ঢাকা রবিবার, ১৭ আগস্ট, ২০২৫

উৎপাদন বন্ধ আড়াই বিলিয়ন ডলারের বিদ্যুৎকেন্দ্রে; সরকারের ক্ষতি কোটি কোটি টাকা

স্বপ্না চক্রবর্তী
প্রকাশিত: আগস্ট ১৭, ২০২৫, ১২:২৬ এএম
পটুয়াখালীর কয়লাভিত্তিক বৃহৎ তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র। ছবি- সংগৃহীত

কয়লা না থাকার কারণে উৎপাদন বন্ধ রয়েছে পটুয়াখালীর কয়লাভিত্তিক বৃহৎ তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রটির। দিনের পর দিন উৎপাদন না করে দেওয়া হচ্ছে ক্যাপাসিটি চার্জ। গচ্চা যাচ্ছে সরকারের কোটি কোটি টাকা। কিন্তু কয়লা আমদানিতে অনীহা সরকারের। কয়লা আমদানির জন্য বারবার দরপত্রের সুপারিশ করা হলেও বাতিল হচ্ছে অদৃশ্য কোনো কারণে।

এমন অবস্থায় বিদ্যুৎকেন্দ্রটি চালু রাখতে কয়লা আমদানির সম্মতি প্রদানের জন্য দাবি জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। 

সম্প্রতি পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় নির্মিত কয়লাভিত্তিক বৃহৎ তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য দীর্ঘমেয়াদে কয়লা সরবরাহের জন্য চতুর্থ দফায় ডাকা দরপত্র আবারও বাতিল করা হয়। দরপত্রে কারিগরি ও আর্থিক মূল্যায়নের বিভিন্ন ধাপে অনিয়ম, ত্রুটির কথা উল্লেখ করে এই দরপত্র বাতিল সুপারিশ করেছে এ-সংক্রান্ত গঠিত কমিটি।

একই সঙ্গে আবারও কয়লা আমদানির জন্য পুনরায় দরপত্র আহ্বানের সুপারিশ করে এ কমিটি। চতুর্থ দফায় দরপত্র বাতিলের মধ্য দিয়ে বৃহৎ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির উৎপাদন নিয়ে বড় অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

এর আগে তিন দফায় কেন্দ্রটির জন্য দীর্ঘমেয়াদি কয়লার দরপত্র ডেকেও কোনো কোম্পানি চূড়ান্ত করতে পারেনি আরপিসিএল-নরিনকো ইন্টারন্যাশনাল কোম্পানি লিমিটেড (আনএনপিএল) কর্তৃপক্ষ।

বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, আরএনপিএলের ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বর্তমানে ৩০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। দুটি ইউনিট প্রস্তুত হলেও কয়লার কোম্পানি নির্বাচন করতে না পারায় পূর্ণ সক্ষমতায় কেন্দ্রটি ব্যবহার করা যাচ্ছে না। এতে কেন্দ্রটির নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। কারণ মোট ২ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে ১ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলার চীনের ঋণ রয়েছে।

বিদ্যুৎ বিভাগসংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বৃহৎ কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য পাঁচ বছর মেয়াদি কয়লার সরবরাহকারী নিশ্চিত করতে চায় আরএনপিএল কর্তৃপক্ষ। সেজন্য দফায় দফায় টেন্ডার আহ্বান করা হয় বিভিন্ন শর্ত দিয়ে। কিন্তু কারিগরিভাবে নির্বাচন করা গেলেও আর্থিক মূল্যায়নে নানাভাবে আটকে যাচ্ছে। দরপত্রে শর্ত পূরণে বারবার চেষ্টা করা হলেও ত্রুটি ও অনিয়ম উঠে এসেছে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে। যে কারণে চূড়ান্তভাবে চতুর্থ দফায়ও কয়লার দরপত্র বাতিল করার সুপারিশ করা হয়েছে।

তবে ভিন্ন একটি সূত্র জানিয়েছে, আরএনপিএলের দরপত্র অনুযায়ী শর্ত পূরণ করে বিদেশি একটি কোম্পানি নির্বাচিত হলেও স্থানীয় কোম্পানিগুলোর অনেকেই দরপত্র থেকে বাদ পড়ায় বিভিন্ন ধাপে অনিয়মের অভিযোগ তুলেছে। এসব অনিয়ম নিয়ে কমিটি সুপারিশ করলেও সুনির্দিষ্ট করে ও মোটাদাগে তেমন কোনো কারণ দেখাতে পারেনি বলে দাবি করেন তারা।

