৯ অর্থবছর পর্যন্ত ৫ ধাপে) নিয়োগের অনুমোদন দেয়।
প্রকল্প অনুযায়ী নতুন অনুমোদিত ২টি কেন্দ্রীয় কারাগার, ৪টি জেলা কারাগার, একটি কারা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এবং একটি হসপিটালাইজড প্রিজনার্স সিকিউরিটি ইউনিট কার্যক্রম শুরু করলেও, ধাপে ধাপে জনবল নিয়োগের ফলে পদবিন্যাসে ভারসাম্য আসছে না। এর ফলে নিরাপত্তা বিঘিœত হওয়ার পাশাপাশি প্রশাসনিক কাজেও গতি আসছে না।
সহিংসতা ও নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জের গভীরতা :
২০২৪ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশের বিভিন্ন কারাগারে সংঘটিত একাধিক সহিংস ঘটনায় দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও কারা ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা নিয়ে নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে ঢাকার কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগার, চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার এবং কুমিল্লা কারাগারে সংঘটিত হামলা ও ধস্তাধস্তির ঘটনায় নিরাপত্তা ব্যবস্থার ফাঁকফোকর স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এই ঘটনাগুলো কেবল তাৎক্ষণিক উত্তেজনার ফল নয়, বরং দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা প্রশাসনিক অব্যবস্থা, গোয়েন্দা সতর্কবার্তা উপেক্ষা এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রভাবে সৃষ্ট এক জটিল সংকটের প্রতিফলন।
২০২৪ সালের জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহেই কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারে দুই পক্ষের কয়েদিদের মধ্যে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ব্যাপক মারামারি হয়। এ সময় কয়েকজন কয়েদি ও কারারক্ষী আহত হন।
কারা সূত্র জানায়, একটি প্রভাবশালী কয়েদি গোষ্ঠী অন্য গোষ্ঠীর ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করলে সংঘর্ষ শুরু হয়। দ্বিতীয় সপ্তাহে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে এক কয়েদি গোপনে মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে গিয়ে ধরা পড়ে। এই ঘটনা থেকে শুরু হওয়া উত্তেজনা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং কয়েক ডজন কয়েদি ও কয়েকজন কারারক্ষী আহত হন। একই মাসের শেষ দিকে কুমিল্লা কারাগারে খাবার সরবরাহ নিয়ে কয়েদিদের ক্ষোভ সহিংস আকার ধারণ করে, যা দমন করতে অতিরিক্ত পুলিশ ডাকা হয়।