বিদ্যুৎ বিভাগের এক চিঠি সূত্রে জানা গেছে, কয়লার জন্য আহ্বানকৃত দীর্ঘমেয়াদে দরপত্রে বিভিন্ন ধাপে ত্রুটি ও অনিয়ম পাওয়া গেছে। ফলে কয়লা আমদানিতে আহ্বানকৃত এ দরপত্র বাতিল করে দ্রুত নতুন দরপত্র আহ্বান করতে হবে। সেই সঙ্গে ভবিষ্যতে কয়লা ক্রয়ে টেকনিক্যাল স্পেসিফিকেশন বিশেষ করে কয়লার ক্যালোরিফিক ভেল্যু (জিএআর), অ্যাশ ফিউশন টেম্পারেচার, কয়লার সাইজ দরপত্রের শর্তে এমনভাবে নির্ধারণ করতে হবে, যেন দরপত্র প্রক্রিয়ায় অবাধ, নিরপেক্ষ ও প্রতিযোগিতামূলক করা যায়।

কয়লাক্রয়ের দরপত্র সংক্রান্ত কমিটি আগামীতে কয়লাক্রয়ের চুক্তির মেয়াদ পাঁচ বছরের পরিবর্তে দুই বছর করার সুপারিশ করে।

এর আগে কয়লার স্পেসিফিকেশন (ক্যালোরিফিক ভেল্যু) অ্যাশ ফিউশনসহ নানা শর্ত কমিয়ে এবং দরপত্রে শর্ত শিথিল করে পুনরায় দরপত্র আহ্বান করার কথা বলা হয়েছিল। এবার সেই একই কারণ দেখিয়ে পুনরায় দরপত্র আহ্বানের সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি। তবে অ্যাশ ফিউশন এবং কয়লার সাইজ শর্ত শিথিল করার কথা বলা হয়েছে।

নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র বলছে, কয়লার মান ও অ্যাশ ফিউশন বিদ্যুৎকেন্দ্রের ডিজাইন অনুযায়ী আরও কমানো হলে তাতে বয়লার তীব্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। পাশাপাশি বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লার কিলোক্যালরি কম হলে তাতে জ্বালানি ব্যয় বেশি হওয়ার বড় আশঙ্কা রয়েছে। 

কলাপাড়ায় ২ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তির ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করেছে যৌথভাবে আরএনপিএল। এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি এরই মধ্যে জাতীয় গ্রিডে পরীক্ষামূলকভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ করেছে। তবে কেন্দ্রটি পূর্ণ সক্ষমতায় চালানোর জন্য কয়লার দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি করতে পারেনি।

আরএনপিএল সূত্রে জানা গেছে, কেন্দ্রটি নির্মাণে চীনের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণচুক্তি করা হয়েছে।

দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় সাশ্রয়ীর জন্য এবং নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বেশি ব্যবহার হচ্ছে। সে অনুযায়ী পটুয়াখালীর ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বিদ্যুৎ সক্ষমতায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেন্দ্রটি কয়লার দরপত্র বাতিল হওয়ায় উৎপাদন নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। বিপুল অঙ্কে নির্মিত এই বিদ্যুৎকেন্দ্র বাণিজ্যিক উৎপাদন দফায় দফায় পেছানো হচ্ছে। অথচ চলতি বছরের অক্টোবর থেকে এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের ঋণ পরিশোধ শুরু হতে যাচ্ছে। বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হওয়ার আগেই বিপুল পরিমাণ ঋণ পরিশোধের বিষয়টি নিয়ে এরই মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। সরকারকে এই কেন্দ্র ব্যবহার না করলেও বড় আকারের ক্যাপাসিটি পেমেন্ট পরিশোধ করতে হবে।

আরএনপিএল সূত্রে জানা গেছে, আরএনপিএলের ১ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণচুক্তি রয়েছে। ১৫ বছর মেয়াদি এই ঋণচুক্তির মধ্যে চার বছর গ্রেস পিরিয়ড। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে এই ঋণ চুক্তি হয়। চুক্তির শর্তে বলা হয়, প্রকল্প শেষ হওয়ার ছয় মাস পর থেকে ঋণ পরিশোধ শুরু হবে।

জানা গেছে, চলতি বছরের এপ্রিলে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির দুটি ইউনিট গ্রিডের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এবং পরীক্ষামূলক বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করেছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পূর্ণ উৎপাদনের জন্য প্রস্তুত হলেও ২৫ শতাংশ প্লান্ট ফ্যাক্টরে চলছে।

নির্ভরযোগ্য একটি সূত্রে জানা গেছে, কেন্দ্রটি প্রতিমাসে সাড়ে ১০ মিলিয়ন ডলারের বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে। ২৫ শতাংশ প্লান্ট ফ্যাক্টরে চলছে অন্তত সাড়ে ৭ মিলিয়ন ডলারের (জ্বালানি খরচ বাদে) বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে না। এতে কেন্দ্রের আর্থিক ক্ষতি বাড়ছে।

দেশের বিদ্যুৎ খাতে কেন্দ্র প্রস্তুত হলেও জ্বালানি আমদানি ও সরবরাহ সংকটে বিপুল পরিমাণ আর্থিক লোকসান দিতে হয় সরকারকে। এতে একদিকে যেমন বিদ্যুৎখাতের ব্যয় বাড়ছে, অন্যদিকে এই লোকসান ভর্তুকি হিসেবে জনগণের কাছ থেকে নেওয়া হচ্ছে বলে মনে করেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা।

বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে ক্যাবের জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. শামসুল আলম রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ক্যাপাসিটি চার্জের নামে এমনিতেই বছরের পর বছর আমাদের একটা বড় অংকের অর্থ খরচ হয়ে যাচ্ছে। পটুয়াখালীর বিদ্যুৎকেন্দ্রটি সক্ষমতার দিকে সবচেয়ে এগিয়ে আছে। শুধু কয়লার অভাবে উৎপাদন করতে না পারাটা মানা যাচ্ছে না। অন্তর্বর্তী সরকার এখন অনেক কাজ করছে। আশা করছি, এই কেন্দ্রটি নিয়েও কাজ করবে। 

বিদ্যুৎ বিভাগের সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ হোসেন পাটওয়ারী সই করা ওই চিঠি আরএনপিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. নাজমুস সায়াদাত বরাবর পাঠানো হয়েছে। একই সঙ্গে এই চিঠির অনুলিপি পাঠানো হয়েছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) চেয়ারম্যান প্রকৌশলী রেজাউল করিমকে।

আরএনপিএলের দরপত্র বারবার কেনো বাতিল হচ্ছে এবং বাণিজ্যিক উৎপাদন বারবার পিছিয়ে যাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, বিষয়টি আমাদেরও নজরে এসেছে। বিদ্যুৎ বিভাগ এটি নিয়ে কাজ করছে। আশা করছি খুব শিগগির এই কেন্দ্র উৎপাদনে আসতে। এক্ষেত্রে কয়লার দরপত্রের জন্য যা যা করণীয় তা করা হবে। 

আরএনপিএল সূত্রে জানা গেছে, দীর্ঘ মেয়াদে বিদ্যুৎকেন্দ্রে কয়লা সরবরাহের জন্য ২০২২ সালের নভেম্বরে প্রথমবার দরপত্র আহ্বান করা হয়। ওই দরপত্রে বেশ কয়েকটি কোম্পানি শিডিউল কেনে। সাতটি কোম্পানিকে শর্ট লিস্টও করা হয়। পরবর্তীতে দরপত্রে বেশকিছু শর্ত পরিবর্তনের কারণে তা বাতিল করা হয়। ওই দরপত্রে সিঙ্গাপুরভিত্তিক ইয়াংথাই এনার্জি পিটিই লিমিটেড শিডিউল কেনে। কিন্তু পরবর্তীতে দরপত্রটি বাতিল হয়ে যায়।

বিদ্যুৎকেন্দ্রটির জন্য দীর্ঘমেয়াদে কয়লা আমদানি চুক্তির জন্য গত বছরের ১৫ জানুয়ারি দ্বিতীয় দফায় দরপত্র আহ্বান করা হয়। পাঁচটি কোম্পানি দরপত্র জমা দেয়। ওই বছরের ২৯ ফেব্রুয়ারি দরপত্র খোলার সময়সীমা ছিল। দরপত্রে ইয়ংথাই কারিগরিভাবে যোগ্য হিসেবে বিবেচিত হয়। কিন্তু ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ওই দরপত্র পরে বাতিল হয়ে যায়।

অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর আরএনপিএলের বিদ্যুৎকেন্দ্রে কয়লা আমদানির জন্য ৬ নভেম্বর তৃতীয় দফায় দরপত্র আহ্বান করে। ওই দরপত্র আহ্বানের পর দেশি-বিদেশি অন্তত ২৫টি কোম্পানি অংশ নেয়। ওই দরপত্রে কোম্পানির আর্থিক যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা, কয়লাখনি, কয়লার মানসংক্রান্ত শর্ত নিয়ে আরএনপিএলের রিভিউ মিটিং অনুষ্ঠিত হয়। সেবারও কয়লা আমদানির দরপত্রে শর্তের সবকিছু পূরণ করে কাগজপত্র জমা দেয় সিঙ্গাপুরভিত্তিক ইয়াংথাই এনার্জি।

কিন্তু অন্যান্য কোম্পানি দরপত্রের চাহিদা অনুযায়ী কাগজপত্র জমা দিতে না পারায় টেন্ডার থেকে ছিটকে পড়ে। এ দফায় বাদ পড়া বিভিন্ন কোম্পানির পক্ষ থেকে মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়ে দরপত্রের কঠিন শর্ত শিথিলের অনুরাধ জানায়। বিষয়টি বিবেচনা করে কয়েক দফা শর্ত শিথিল করার পাশাপাশি সময়ও বাড়ানো হয়। এরপরও বাকিরা দরপত্র দাখিল করেনি।

ফলে ইয়াংথাই এনার্জি একক দরদাতা হয়। চতুর্থ দফায় দরপত্রে ইয়াংথাই কারিগরিভাবে যোগ্য নির্বাচিত হলেও আর্থিক ত্রুটি ও অনিয়ম দেখিয়ে দরপত্র বাতিলের সুপারিশ করা হয়।